খুন যখন বিনোদন, এ কোন অবক্ষয়ের পথে….!!! লিখছেন ড. গৌতম সরকার

খুন যখন বিনোদন, এ কোন অবক্ষয়ের পথে….!!! লিখছেন ড. গৌতম সরকার
24 Aug 2023, 10:45 AM

খুন যখন বিনোদন, এ কোন অবক্ষয়ের পথে….!!! লিখছেন ড. গৌতম সরকার

 

ড. গৌতম সরকার

  

সন্তান হল বাবা-মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাস, তৃপ্তি-অতৃপ্তি, অনুভব-বিশ্বাস, প্রাপ্তি-দীর্ঘশ্বাস, আনন্দ-অশ্রুজলের সমাহার। এককথায় সন্তানের মধ্যেই বাবা-মায়ের সামগ্রিক বেঁচে থাকা। সন্তানের জন্মের পর সাবেক রুটিন বদলে যাওয়ার আনন্দের সাথে পার্থিব কোনও আনন্দের তুলনা হয়না। একরত্তির সেই হাঁসি, কান্না, খিদে, ঘুম, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, ভালো থাকা, মন্দ থাকার সঙ্গে বাবামায়ের ঘড়ি সময়ের ঘড়িকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের মর্জিতে টিক টিক চলতে থাকে। শুধু জন্মের পরেই কেন, পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পেটের মধ্যে দাপাদাপি, লাথালাথি, যখন-তখন অথেকে খাবার ঘর, বসার ঘর, একচিলতে ঠাকুরঘর পেরিয়ে প্রশস্ত উঠোন। উঠোনের কচি ঘাসগুলোও খোকা-খুকুর ঘ্রাণ চেনে, তাদের গলা পেলেই উত্তেজনায় টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। বাচ্চাগুলোর শৈশব গদের আটার মত আটকে থাকে পাড়ার ভুলি কুকুরের গলার পাটের দড়িগাছিতে, মিত্তিরদের আমবাগানের কুশি আমের ছেঁচকিতে, ছাদের আলসের ছোট্ট অশ্বত্থ চারাটিকে বাবার চোখ এড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রবল চেষ্টায়, তারপর সেই শৈশব আস্তে আস্তে ডানা মেলতে শেখে, পাড়ার স্কুল, খেলার মাঠ, সাইকেলের হাফ প্যাডেল, বন্ধুদের সাথে মারামারি করে  বাড়ি ফেরা, ক্লাবের মাঠে আবৃত্তি করতে করতে আটকে যাওয়া, সহপাঠীদের টিফিন বক্স ছিনতাই, ভুলুকাকুর দোকানের হজমি গুলি আর কানে শুনতে না পাওয়া পান্তবুড়ির পিছনে লাগা ছাড়িয়ে গগন ছুঁয়ে ফেলতে চায়। তাই সন্তান কখন বাবামায়ের ছেলে বা মেয়ের গন্ডি ছাড়িয়ে আপন রীতিতে কারও দাদা, কারোর দিদি, ভাই, বোন, ভাইপো, ভাইঝি, নাতি, নাতনি থেকে বন্ধু, প্রতিবেশী, ছাত্র, সহযোগী, সহপাঠী, সহমর্মী হয়ে ওঠে তার সঠিক হদিশ পাওয়ার আগেই সে এতটাই বড় হয়ে যায় যে মায়ের আঁচল, বাবার নজর ছাড়িয়ে তাকে বৃহত্তর জগতে পা রাখতে হয়। গ্রাম ছেড়ে শহরে, এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে, এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এই পথচলা তো চলতেই থাকে। এই স্রোত এতটাই স্বাভাবিক যে কোথাও কোনও হোঁচট খাবার সম্ভাবনা থাকে না। শুধুমাত্র মায়ের চোখে কারণে-অকারণে জল চলে আসে, সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে সন্তানের শূন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে বাবা দীর্ঘশ্বাস লুকোন।

     পড়াশোনা, চাকরি, বাসাবদলের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরে অপেক্ষায় থাকে বাবা, মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, পরিজন। দিনের শেষে একটা ফোন বা মেসেজ তাদের নিশ্চিন্ত করে, রাতে ঘুমাতে সাহায্য করে। ছুটিতে ছেলেমেয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন বাবা-মায়ের সাত্ত্বিক জীবনযাপনে জোয়ার আসে, বহুদিন পর রান্নাঘরে হাতাখুন্তির যৌথ সরগমে পাশের বাড়িও জেনে যায়, পাড়ার বন্ধুদের আবদার মেটাতে মোড়ের মাথার গোকুলচন্দ্র মিষ্টান্ন ভান্ডারে বেশ কিছু অর্থ গচ্চা যায়, রাস্তার মাঝে মজুমদার বাড়ির বুড়োকর্তার দীর্ঘ বকবকানির হাত থেকে পাড়ার কোনও বন্ধুই পরিত্রাতা হয়ে উদ্ধার করে আনে।

    সন্তান বাবা-মায়ের তো বটেই, তবে কবে যেন বাবা-মা ছাড়িয়ে সেই সন্তানের ওপর দাবি তৈরি হয় ঘরের আঁকিবুকি দেওয়াল, জীর্ণ মলিন স্কুলবক্স, উঠোনের আমলকি চারা, স্কুলের প্রেয়ার হল, নাথুদার চায়ের দোকানের তেলচিটে কাঠের বেঞ্চ, স্কুল বাসের ড্রাইভার কাকু, স্কুলের গেটম্যান জিতেন্দর আঙ্কল যে রোজ হাত ধরে রাস্তা পার করে দিত, সেই আইসক্রিম কাকু পয়সা না থাকলেও মাঝে মাঝে হাতে কাঠি আইসক্রিম গুঁজে দিত সেই সবাইকার৷ তাই তুমি সৌরভই হও কি সুকুমার, লাল, সবুজ, গেরুয়া যাই হও না কেন, দাদা, কাকা, মামা, নেতা, আমির, বিধায়ক, তালেবর, মন্ত্রী যে পরিচয়ই তোমার আধিপত্যের ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠিত করুক না কেন, এতগুলো মানুষ, অমানুষ, অনুভব, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, চেতনা, উপস্থিতিকে তুমি অনাথ করতে পারোনা! সৌরভ তোমরা সবাই শুনে রাখো একটা স্বপ্নদীপের মৃত্যু শুধুমাত্র তার বাবা-মায়ের জীবনের যাবতীয় স্বপ্নের মৃত্যু ঘটায়নি, একটা মানুষের মৃত্যুর সাথে অনেক কিছুর নিভে যাওয়া, ভেসে যাওয়া, শূন্য হয়ে যাওয়া মিশে থাকে। এই মৃত্যুতে চোখের জল, দীর্ঘশ্বাস, কষ্ট, ব্যাথা, যন্ত্রনা, শোক-তাপ, শূন্যতা-বিমর্ষতা, হতাশা-হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গ মিলেমিশে এমন একটা ভীষণ ভয়ংকর আবর্ত সৃষ্টি হতে পারে যার অভিঘাতে তোমাদের মত মেরুদণ্ডহীন হাজার হাজার সৌরভ, সুকুমার স্রেফ উড়ে যাবে। তবুও তোমরা তোমাদের এই নোংরা, ক্লীব অভ্যাস চালিয়ে যাচ্ছ তার মূল কারণ আজ সাধারণ মানুষ নিজ আবর্তের সুখের নীড়ে সুসংবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে, তারা প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে বা প্রতিবাদ চায় না।

     তবু সেই অসংখ্য প্রতিবাদহীন এবং হাতে গোনা প্রতিবাদী কিছু মানুষের তরফে সৌরভ তোমাদের কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। এটা সত্যি মানুষের স্মৃতি বড়ই নাজুক, কিছুদিন পর স্বাভাবিক নিয়মে আমরা স্বপ্নদীপকে হাসতে হাসতে ভুলে যাবো, তবু কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়, যার উত্তর তোমাকে দিতেই হবে। তুমি কি সেদিন মদ্যপ ছিলে? যদি থাকোই মদ তোমাকে এতটাই অমানুষ করে তুলেছিল যাতে করে ছোট ভাইয়ের বয়সের ছেলেটিকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিলে? আইন নিজের বিশ্লেষণে একদিন রায় দেবে এই নিষ্ঠুরতার, হয়তো সেই রায় হবে আত্মহত্যার, কিন্তু দার্জিলিং থেকে কন্যাকুমারিকা দাপিয়ে বেড়ানো সৌরভ, দীপশেখর, মনোতোষদের কাছে জিজ্ঞাসা কোন ক্ষমতার বলে, কিসের দম্ভে, কোন যোগ্যতায় নিজেদের বিকৃত রুচি চরিতার্থতা করতে একটা সতের বছরের বাচ্চাকে মৃত্যু মুখে কুণ্ঠাহীন ঠেলে দিলে? র‍্যাগিংয়ের বলি আজ কোনও নতুন ঘটনা নয়। সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফে রাগিং বন্ধ করার জন্য সংবিধানে বিভিন্ন মনমোহিনী ধারা আছে, কিন্তু গ্রীষ্মের পর বর্ষা, শরৎ, হেমন্তের মত যুগে যুগে রাগিংয়ের বলি হয় সদ্যস্ফুট কুসুমকলির মত বাচ্চাগুলো। আমাদের দেশে যার পরিণতিতে কদিনের লাফালাফি আর বাবা-মায়ের কোলখালি ছাড়া আর কিছুই হয়না। হবেই বা কি! এই সৌরভকে বাঁচাতে তার বাবা-মা, রাজনৈতিক দল, আমলা, আমলাতন্ত্র সবাই উঠে পড়ে লাগে। একটা কথা মনে পড়ে গেল, একদিন কলেজে পরীক্ষা চলছিল, আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে। একটা ঘর থেকে খবর এল, একটি ছেলে অন্য এক পরীক্ষার্থীর খাতা ছিঁড়ে দু-টুকরো করে দিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে জানলাম বারংবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও উত্তর না বলা বা খাতা না দেখানোর কারণে অপর ছাত্রটি এই কান্ড ঘটিয়েছে। তার পরের ঘটনাটিই উল্লেখযোগ্য। পরীক্ষা তখন দুঘন্টা পেরিয়ে গেছে, ছিঁড়ে যাওয়া উত্তরপত্রের ছাত্রটির নতুন করে লেখার সময় নেই, আমরা তিন চারজন শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে সেই উত্তরপত্র মেরামত করার চেষ্টা করছি, তার মধ্যে আমার কাছে বিভিন্ন মহল থেকে মুহুর্মুহু মানুষ আসছে সেই অপরাধী ছাত্রটিকে ক্ষমা করে পুনরায় পরীক্ষায় বসায় অনুমতি দেওয়ার জন্য, কিন্তু ছিঁড়ে যাওয়া উত্তরপত্রের ছেলেটির মানসিক অবস্থার কথা কেউ জিজ্ঞাসা করছেনা। এই ভীষণ ঘটনায় সেই ছেলেটির মনের কি অবস্থা হল, সারাবছর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে আজ এক দুর্বিনীত, অসৎ সহপাঠীর কারণে তার এত বড় ক্ষতি নিয়ে ভাবার কেউ নেই। তাই রাজনীতি কোনোদিনই শিক্ষার উৎকর্ষতা বাড়ায়নি, ছাত্র রাজনীতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার দম্ভ আর দাদাগিরি প্রতিষ্ঠায় একশো শতাংশ সফল। তাই স্বপ্নদীপের মৃত্যু আর সৌরভদের দৌরাত্ম অতীতে যেমন চলছিল, আগামী দিনেও চলবে, চলতেই থাকবে৷

 

লেখক: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজ

 

Mailing List