শত বাদ্যযন্ত্র ভেদ করেও যাঁর কানে সহমরণের কান্না পৌঁছায়, তাঁকে রোখে সাধ্য কার! রামমোহন ও দ্বারকানাথঃ একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক

শত বাদ্যযন্ত্র ভেদ করেও যাঁর কানে সহমরণের কান্না পৌঁছায়, তাঁকে রোখে সাধ্য কার! রামমোহন ও দ্বারকানাথঃ একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক
ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী
রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) এই দুই অগ্রদূত বঙ্গদেশে আধুনিকতার সূচনা করেছিলেন| রামমোহন রায়, তাঁর সহযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেয়ে ২২ বছরের বড়। অথচ, তাঁরা পরস্পরের সাথে মিশেছেন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত| আচরণে কিছু প্রভেদ থাকলেও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমকালীন সমাজের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে উভয়ে ক্রিয়াশীল থেকেছেন|
রামমোহন ১৮১৫ সালে একেশ্বরবাদী হিন্দুধর্ম বিষয়ে চর্চার জন্য ‘আত্মীয় সভা’ স্থাপন করেন| ‘আত্মীয় সভা’ গঠনের পূর্বে তিনি বেদসহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেছেন| পড়েছেন কোরান ও বাইবেল| বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর তিনি উপলব্ধি করেন ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়| সেই সঙ্গে সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামিই যে মানবতার প্রধান শত্রু এও উপলব্ধি করেন| মূলতঃ একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা ও সমকালের সমাজে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিরোধে আন্দোলন, এই দুই উদ্দেশ্যে ‘আত্মীয় সভা’-র প্রতিষ্ঠা| এই ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশে আধুনিকতার সূচনা| ‘আত্মীয় সভা’-র মাধ্যমে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সাথে রামমোহনের পরিচয়| দ্বারকানাথ ঠাকুর, ‘আত্মীয় সভা’-র অধিবেশন যোগদান করতেন ও আলোচনা-বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন| সেই সময়ে ‘আত্মীয় সভা’-য় যোগদান করেছিলেনঃ
প্রসন্নকুমার ঠাকুর (১৮০১-১৮৬৮), নন্দকিশোর বসু, শিবপ্রসাদ মিশ্র, হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী, কালিনাথ মুন্সি, বৈকুণ্ঠনাথ মুন্সি, কালিশংকর ঘোষাল, বৃন্দাবন মিত্র, ব্রজমোহন মজুমদার, নীলরতন হালদার, অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ মুখার্জি, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ (১৭৮৬-১৮৪৫), হলধর বসু, রাজনারায়ণ সেন|
অমিতাভ মুখার্জি তাঁর গ্রন্থে ‘Reform and Regeneration in Bengal’ উল্লেখ করেছেনঃ ‘A large number of rich and influential people of the city gathered round him (Rammohun Roy), forming a circle of friends and admirers.’
(Reform and Regeneration in Bengal, 1774-1823 | Amitabha Mukhopadhyaya | Rabindra Bharati University | January 1, 1968)
রামমোহনের জীবনীকার সোফিয়া ডবসন কলেট লিখেছেনঃ
‘The meetings were not quite public and were attended chiefly by Rammohun’s personal friends. Among these may be mentioned Dwarkanath Tagore, Brajamohan Majumdar, Haladhar Bose, Nandakishore Bose and Rajnarayan Sen’.
(The Life and Letters of Raja Rammohun Roy/ Sophia Dobson Collet)
১৮১৬ সালে ‘আত্মীয় সভা’-র এক আলোচনা সভায় উপস্থিত হন ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২) | ঐ আলোচনা সভায় ডেভিড হেয়ার একটি আধুনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন| পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সেদিন উপলব্ধি করেছিল ‘আত্মীয় সভা’| এদিনের আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় যাঁর মাধ্যমে এই প্রস্তাব বিষয়ে অবহিত হন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট (Sir Edward Hyde East / 1764-1847) | বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছাড়াও যাঁদের সমর্থন আদায় করেন তাঁরা হলেনঃ জয়কৃষ্ণ সিংহ, রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭), রামকমল সেন (১৭৮৩-১৮৪৪), দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), মতিলাল শীল (১৭৯২-১৮৫৪), মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (আনুঃ ১৭৬২-১৮১৯)| হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কমিটি গঠিত হয় সেখানে রামমোহন রায় না থাকলেও তিনি পরোক্ষভাবে এই সংক্রান্ত সব কাজে সহযোগিতা করেছেন| ১৮১৭ সালের ২০জানুয়ারি কলকাতার গরাণহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজের উদ্বোধন হয়|
১৮২৮ সালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক নিযুক্ত হন| ছাত্রদের ওপর তাঁর বিস্ময়কর প্রভাব ছিল| তাঁর ছাত্রদের অনেকেই নিজেদেরকে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গ্রুপের সদস্য বলে অভিহিত করতেন|
অবশেষে ১৮৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল হিন্দু কলেজের পরিসমাপ্তি ঘটে| তার স্থলে নামকরণ হয় ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’, ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন যার যাত্রা শুরু | এখন প্রেসিডেন্সি কলেজ, ‘প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ভারতবর্ষের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম|
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড হেয়ার কলকাতা ইংরেজি বিদ্যালয় ‘পটলডাঙা একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরে নাম হয় ‘হেয়ার স্কুল’ | এ দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ ও ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন| এইসব প্রতিষ্ঠান গঠনের সময় ডেভিড হেয়ার রামমোহন ও দ্বারকানাথ উভয়ের সহযোগিতা পেয়েছেন|
রামমোহন রায় কলকাতার হেদুয়ার কাছে ‘অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ (১৮২২) নামে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন| দ্বারকানাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথকে এই স্কুলে ভর্তি করে দেন| রামমোহন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রমাপ্রসাদ-কেও ভর্তি করে দেন ঐ স্কুলে|
পূর্বে গঠিত ‘আত্মীয় সভা’-কে ১৮২৮ সালে রামমোহন ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এ রূপান্তরিত করেন| ব্রাহ্মসমাজের উপাস্য নিরাকার ‘‘ব্রহ্ম’’| যে ধর্মে নিরাকার ‘ব্রহ্মই উপাস্য, সে ধর্ম ‘ব্রাহ্মধর্ম’| ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা উপনিষদের ‘ব্রহ্মতত্ত্ব’-কে গ্রহণ করেছেন|
উপনিষদের মতে– ‘‘ব্রহ্ম’’ হচ্ছেন এক এবং অদ্বিতীয় সত্তা| এই ব্রহ্মের দ্বারা এই চলমান বিশ্বচরাচর আচ্ছাদিত| ইনি নিজ দশা থেকে পরিবর্তিত হন না| এই কারণে ঈশ উপনিষদে এঁকে ‘অনেজৎ’ বা ‘অকম্প’ বলা হয়েছে| এবং অচল হয়েও ইনি প্রচণ্ড বেগবান| এই প্রবল গতিময়তার জন্যই তাঁকে আমরা সর্বত্র পাই| তিনি দূরে, নিকটে, সবার অন্তরে আছেন| সর্বত্র আছেন বলেই ইনি সর্বত্র বিরাজমান এবং প্রবল গতিকে অনুসরণ করে উপলব্ধ করা যায় না বলেই তাঁকে অচল মনে হয় এবং সর্বত্র আছেন বলে মনে হয়| তিনি জ্যোতির্ময় এবং অশরীরী| অশরীরী শব্দটি আত্মার স্বরূপ অর্থে উপস্থাপন করা হয়েছে| এই কারণে ‘ব্রহ্ম’, সাধারণ পার্থিব দৃষ্টি ক্ষমতার বিচারে অদৃশ্য| আর তিনি এতই বিস্তৃত যে, মন বা কল্পনা দিয়েও তাঁকে উপলব্ধি করা যায় না| আবার সকল কিছুর ভিতর দিয়ে ‘ব্রহ্ম’ প্রকাশমান বলেই তিনি স্পষ্ট| তাই শুধু দৃশ্যমান বস্তু, শব্দময় সত্তা, ভাবনার দ্বারা জ্ঞাত বিষয় দিয়েও ‘ব্রহ্ম’-কে উপলব্ধির চেষ্টা করা যায় মাত্র, কিন্তু পূর্ণ’ব্রহ্ম’কে চেনা যায় না| কেন উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ডের ৩য় সংখ্যক শ্লোকে এ বিষয়ে বলা হয়েছেঃ
যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ|
অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্ ॥
অর্থাৎ, জ্ঞানবান ব্যক্তির কাছে তিনি অবিজ্ঞাত এবং জ্ঞানহীনের কাছে তিনি জ্ঞাত| ইনি ক্ষতরহিত বলেই-উপনিষদে তাঁকে অব্যয়, অক্ষয়, অক্ষর প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে| ইনি পরম আরাধ্য বলেই ইনি অর্হ| ব্রহ্মের প্রার্থনাসূচক ধ্বনি হলো–‘ওম’| পূজারীরা যে অর্থে বা উদ্দেশ্যেই এই ধ্বনি উচ্চারণ করে, তা ব্রহ্মের স্মরণকে বুঝায়| ইনি আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক দুঃখের অতীত|
রামমোহন ও দ্বারকানাথের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মধর্ম একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়| ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত মানুষদের নিয়ে উত্তর কলকাতার অধিবাসী কমললোচন বোসের বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অধিবেশন বসে|
এই অধিবেশনে ব্রাহ্মদের জন্য একটি পৃথক ধর্মীয় সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয় এবং এই সমাজের নামকরণ করা হয়, ‘ব্রাহ্মসভা’, মতান্তরে উপাসনা সভা| কমললোচন বোসের বাড়ির সামনের দু’টি ঘর ভাড়া নিয়ে ব্রাহ্মসভার কাজ শুরু হয়|
প্রতি শনিবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে ন’টা সভার কার্যকাল| দুজন তেলেগু ব্রাহ্মণ ব্যক্তি বেদ, উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ উপনিষদ পাঠ করতেন| রামচন্দ্র বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা করতেন| পরিবেশিত হতো ‘ব্রহ্ম’সংগীত| কলকাতার বিশিষ্ট হিন্দুরা ব্রাহ্মসভা-য় যোগদান করলেন| অর্থ সংগৃহীত হল| এক খন্ড জমি কেনা হল| নির্মিত হল ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব গৃহ|
১২৩৬, ১১ মাঘ ( ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ, ২৩ জানুয়ারি) নতুন গৃহে ব্রাহ্মসমাজের কাজ শুরু হল| প্রথম প্রথম ভাদ্র মাসের সাম্বৎসরিক উৎসব হত| যা ‘ভাদ্র উৎসব’ নামে পরিচিত ছিল| প্রচুর ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রিত হতেন| তাঁদের দক্ষিণা দান করে বিদায় দেওয়া হতো| সমস্ত খরচ সামলাতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ আর মথুরানাথ|
১৯ শতকের শুরুতে বাংলার সমাজজীবনে চরম দুর্দিন চলছিল| হিন্দুসমাজে তখন ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তারাই সমাজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন| হিন্দুসমাজে প্রকট জাতিভেদ প্রথা চালু ছিল| হিন্দুসমাজ ছিল ভীষণ গোঁড়া ও রক্ষণশীল| ব্রাহ্মণেরা সমাজের মধ্যমনি হয়ে থাকলেও তাঁদের মধ্যে সমাজের কুসংস্কার ও কুপ্রথার প্রচলন সবচেয়ে বেশি ছিল| সে সময়কার সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ নানাভাবে সামাজিক বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হত, কিন্তু সমাজের কুসংস্কার ও কুপ্রথা বা নানাবিধ সামাজিক বিধিনিষেধ তাদেরকে তেমন গভীরভাবে স্পর্শ করেনি| ব্রিটিশ শাসক হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলি নিয়ে প্রথমদিকে তেমনভাবে মাথা ঘামায় নি বা তারা হিন্দুদের সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি| কারণ, তাদের আশঙ্কা ছিল এতে হস্তক্ষেপ করলে স্থানীয় মানুষ অসন্তুষ্ট হতে পারে|
উনিশ শতকের বাংলায় সামাজিক আন্দোলনের তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়| প্রথম ধারার বৈশিষ্ট্য হল প্রাচীন সনাতন হিন্দু সমাজ-ব্যবস্থাকে ধরে রাখার জন্য হিন্দুসমাজে একদল গোঁড়া ও রক্ষণশীল মানুষ উঠে পড়ে লেগেছিল| পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে যাতে হিন্দুদের সাবেকি সমাজব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে এবং হিন্দুসমাজের বিভিন্ন রক্ষণশীল কুপ্রথা ও নিষ্ঠুর ব্যবস্থাগুলিকে রক্ষা করতে তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন| তাঁরা সর্বপ্রকার সংস্কারের বিরোধী ছিলেন| আর একটি গোষ্ঠী ছিল উচ্চশিক্ষিত ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণকারী| সমাজের প্রগতিশীল এই সমস্ত ছাত্ররা হিন্দুসমাজের কুপ্রথা বা অত্যাচারের কঠোর সমালোচক ছিলেন| কিন্তু সংস্কার আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক| আর তৃতীয়টি হল এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যবর্তী কিছু স্বচ্ছ দৃষ্টি সম্পন্ন, যুক্তিবাদী, উদার ও সংস্কারপন্থী মানুষ ছিলেন| তাঁদের চিন্তাধারা ছিল বাস্তবসম্মত ও প্রগতিশীল| পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন| দেশীয় সমাজ ও সভ্যতাকে তাঁরা ঘৃণার চোখে দেখতেন না| তাঁরা হিন্দুসমাজকে না ভেঙে শুধুমাত্র সমাজের দোষ-ত্রুটি ও কুপ্রথাগুলির অবসান ঘটিয়ে সমাজের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন| এঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রগণ্য| কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের একান্ত সহযোগী ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর|
রামমোহন নিজের চোখে দেখেছেন সহমরণ আর উপলব্ধি করেছেন সহমরণ প্রথার বলি নারীদের মৃত্যু-যন্ত্রণা| পিতার মৃত্যুর আট বছর পর ১৮১১ সালে রামমোহনের বড় ভাই জগমোহনের জীবনাবসানের পরে তাঁর বৌদির সহমরণ তাঁকে সতীদাহ-বিরোধী করে তোলে| জগমোহন তখন এক তরতাজা যুবক| স্ত্রীও যুবতী| যুবতী স্ত্রী স্বামী ছাড়া থাকবে কিভাবে, এই অজুহাতে স্বামীর সাথে তাঁকেও পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়| রামমোহন তাঁর বৌদিকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন| কেউ রামমোহন বা জগমোহনের স্ত্রীর পাশে দাঁড়াননি| বৌদির জ্যান্ত দগ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেবর রামমোহনের মনে গভীর যন্ত্রনার জন্ম দেয়| তখন থেকেই সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার মানসিকতা গড়ে ওঠে| বৌদিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্যটি নন্দকিশোর বসু তাঁর পুত্রের কাছে বর্ণনা করেন| সেই পুত্রের নাম রাজনারায়ণ বসু| তিনি রামমোহনের প্রয়াণের পরে এক স্মরণসভায় পিতার বর্ণিত কথাগুলো তুলে ধরেন|
“চিতানল ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতেছে, সহগামিনী-স্ত্রীর আর্তনাদ যাহাতে কাহারও কর্ণে প্রবিষ্ট না হয়, তজ্জন্য প্রবল উদ্যমে বাদ্যভান্ড বাজিতেছে, সে প্রাণভয়ে চিতা হইতে গাত্রোত্থান করিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু স্বজনেরা বক্ষে বাঁশ দিয়া চাপিয়া রাখিতেছে; এই সকল নির্দয় ও নিষ্ঠুর কান্ড দেখিয়া রামমোহন রায়ের চিত্তে দয়া উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, এবং তদ্বধি তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, যে পর্যন্ত সতীদাহ প্রথা রহিত হয়, সে পর্যন্ত তাহা নিবারণের চেষ্টা হইতে তিনি কখনোই বিরত হইবেন না।”
রামমোহনের চিত্তে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প রচিত হয় ১৮২৫-এর অক্টোবরে| কলকাতায় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে| নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকেও সহমরণে যেতে বাধ্য করা হয়| সেই ঘটনা কলকাতার কিছু সচেতন মানুষ এবং ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করে| এই সময় রামমোহনের অনুসারীরা এর জোরালো প্রতিবাদ করে| তখন বাংলার গভর্ণর ছিলেন, লর্ড আমহার্স্ট | তাঁর স্ত্রী ছিলেন একজন মনস্বিনী এবং সংস্কৃতিমনা| তিনিও এর প্রতিবাদ করেন| জনরোষ এড়াতে এবং একই সাথে ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না হেনে গভর্ণর সতীদাহ প্রথা পুরোপুরি রহিত না করে কৌশলে কিছু নিয়ম চালু করলেন| এক, কোনো সহগমনার্থীনি বিধবাকে স্বামীর দেহের সঙ্গে ছাড়া অন্য কোনোভাবে দগ্ধ করা যাবে না| দুই, সহগমনার্থীনি বিধবাকে সহমরণের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এসে অনুমতি নিতে হবে| অন্যের দ্বারা দরখাস্ত দিয়ে অনুমতি নিলে চলবে না| তিন, কেউ সতীর সহমরণে সহায়তা করলে সরকারি চাকরি পাবে না| চার, সতী হওয়া রমণীর কোনো সম্পত্তি থাকলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করবে|
সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রকাশিত রামমোহনের প্রথম প্রবন্ধ ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ’ (১৮১৮) | সেই লেখায় তিনি সতীদাহের সমর্থক ও সতীদাহের বিরোধী উভয় মত তুলে ধরেন ও যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে সতীদাহ শাস্ত্রসম্মত নয় এবং তাই ধর্মবিরুদ্ধ| একবছর পর প্রকাশ করলেন দ্বিতীয় প্রবন্ধ — ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সংবাদ|’ এইপ্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে হিন্দুসমাজ আলোড়িত হয়েছিল|
রামমোহন রায় ‘কৌমুদী’ গ্রন্থে তাঁর সতীদাহ বিরোধী অবস্থান দৃঢ়তরভাবে ব্যাখ্যা করলেন| সতীদাহ প্রথা খন্ডন করে লিখলেন, ‘শাস্ত্রানুসারে সহমরণ হিন্দুবিধবাদের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য নয়’| সেই লেখাটি ইংরেজমহলেও প্রচারিত হতে থাকল| কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্রাহ্মসমাজে ভাঙ্গন শুরু হয়| যখন রামমোহন রায় সহমরণ রীতি বা সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন, তখন কেউ কেউ ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করেন| তাতে সতীদাহ প্রথা নিয়ে রামমোহনের মুখ বন্ধ করা যায়নি| আসলে শুধু কথা বলা নয়, এই হত্যাপ্রথা বন্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন তিনি| সমাজনেতা রাধাকান্ত দেবসহ কট্টর হিন্দুজোটের তীব্র বাধা সত্ত্বেও তিনি ব্রিটিশ সরকারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন| ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতীদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়| রামমোহনের উদ্যোগে ও লর্ড বেণ্টিকের সহযোগিতায় এই আইন প্রণয়ন সম্ভব হয়|
‘It is hereby declared, that after the promulgation of this regulation, all persons convicted of aiding and abetting in the sacrifice of a Hindu widow by burning or burying her alive, whether the sacrifice be voluntary on her part or not, shall be doomed guilty of culpable homicide and shall be liable to punishment by fine or imprisonment or both by fine and imprisonment.’— Regulation of the 4th December, 1829”.
আইন পাশ হওয়ার পর কট্টর হিন্দুরা থেমে থাকেনি| রামমোহনের যাত্রাভঙ্গ করার জন্য ১৮৩০ সালের ১৭ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ধর্মসভা’ নামে হিন্দু ধর্মের বর্বরতা রক্ষার এক সমিতি| রাজা রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বেশ কিছু গোঁড়া হিন্দু একত্রিত হয়ে সংস্কৃত কলেজে এক সভায় হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য এই সংগঠনের পত্তন করেন| তাঁদের উদ্যোগে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ প্রথা রদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়| ১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল বাংলার গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের ১৮২৯ সালের আদেশ বহাল রাখেন| খুব অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের অন্যান্য কোম্পানি অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করা হয়|
‘আত্মীয় সভা’ (১৮১৫)-র প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রামমোহনের ইংল্যান্ড যাত্রা (১৮৩০) পর্যন্ত রামমোহনের বহু কীর্তির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন দ্বারকানাথ| ‘আত্মীয় সভা’ রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম সংগঠন, যা তিনি ধর্ম-সংস্কারের ও সমাজ সংস্কারের মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলেন| অপৌত্তলিক, একেশ্বরবাদী ধর্মমত প্রচারের জন্য এবং সামাজিক পীড়া দূর করার জন্য রামমোহন চার ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেনঃ (ক) আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক, (খ) বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জ্ঞান বিতরণ, (গ) বই-পুস্তিকা পত্রিকা প্রকাশ এবং (ঘ) সংগঠন গড়ে তোলা | এই সকল কাজে যাঁদের তিনি পাশে পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর অগ্রগণ্য| ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠার পর বহু মানুষ রামমোহনের সহযোগী হয়েছিলেন, কিন্তু মনের মধ্যে গোঁড়ামি থাকার ফলে সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হতেই অনেকেই সংশ্রব ত্যাগ করেছেন| কিন্ত, দ্বারকানাথ কখনও রামমোহনকে ত্যাগ করেননি| ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেনঃ
“দ্বারকানাথ ও রামমোহন, উভয়ের হৃদয়ের তেজস্বিতা ও স্বাধীনতা পরস্পরকে আজীবন আকৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছিল |”
(দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী / ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর / রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় /১৩৭৬)
রামমোহন রায় তাঁর অবিচল মনোভাব নিয়ে স্থির লক্ষ্যে এগিয়েছেন, বিপুল পরিমাণ প্রতিকূলতা ও রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা উপেক্ষা করে| রামমোহনের বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময় ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যদি চারটে প্রধান বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে সেগুলি এরকম (১) সতীদাহ বিরোধী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে তুঙ্গে তুলে ধরা, যার ফলে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে বেন্টিঙ্ক-এর পক্ষে সতীদাহ-বিষয়ক আইন পাস সহজ হয়; (২) অপৌত্তলিক অর্থাৎ নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্মমতকে তুলে ধরা, কোনও নূতন ধর্মপ্রচার নয় বরং মূলত বৈদান্তিক বিশুদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা এবং যার সূত্রপাত ‘আত্মীয় সভা’-র মাধ্যমে ও পরিণতি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় (১৮২৮ খ্রি.); (৩) আধুনিক তথা ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং তার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর চেতনার প্রসার এবং (৪) নারীজাতির সামাজিক অবস্থানের উন্নতি সাধন| এসব ক্ষেত্রে দ্বারকানাথ প্রকৃত বন্ধুর মতো তাঁর পাশে থেকেছেন|
রামমোহনের বাড়িতেই শুধু দ্বারকানাথ নিয়মিত আসতেন এমন নয়, মাঝে মাঝে রামমোহনও যেতেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে| জোড়াসাঁকোর জমিতেই এক নূতন ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর| প্রবীন বয়সে স্মৃতিচারণ করেছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ
“রাজা মধ্যে মধ্যে আমাদের বাটীতে আসিতেন| আমার পিতা রাজাকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন| তিনি অল্প বয়সে দেশে প্রচলিত ধৰ্ম্মে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন; কিন্তু রাজার সহিত আলাপ পরিচয় হওয়াতে প্রচলিত ধৰ্ম্মে তাঁহার অবিশ্বাস হইয়াছিল| কিন্তু রাজা যে ‘ব্রহ্ম’জ্ঞান প্রচার করিয়াছিলেন, তিনি কখনই তাহা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিতে পারেন নাই|”
১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় শুধুমাত্র ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন নয়, ঐ বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বেদান্তভাষ্য’ এবং ‘বেদান্তসার’ | ‘বেদান্তসার’ বইটির ইংরেজি তর্জমা ‘Translation of the Abridgement of the Vedant’ প্রকাশিত হয় ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে| বইটি প্রকাশের পর সমাজে আলোড়ন ওঠে| তারপর পাঁচটি উপনিষৎ তর্জমা ক’রে প্রকাশ| প্রকাশিত হয় তাঁর তার্কিক রচনাঃ উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার (১৮১৬-১৭), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮) | তবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ, সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ (১৮১৮), সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (১৮১৯) এবং সেই পুস্তিকা দু’টির ইংরেজি ভাষান্তর|
রামমোহন ও দ্বারকানাথের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা করার আগে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবন বিষয়ে আলোকপাত করা যাক| উত্তরাধিকার সূত্রে দ্বারকানাথ জমিদার| প্রায় ষোলো বছর বয়সে তিনি জমিদারির কার্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন| কুষ্ঠিয়ার অন্তর্গত বিরাহিমপুর এবং কটকের অন্তর্গত পান্ডুয়া ও বালিয়া| পরে সাহাজাদপুর, কালীগ্রাম ইত্যাদি পরগণা দ্বারকানাথ নিজে কেনেন| জমিদারি পরিচালনা সূত্রে তিনি জমিদারি সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন-কানুন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করে একজন আইনী পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন| সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার মিঃ ফার্গুসনের কাছে আইনের পাঠ নেন| এর ফলে একদিকে তিনি বহু ভূস্বামী ব্যক্তির আইনী উপদেষ্টা হন| অন্যদিকে সরকারী মহলেও পরিচিত হন| এর ফলে ১৮১৮-তে তিনি চব্বিশ পরগণার কালেক্টরের অফিসে সেরেস্তাদার, ১৮২২ এ চব্বিশ পরগণার কালেক্টর ও নিমক মহলের অধ্যক্ষ প্লাউডেনের দেওয়ান নিযুক্ত হন| ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে শুল্ক ও অহিফেন বোর্ডের দেওয়ান হন| এইভাবে জমিদারি ছাড়াও তিনি এইসব কার্যে যুক্ত থেকে প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন|
রামমোহনের সংস্পর্শে আসার ফলে তাঁর আরো উন্নতি হয়| রামমোহনের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম, জে. বি. গর্ডন, জেমস কলডর প্রমুখের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষার তালিম নেন দ্বারকানাথ| ‘ম্যাকিনটস কোম্পানি’র সঙ্গে তাঁর যোগের কথা উল্লেখ করা যাক| এই কোম্পানির অংশীদারগণ ম্যাকিনটস, গর্ডন, কলডর সবাই রামমোহনের বিশেষ পরিচিত| এই কোম্পানির মাধ্যমেই দ্বারকানাথের ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহ বাড়ে| ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই কোম্পানির অংশীদার হন| ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকিনটস কোম্পানি ও তার পরিচালনাধীন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পতন ঘটে| তার আগেই ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’, আর রামমোহনের মৃত্যুর পর, ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ব্যবসা বাণিজ্যে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মে ইস্তফা দেন| আর অনেক আগেই ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে, কিশোর বয়সেই যশোহরের নরেন্দ্রপুরের রামতনু রায়চৌধুরীর সুন্দরী কন্যা দিগম্বরীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল| দ্বারকানাথ-দিগম্বরীর পাঁচ পুত্র হয়, যদিও দু’জন অকালমৃত; বেঁচেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ ও নগেন্দ্রনাথ| ১৮১৫-১৯ অর্থাৎ ‘আত্মীয় সভা’-র আমল থেকে রক্ষণশীল হিন্দুরা রামমোহনের উপর ক্ষিপ্ত| তাঁর নামে কুৎসা রটানো, এমনকি প্রাণনাশের চেষ্টাও হয়েছে| এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনির উল্লেখ করেছেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ
‘আত্মীয় সভা’য় হইত উপনিষদ পাঠ ও সঙ্গীত| যে সকল বন্ধু তাহা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল, জয়কৃষ্ণ সিংহ তাঁহাদের অন্যতম| তিনি বিরোধী সম্প্রদায়ের সহিত যোগদান করিয়া সৰ্ব্বত্র এই মিথ্যা অপবাদ রটনা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন যে, ‘আত্মীয় সভা’-য় গোবৎস হত্যা করা হয়| সেই সময়ে ইহা অনেক লোকেরই সত্য বলিয়া বিশ্বাস হইয়াছিল| আমি পিতামহদেবের (অর্থাৎ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ) নিকট শুনিয়াছি যে তিনি একবার রামমোহন রায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন| তিনি তখন আহারে বসিয়াছিলেন| তাঁহার আহার স্থলে একমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং তৎ-পুত্রদিগের প্রবেশের অধিকার ছিল| তিনি পিতামহদেবকে বলিলেন, “ব্রাদার, এই দেখিতেছ আমি খাইতেছি রুটী ও মধু| কিন্তু এতক্ষণে হয়তো হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছে যে আমি গোমাংস খাইতেছি|’
১৮১৫ থেকে ১৮৩০ এর নভেম্বর পর্যন্ত রামমোহন ও দ্বারকানাথের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ| রামমোহন ও দ্বারকানাথ উভয়েই মনে করতেন, ধর্ম-ভিত্তিক দেশজ শিক্ষা নয়, আধুনিক তথা ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তিত না হলে আমাদের দেশ কখনও আধুনিক জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে না| ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সরকার ১৭৭২ থেকে ১৮১৩ পর্যন্ত এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেয়নি| যেটুকু যা হয়েছে তা খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা| শেষপর্যন্ত বেন্টিঙ্কের আমলে ইংরেজির অনুকূলে বিষয়টির মীমাংসা হয় (১৮৩৫)| এই পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন দ্বারকানাথ উভয়েই ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে সাগ্রহে সমর্থন করেন|
রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর দু’জনেই মনে প্রাণে আধুনিক যুগের উপযোগী শিক্ষা চেয়েছিলেন| প্রকৃত পক্ষে, রামমোহন রায় এবং তার মুষ্টিমেয় সহযোগিবৃন্দ, যাঁদের মধ্যে প্রধান দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁরা শুধু ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের ক্ষেত্রেই নয়, বহু ব্যাপারেই পথিকৃৎ| সেইজন্যই রামমোহনকে ‘ভারতীয় নবজাগরণের জনক’ বা অগ্রদূত আখ্যা দেওয়া হয়| রামমোহন দ্বারকানাথ সম্পর্কেরও গুরুত্ব এইখানেই| একটি ব্যাপারে এই দু’জন চিরস্মরণীয় এবং তা হলো ভারতে মুদ্রিত সংবাদ মাধ্যমের প্রসার, যার সঙ্গে যুক্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা|
রামমোহন এবং দ্বারকানাথ, দু’জনের কেউই কোনও পত্রিকা সম্পাদনা করেননি, কিন্তু জনমত গঠনে পত্রপত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা জানতেন এবং নিজেরাই বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগ নিয়েছিলেন| রামমোহন নিজে তিনটি পত্রিকা বের করেছিলেন– বাংলায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ইংরেজিতে ‘The Brahmanical Magazine’ এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাট-উল্-আখবার’ | সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণকারী Press Ordinance (১৮২৩)-এর প্রতিবাদে রামমোহন ‘মিরাট’ প্রকাশ বন্ধ করে দেন| দ্বারকানাথ বাংলা সাপ্তাহিক ‘বঙ্গদূত’, ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘Bengal Herald’-এর প্রকাশ করা ছাড়াও আর্থিক সাহায্য করেছিলেন ‘Bengal Hurkuru’, ‘India Gazette’ ও ‘The Englishman’ পত্রিকাকে|
এ বিষয়ে মন্টগোমারি মার্টিন লিখেছেনঃ ‘...to no individual is the Indian Press under greater obligation than to the lamented Rammohun Roy and munificent Dwarkanath Tagore.’
(R. Montgomery Martin/ 1834)
আমাদের দেশে মুদ্রিত গণমাধ্যমের সূচনা ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জেমস্ অগাস্টান হিকি-র ‘The Bengal Gazette’ প্রকাশের সময় থেকে| বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্রিকা হলো শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান পাদ্রীদের ‘দিগদর্শন’ (১৮১৮)| তবে, প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেট’, যার সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এবং মালিক হরচন্দ্র রায়, উভয়েই রামমোহনের ঘনিষ্ঠ|
১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২০-২২ পর্যন্ত সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের প্রসার ঘটলেও কোম্পানির সরকার সর্বদা স্বাধীন মতামত প্রকাশ পছন্দ করতেন না| বহু সম্পাদক কিংবা পত্রিকাকে ঐ যুগে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে| কিন্তু অবস্থা চরমে পৌঁছোয় যখন ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল জন এডামস্ এক কুখ্যাত প্রেস অর্ডিনেন্স জারি করে সংবাদপত্রের, বিশেষত দেশীয় মালিকানাধীন পত্রগুলির স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করেন| এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন রামমোহন| তিনি একদিকে সপারিষদ ইংলণ্ডের রাজার কাছে আবেদন পাঠান এবং অন্যদিকে কোলকাতার সুপ্রিম কোর্টের কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করেন| এই স্মারকলিপিটি স্বয়ং রামমোহন রায়ের রচনা এবং এতে রামমোহন ছাড়াও তাঁর পাঁচ সহযোগী স্বাক্ষর করেছিলেন, যার অন্যতম দ্বারকানাথ| সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এই প্রচেষ্টা ভারতীয়দের প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর| সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে সরকারকে পাঠানো স্মারকলিপিটি যুক্তির বিন্যাসে ও ভাষার মাধুর্যে তুলনাহীন| রামমোহনের জীবনী লেখিকা কুমারী কলেট একে ‘Areopagitica of Indian history’ বলে মন্তব্য করেছেন| এছাড়াও দ্বারকানাথকে ভারতে আধুনিক শিল্পবানিজ্যের পথিকৃৎ বলে মনে করা হয়| এ বিষয়ে প্রবন্ধকার শিবশঙ্কর সেনাপতি একটি প্রবন্ধে লিখেছেনঃ ‘ভারতে আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের পথিকৃৎ হলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর যিনি ভারতবর্ষে ইউরোপীয় প্রযুক্তির আমদানি ঘটিয়ে আমাদের মনে লক্ষীর বরপুত্র হিসেবে মুদ্রিত আছেন|’
(ভারতবর্ষে ব্যাঙ্ক-বীমা ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের পথিকৃৎ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর / শিবশঙ্কর সেনাপতি / ইতিহাস দর্পণ / সম্পাদক স্বপন দাস / আগস্ট ২০২০)
সতীদাহ বিরোধী আন্দোলন, ব্রাহ্ম-সমাজ প্রতিষ্ঠা সহ সকল সামাজিক কাজে দ্বারকানাথকে পাশে পেয়েছেন রামমোহন| সতীদাহ নিবারণে সাফল্যের জন্য, ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই নভেম্বর ব্রাহ্মসমাজ হলে নাগরিকদের যে সভা হয় তাতে দ্বারকানাথ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তাদের মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়| সভায় রামমোহনের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়| উত্তরকালে দ্বারকানাথ ইংল্যাণ্ডে গেলে বেন্টিঙ্কের পত্নী তাঁকে এক পত্রে সতীদাহ-বিরোধী আন্দোলনে রামমোহন এবং তাঁর ভূমিকার জন্য সপ্রশংস উল্লেখ করেছিলেন|
এছাড়াও, রামমোহন ও দ্বারকানাথ দু’জনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কারবারের বিপক্ষে এবং অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে সওয়াল করেছেন|
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে নভেম্বর ‘অ্যালবিয়ন’ নামক জাহাজে কোলকাতা থেকে রামমোহন ইংল্যান্ডে রওনা হলে, দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়| কিন্তু তাঁদের পরস্পরের হৃদয়ের বন্ধন শিথিল হয়নি কখনো| ১৮৩৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রামমোহনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকাহত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর| এ বিষয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
“যখন রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুসংবাদ আসিল, তখন আমি আমার পিতার নিকটে ছিলাম| আমার পিতা বালকের ন্যায় ক্রন্দন করিতে লাগিলেন|”
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ইংল্যান্ড যান দ্বারকানাথ ঠাকুর| রামমোহনের সমাধি দেখার উদ্দেশ্যে তিনি ব্রিস্টল গিয়েছিলেন| সেখানে ‘স্টেপেলটন গ্রোভ’-এ রামমোহনের সমাধি মন্দির জীর্ণ অবস্থায় দেখতে পান ও ভারতীয় রীতিতে সেটিকে রমনীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন| দ্বিতীয়বার, ইংল্যান্ড গিয়ে দ্বারকানাথ, রামমোহনের মতোই ইংল্যান্ডে দেহ রাখেন ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট|
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেনঃ
রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুর এই মহাপুরুষদ্বয়ের আবির্ভাবে মধ্যবর্ত্তী কালের দুইটি মধ্যবিন্দু দেখিতে পাই—একটি, স্বাধীনতা-বিস্তার এবং দ্বিতীয়টি শৃঙ্খলা সংস্থাপন। ভারতের, অন্তত বঙ্গদেশের পক্ষে আমরা উভয় মহাপুরুষেরই জীবনে এই দুইটি মূল মন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত দেখিতে পাই। বঙ্গবাসীদিগের উপযোগী স্বাধীনতা বিস্তার ও শৃঙ্খলা-স্থাপনের মন্ত্র ভগবান উভয় মহাপুরুষকেই প্রচুর পরিমাণে দিয়া পাঠাইয়াছিলেন—বঙ্গদেশ তজ্জন্য গৌরবান্বিত হইয়াছে। এই দুই ব্যক্তিই ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের যেন মুখপত্র হইয়া জন্মিয়াছিলেন—ইহারা ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিনিধিস্বরূপ যেন এই দরিদ্র বঙ্গদেশে প্রেরিত হইয়াছিলেন।
(দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী / ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর / রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় / ১৩৭৬)
‘ভারতপথিক রামমোহন রায়’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে
যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে,
যারা অন্যমনা, তারা শোনো,
আপনারে ভুলো না কখনো।
মৃত্যুঞ্জয় যাহাদের প্রাণ,
সব তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দীপ যারা জ্বালে অনির্বাণ,
তাহাদের মাঝে যেন হয়
তোমাদেরি নিত্য পরিচয়।
তাহাদের খর্ব কর যদি
খর্বতার অপমানে বন্দী হয়ে রবে নিরবধি।
তাদের সম্মানে মান নিয়ো
বিশ্বে যারা চিরস্মরণীয়।
—(১৩৪৭)
লেখক - ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী, রাষ্ট্রপতি-পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও রবীন্দ্র গবেষক


