ভাষা তুমি কার? রাজনীতির না নেতাদের!

ভাষা তুমি কার? রাজনীতির না নেতাদের!
সুমন ঘোষ
রাজনীতিতে তুই তোকারি যেন এখন নিত্যকার ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তার সঙ্গে চলছে, ব্যক্তি আক্রমণ। পরিবারকে নিয়েও টানাটানি। আর, প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটছে সমাবেশে নিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে!
সভা বা সমাবেশ কেন হয়? রাজনৈতিক দলগুলি কেন লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত করেন? এর লক্ষ্য কী? রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাই বলছেন, এর প্রধান লক্ষ্য শক্তি প্রদর্শন। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হল, মানুষের সামনে দলের নীতি-আদর্শ বোঝানোর পাশাপাশি দলের কর্মসূচী বুঝিয়ে দেওয়া। আগামী পরিকল্পনা সম্বন্ধেও ধারণা তৈরি করা। সভা-সমাবেশে আগত মানুষ তা শুনবেন এবং বুঝবেন। তারপর বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের এলাকায় সেই কথা প্রচার করবেন।
কেন মানুষ বাড়ি ফিরে সে কথা প্রচার করবেন? কারণ, সভা-সমাবেশে যাঁরা বক্তব্য রাখছেন তাঁরা কেউ কোনও সাধারণ মানুষ নন। তাঁরা একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। অর্থাৎ জনসমক্ষে তিনি যা বলবেন, সেটাই তাঁরা পরবর্তীকালে মানবেন। ঠুনকো কারণে তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। যদি ব্যতিক্রম ঘটে, সেটাও তাঁরা ব্যাখ্যা দেবেন, কেন মত পরিবর্তন করা হল। তবে তো লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই নেতার প্রতি বিশ্বাস রাখবেন। আর উল্টোদিকে নেতাও মানুষের আস্থা অর্জন করবেন।
কিন্তু এবার ঠিক যেন তার উল্টোটাই ঘটছে। মুখে দলীয় কর্মসূচী, উন্নয়ন পরিকল্পনা, মানুষের পাশে থাকার বার্তা – এসব বড্ড কম শোনা যাচ্ছে। যেন, অনেকটা এরকম, ওসব তো আমরা করেই থাকি। তা আর বলার কী দরকার। তাই এসব বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথায়? তার থেকে অন্য কথা বলা ভালো। কিন্তু না, সে অন্য কথার মধ্যে নীতি-আদর্শের কথাও নেই। রয়েছে ব্যক্তি আক্রমণ। সে ব্যক্তি আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক নেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। নেতাকে ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে তার অন্দরমহলে। বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্রকে ছুঁয়ে যাচ্ছে! এবং তা যাচ্ছে নিম্ন শব্দবন্ধের মাধ্যমে। আগে দেখা যেত, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন রাজনৈতিক নেতারা। বুদ্ধিজীবীদের কাছে পরামর্শ নিতে যেতেন। আর এখন দেখি বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ঘুরঘুর করে। এমনকী, সরাসরি রাজনৈতিক দলের মধ্যেও ভিড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। ফলে এসব নিয়ে প্রতিবাদের ভাষাও মেলে না। কারণ, বুদ্ধিজীবীরাও যে সে সব মঞ্চেই আসীন।
না কোনও একটি রাজনৈতিক দল একথা বলছেন, তা নয়। একাধিক রাজনৈতিক দল। বিশেষত, এবার যুযুধান যে দুটি দল রাজ্যে ক্ষমতায় পুণরায় থাকতে ও অন্যজন দখল করতে মরিয়া, তাঁদের মধ্যেই এটা বেশি।
আশা করি, এক্ষেত্রে দু’টি উদাহরণই যথেষ্ট। ধরা যাক বিজেপির কথা। যে দলের নেতাদের মুখ থেকে প্রথমেই উঠে আসে, ‘মাননীয় তোলাবাজ ভাইপো’ শ্লোগান। এখানেই শেষ নয়, এয়ারপোর্টে সোনা নিয়ে ধরা পড়ার কথা। যা বলে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে নিশানা করা হয়। মদন মিত্রকে মদ্যপ বলেও প্রকাশ্যে আক্রমণ করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীকেও সরাসরি আক্রমণ করতে ছাড়া হয় না।
এবার উল্টোদিকে যাওয়া যাক। তৃণমূল শিবিরে। সেখান থেকে অবাধে উঠে আসে তুই, তোকারি। তোয়ালে ঢেকে টাকা নেওয়ার কথা। সব শেষে বল্গাহীন আক্রমণ, তোর বাপকে গিয়ে বল!
হাজার হাজার মানুষ এই সভা গুলোতে উপস্থিত থাকছেন। শুনছেন। তাঁরা কোন দিক নির্দেশ বুঝে বাড়ি ফিরবেন? গ্রামে গ্রামে দলের প্রচারে গিয়ে কী বলবেন? ব্যক্তি আক্রমণ শিখে এলাম! এভাবে নেতারাই কী নিজেদের মানের অবনতি ঘটিয়ে ফেলছেন না? তা জেনে বুঝে হোক বা না বুঝে, আবেগতাড়িত হয়ে হোক বা উত্তেজনায়।
এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে বর্তমানে রাজনীতির যে ভাষা তৈরি হয়েছে সেটা কল্পনার বাইরে। বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলছেন, এই ধরণের ভাষা আগে দেখা যায়নি। তাই পরিবার টেনে কথা হচ্ছে। তুই, তোকারি হচ্ছে। তৃণমূল নেতা সৌগত রায়ও বিজেপির ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে কেউ দলের নেতাদের মুখ থেকে ভাষার অপব্যববার বন্ধ করতে পারছেন না।


