ফি-বছর নিম্ন দামোদর অববাহিকায় বাঁধের ছাড়া জলে সৃষ্ট প্লাবনে দায় কার? জল যন্ত্রণা থেকে মুক্তিই বা কোন পথে?

ফি-বছর নিম্ন দামোদর অববাহিকায় বাঁধের ছাড়া জলে সৃষ্ট প্লাবনে দায় কার? জল যন্ত্রণা থেকে মুক্তিই বা কোন পথে?
ডঃ শুভেন্দু ঘোষ
পশ্চিমবঙ্গ একটি নদীমাতৃক রাজ্য। প্রতি বছরই মৌসুমি সময়কালে অতিবৃষ্টির কারণে প্লাবন দেখা যায়। দামোদর অববাহিকায় বন্যা অতীতে এতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করত যে দামোদর নদকে বঙ্গের দূঃখের নদী (Sorrow of Bengal) বলা হত।
১৯৪৩ সালের ভয়াবহ বন্যার পর তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের কৌশলগত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর বাংলার দুঃখের নদী দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমেরিকার টেনেসি নদী (Tennessee River) পরিকল্পনার অনুকরণে ১৯৪৮ সালে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠিত হয়। এবং এই জাতীয় সংস্থাটির তত্বাবধানে বন্যা নিয়ন্ত্রণে দামোদর নদীর উচ্চ প্রবাহে ৭ টি নদীবাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক পর্বে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে কিছুটা বিতর্কও ছিল। এছাড়াও তৎকালীন সময়ে চারটি বাঁধ নির্মাণের পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৩ সালে তিলাইয়া, ১৯৫৫ তে কোনার, ১৯৫৭ সালে মাইথন ও ১৯৫৯ সালে পাঞ্চেৎ বাঁধ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সুপারিশ মত কৃষিকার্যে জলসেচের উদ্দেশ্যে দুর্গাপুর ব্যারেজ স্থাপিত হয়। তাই একথা বলা যেতেই পারে যে, প্রথম থেকেই এক্ষেত্রে একটা অসম্পূর্ণতা থেকেই গিয়েছিল বলে বেশিরভাগ নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অন্যদিকে, সেই সময়ে নির্মিত বাঁধগুলির জল ধারণ ক্ষমতাও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। মালভূমি জুড়ে বিস্তৃত খনি অধ্যুষিত এই অববাহিকা অঞ্চলে ক্রমাগত সবুজের হ্রাসের কারণে ভূপৃষ্ঠপ্রবাহের পরিমাণ ও গতিবেগের বৃদ্ধিতে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মালভূমি অঞ্চল থেকে আগত প্রচুর পরিমাণে পলিরাশি জলাধার গুলির তলদেশে অবক্ষিপ্ত হওয়ায় এগুলির গভীরতাও যথেষ্ট পরিমানে হ্রাস পেয়েছে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চলের বিভিন্ন জলাধারগুলির জল ধারণ ক্ষমতা ৩৫ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সৃষ্ট বাঁধই বর্তমানে বন্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্যার কারণ ও ত্রানে রাজনীতি আমাদের রাজ্যে তথা সমগ্র দেশে নুতন কিছু নয়, চলমান বিতর্কের রসদ। তবে রাজনীতির কুশীলবরা তাদের সংকীর্ণ দলীয় লাভালাভের অংকে তো রাজনীতি করবেই। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, সরকারের দায়িত্ব জনগণের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে ম্যান মেড বন্যার তত্ব নিয়ে শাসক বিরোধী কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে। তবে সরকারিভাবে পুরো বিষয়টিকে রাজনীতি ভেবে উপেক্ষা করা যায় না। মুশকিলটা হলো এই যে, এই অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রাদেশিক আর্থিক বঞ্চনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা এবং রূপায়ণে অনীহা ইত্যাদি সবকিছুই জনগণের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়ে সরকারের উদাসীনতাকেই ইঙ্গিত করে। নদী একটি জাতীয় সম্পদ হওয়ায় নদী সংস্কারে জাতীয় সরকারের দায়িত্ব সর্বাগ্রে। কিন্তু একই সঙ্গে যে রাজ্যের উপর দিয়ে নদীগুলি প্রবাহিত হয় সেই রাজ্য সরকারেরও উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণও তাদের দায়িত্ব। সুতরাং এক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্র - রাজ্য সুসম্পর্কের ভিত্তিতে ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন পরিকল্পনাগুলির যথাযথ বাস্তবায়নই একমাত্র পথ হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে কেন্দ্রীয় অর্থ সংস্থান আটকে থাকার অভিযোগ সত্যি হলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, যা জরুরি ভিত্তিতে উভয় সরকার আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নিলেই ভালো।
নদীর উচ্চ গতিতে বাঁধ দেওয়ার ফলে পরবর্তী অংশে নদীর উপত্যকার আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তনের সাথে সাথে জলপ্রবাহেও পরিমানগত পরিবর্তন দেখা যায়, যা নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। অন্যদিকে নিম্নপ্রবাহে নদীগর্ভে মানুষের অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ যেমন নদীগর্ভে বালি উত্তোলন নদীর পাড় ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে এবং বন্যার প্রবনতা বাড়িয়ে তোলে। যে বছর মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এই বিস্তীর্ণ অববাহিকা অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়,সেই বছর অতিরিক্ত বৃষ্টির জলে বিশেষত পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। বর্ধমানের আউসগ্রাম ও রায়না থেকে শুরু করে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল এবং হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়।
এখন আসুন এই ভয়ংকর সমস্যার থেকে নিস্তারের বিষয়ে কিছু সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে বেশ কিছু বন্যা প্রতিরোধমুলক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমতঃ দামোদর ও বরাকরের উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে বিশেষত ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মালভূমি অঞ্চলে ভূমিক্ষয় নিবারণে বনসৃজনের উদ্যোগ নিতে হবে,ফলে নদীতে অবক্ষিপ্ত পলির পরিমাণ কমবে এবং বাঁধের জলাধারগলির তলদেশে পলি সঞ্চয়নের হারও কিছুটা কমবে।
দ্বিতীয়তঃ নিম্ন অববাহিকায় জল নিকাশি ব্যবস্থা সচল রাখতে একদিকে যেমন স্থায়ী নদীনালাগুলির সংস্কার করতে হবে অন্যদিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নূতন খাল কেটে জল নির্গমন পথ সুগম করতে হবে।
তৃতীয়তঃ বিশেষজ্ঞদের মতে পুরাতন বাঁধগুলির সংস্কার অত্যন্ত ব্যায় সাপেক্ষ ও অলাভজনক। তাই উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলের পূর্বদিকে আরও কয়েকটি জলাধার তৈরি করে মৌসুমী সময়ে অতিবৃষ্টির অতিরিক্ত জল কে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে সুখা মরসুমে সেচের জলেরও সংস্থান হবে।
চতুর্থতঃ নিম্ন অববাহিকায় নদীগর্ভে যত্রতত্র বালি উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সরকারি আইনগত পদক্ষেপ করতে হবে এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করতে হবে।
পঞ্চমতঃ কেন্দ্র রাজ্য বোঝাপড়ার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সরকারি বিভিন্ন গঠনমূলক ব্যাবস্থা ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বন্যা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনায় খুবই জরুরী। যেমন বাঁধের জল ছাড়ার আগে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রচার ও সতর্কবার্তা প্রদান এবং একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সম্ভাব্য বন্যাকবলিত অঞ্চল গুলিতে মাইকিং করা দরকার। প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত নীচু এলাকাগুলো থেকে মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে এবং পীড়িত মানুষজনের জন্য বন্যা পরবর্তী ত্রান ও পূনর্বাসন সুনিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও বন্যা ব্যাবস্থাপনায় সরকারের সাথে সাথে বিভিন্ন এন জি ও, ক্লাব, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সচেতনতা অঅত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখকঃ ভূগোলের শিক্ষক এবং গবেষক(TIEER)


