নিজের মায়ের চেয়েও কার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁরই অবদান কতখানি?

নিজের মায়ের চেয়েও কার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁরই অবদান কতখানি?
বাসবী ভাওয়াল
'যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে'- এই প্রবাদ বাক্য আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। তবে সেই ব্যক্তি যদি হন রন্ধনশিল্পে পটীয়সী এবং তার পাশাপাশি এক সুন্দর কেশবন্ধনের মতো রাজনৈতিক মেলবন্ধনে দক্ষ তাহলে তো তিনি দেশের সর্বোচ্চ নেতার কাছে মায়ের আসন ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবেন এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও কারাবরণ করে যিনি ইতিহাসে বিশেষ আসন দখল করে নিয়েছেন তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী।
এক রাতে চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে দেখা করতে এল প্রেসিডেন্সি কলেজের এক দল ছাত্র। বাংলার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের রক্ষা করছেন তখন জনপ্রিয় আইনজীবী চিত্তরঞ্জন। দাশ-দম্পতি যখন নৈশাহারে বসেছেন তখন তাঁদের কাছে ভিজিটরস স্লিপ এনে দিলেন ভৃত্য। বাসন্তী দেবী খাবার ঘরে তাদের আসতে দিতে আপত্তি করলেও চিত্তরঞ্জনের অনুমতি পেয়ে ছাত্র দল ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রেসিডেন্সি কলেজের তরুণ ব্রিটিশ অধ্যাপক এডওয়ার্ড এফ ওটেন, যাঁর উদ্ধত আচরণের জবাব দিতে সংঘটিত ছাত্র হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুভাষ। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯, বাসন্তী দেবী সুভাষকে প্রথমবার দেখলেন।
১৯২১ সালে সিভিল সার্ভিস থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর পদত্যাগ ভারতে হইচই ফেলে দিল। ইংল্যান্ড থেকে তিনি দেশবন্ধু কে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কলকাতায় পৌঁছে তিনি দেশবন্ধুর সাথে দেখা করতে এলেন কিন্তু দেশবন্ধু কলকাতায় ছিলেন না, বাসন্তী দেবীকে বলা হলো সুভাষ এসেছেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, সেই সুভাষ বসু, যিনি আই সি এস থেকে পদত্যাগ করেছেন। সেই দিন থেকেই বিশেষ এক সম্পর্কের সূচনা। বাকি জীবন বাসন্তী দেবীকে 'মা' বলে ডাকতেন সুভাষ। যখনই কোনো বিষয় নিয়ে গুরু শিষ্য মতভেদ হতো, মধ্যস্থতা করতেন বাসন্তী দেবী। অজস্র প্রশ্নে যখন চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্রের তর্ক হয়েছে তখন মা অর্থাৎ বাসন্তী দেবীর মধ্যস্থতায় মিটমাট হত।
১৯২৪ সালে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে হতাশ দেশবন্ধু স্ত্রীর শরণাপন্ন হলেন। বাসন্তী দেবী তাঁকে বললেন ঐ পদ গ্রহণ করতে এবং চাকরি সূত্রে পাওয়া বেতন ভালো কাজের জন্য বাসন্তী দেবীকে দিয়ে দিতে।
দেশবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর পরিবারের মেয়েদের কোর্ট অ্যারেস্টে অংশগ্রহণ করাতে চাইলে আপত্তি তুললেন সুভাষ। তাঁর মত ছিল সব পুরুষেরা বন্দি হলে তবেই মেয়েরা এগিয়ে আসবে। কিন্তু দেশবন্ধু নাছোড়বান্দা। বাসন্তী দেবী আবার ও সুভাষ কে মত বদলে রাজি করালেন এমনকি তাঁকে সত্যাগ্রহের স্থলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন সুভাষকেই। বাসন্তী দেবী দ্রুত গ্রেফতার হলেন, সারা বাংলা জুড়ে ক্ষোভের ঢেউ উঠলে সরকার বুঝতে পারল একটি সাংঘাতিক ভুল করে ফেলেছে। হঠাৎ মাঝরাতে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হল।
দেশবন্ধু ভেবেছিলেন বাসন্তী দেবীর গ্রেফতার জনমনে যে ভয়ানক ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল তাকে কাজে লাগাবেন। স্ত্রীকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখে খুব হতাশ হয়েছিলেন তিনি। বাসন্তী দেবী স্বামীকে বলেছিলেন, "পুলিশ আমাকে কারাগারে রাখবে না, তুমিও আমাকে বাড়িতে রাখতে চাও না। আমি কোথায় যাবো?" যখন স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হচ্ছে তখন পৌঁছলেন সুভাষ। বাসন্তী দেবীকে ফিরে আসতে দেখে অঝোরে কেঁদে ফেললেন। সুভাষ কে শান্ত করার চেষ্টা করলেন এবং জানালেন তিনি ভালো আছেন।
ব্যক্তিগত বিষয়ে বাসন্তী দেবীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন সুভাষ। সুভাষের জন্য রান্না করা বাসন্তী দেবীর কাছে নতুন নয়। সেদ্ধ ভাত আর তরকারি-বাঙালির ভাতে ভাত সুভাষের খুব প্রিয় খাদ্য। এলগিন রোডের বাসভবন থেকে পলায়নের আগে সুভাষের সাথে শেষ দেখা বাসন্তী দেবীর। অনশন করার পর সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন শরীর তখন ও বেশ দুর্বল। বাসন্তী দেবীর দিকে তৃষ্ণার্ত ভাবে চেয়ে হেসে সুভাষ ভাতে ভাত খাওয়ানোর দাবি করেছিলেন যা কখনো হয়নি।
১৯২৫ সালের ১৬ ই জুন চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পর সুভাষ চাইলেন দেশবন্ধুর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করুন তাঁর স্ত্রী। কিন্তু জনজীবন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন বাসন্তী দেবী। বারবার তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও বিফল হন সুভাষ। ভারতীয় নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় যাওয়া দরকার বলে মনে করতেন সুভাষ। তিনি বাসন্তী দেবীর জয়গান করে বলেন, "আপনি কেবল চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী নন, আপনি বঙ্গমাতার অবতার।" দেশবন্ধুর শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারেন নি সুভাষ। কারণ তিনি তখন বর্মায় সরকারের দ্বারা কারারুদ্ধ। সুভাষ বাসন্তী দেবীকে লিখেছিলেন, "যিনি একই সঙ্গে আমার জীবনের লক্ষ্যে আমার বন্ধু, দার্শনিক, এবং পথ প্রদর্শক, তিনি আর নেই।আজ আমি একেবারে নিঃস্ব। একমাত্র আপনিই এই অসহায় মানুষটির আশ্রয়।" নিজের মায়ের চেয়েও বাসন্তী দেবীর সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
বাসন্তী দেবী ছিলেন সুভাষচন্দ্রের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারীদের মধ্যে অন্যতম। সুভাষচন্দ্রের শেষ পর্যন্ত যেমন ভাতে ভাত খাওয়ার সুযোগ হয়নি তেমনি ঘটনা ঘটেছিল ব্রক্ষবান্ধব উপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। বাসন্তী দেবী নিজের হাতে খেতে দিচ্ছেন স্বামী চিত্তরঞ্জন দাশ এবং ব্রক্ষবান্ধব উপাধ্যায়কে। এক হাতা কুমড়োর ছেঁচকি দিলেন ব্রক্ষবান্ধব উপাধ্যায়ের কাঁসার থালায়। "এমন চমৎকার রান্না আমি আর খাইনি, আমি ফিরে এসে আবার আপনার হাতের কুমড়োর ছেঁচকি খাবো।"- বলেই হেসে উঠলেন মুন্ডিত মস্তক গেরুয়া পোশাক পরিহিত এক সাধক স্বদেশী পন্ডিত। বাসন্তী দেবী ঘোমটার আড়াল থেকে বললেন- "তা বটেই,দেশমাতা আপনাদের রক্ষা করবে।" ফিরে আসেন নি তিনি। সেদিনই গ্রেফতার হন। তাঁকে অসুস্থতার কারণে ক্যাম্পবেল হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং সেখানে ধনুষ্টঙ্কার হয়ে মারা যান। আর কুমড়োর ছেঁচকি খাওয়া হয়নি তাঁর।
স্বামী এবং একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন এর পরেও অনেক পারিবারিক বিপর্যয় ও ব্যক্তিগত শোক সহ্য করতে হয়েছিল।
অথচ চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে তাঁর যখন বিবাহ ঠিক হয় তখন চিত্তরঞ্জন দাসের পরিবার ঋণগ্রস্ত। অনেক বাঙালি শিক্ষিত পরিবার এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো অসন্তুষ্ট ছিলেন। পিতা বরদানাথ হালদার তখন তাঁর মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন ও বলেছিলেন তোকে যার হাতে দিচ্ছি , একদিন দেখবি ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত তার নাম ধ্বনিত হবে।স্বামীর কর্মকাণ্ড দেখে বদলে যায় বাসন্তী দেবীর মন। নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করতে শুরু করেন। দেশের প্রতি চিত্তরঞ্জন দাসের ভালোবাসা, নিষ্ঠা উদ্বুদ্ধ করেছিল বাসন্তী দেবীকেও। স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ পথ তাঁরা দুজনে হেঁটেছেন একসাথে। ব্রিটিশ কারাগারে রুদ্ধ প্রথম বাঙালি নারী ছিলেন তিনি। চিত্তরঞ্জন সেবাসদন গড়ে তুলেছিলেন সময়মতো চিকিৎসা প্রদানের জন্য। তাঁর সন্তান চিররঞ্জনের মৃত্যুর পর একেবারে রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে এসেছিলেন। তবে তাঁর কাজ, বোধ, চেতনা দেশকে দেশের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে সবসময়। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আমাদের প্রয়োজন নারী জাতির আত্মবিকাশে ও জাগরণে জননী স্বরূপা এই মহীয়সী নারীদের কর্মধারা অনুসরণ।
লেখক- প্রধান শিক্ষিকা, শালবনী নিচুমঞ্জরী বালিকা বিদ্যালয়।



