স্নায়ুর চিকিৎসায় নয়া দিশা দেখিয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জয়, ডেভিড-আর্ডেম এর গবেষণাটি কী?

স্নায়ুর চিকিৎসায় নয়া দিশা দেখিয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জয়, ডেভিড-আর্ডেম এর গবেষণাটি কী?
21 Oct 2021, 11:45 AM

স্নায়ুর চিকিৎসায় নয়া দিশা দেখিয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জয়, ডেভিড-আর্ডেম এর গবেষণাটি কী?

 

ড. গৌতম সরকার

 

মানবদেহ সৃষ্টির এক অভিনব নিদর্শন। এর জটিল কর্মপদ্ধতি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে হওয়ার পিছনে আছে উৎকর্ষ প্রযুক্তি। যুগ যুগ ধরে চিকিৎসক এবং শারীরবিজ্ঞানীরা সেই জটিল মেকানিজমের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার সন্ধানে কালপাত করেছেন। সেই জগতে নবতম সংযোজন হল, তাপমাত্রা এবং স্পর্শের রিসেপ্টর আবিস্কার। যে আবিষ্কারের কারণে ২০২১ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার অৰ্জনের কৃতিত্ব লাভ করেছেন আমেরিকার দুই বিজ্ঞানী- ডেভিড জুলিয়াস এবং আর্ডেম পাটাপুটিয়ান। রিসেপ্টর বা গ্রাহক হল মানবদেহের কোনও অঙ্গ বা কোষ যেগুলো বাহ্যিক উদ্দীপক, যেমন- আলো বা স্পর্শ ইত্যাদিতে সাড়া দেয়। জুলিয়াস ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষক এবং আর্ডেম ক্যালিফোর্নিয়ার 'স্ক্রিপস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউট'-এর সেল বায়োলজিস্ট। সুইডেনের ক্যারোলিঙ্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলির তরফে বলা হয়েছে, ' এই দুই বিজ্ঞানীর গবেষণা চিকিৎসা জগতে এক যুগান্তরকারী আবিষ্কার ঘটাতে সাহায্য করেছে। তাঁদের আবিষ্কৃত রিসেপ্টর, যা একটি দেহকোষ বা শারীরিক অঙ্গের অংশ, তাপমাত্রা, আলো, গরম, ঠান্ডা, যান্ত্রিক শক্তি ইত্যাদির মত বাহ্যিক উদ্দীপকে সাড়া দিতে পারে। যন্ত্রনা, স্পর্শ, ঠান্ডা-গরম, কিংবা শরীরের যাবতীয় উদ্দীপনায় আমাদের ত্বক কলাকোষ থেকে বার্তা কিভাবে মস্তিষ্কে পৌঁছায়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মস্তিষ্কের নির্দেশ কী উপায়ে বা কাদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঙ্গে প্রেরিত হয়, কিভাবে শরীর সেই ভিন্নতর পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়। এই সমস্ত আপাত নিরীহ কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান দিয়েছে জুলিয়াস এবং পাটাপৌসিয়ানের আবিস্কার'। নোবেল কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল থমাস পার্লমান বলেছেন, 'The discovery has profoundly changed our view of how we sense the world around us.'

  

মানুষের শরীর কোন পদ্ধতিতে বস্তুগত জগতের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়, এই প্রশ্নটি যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেন, উত্তাপ এবং চাপ মানুষের শরীরের ত্বকে উপস্থিত বিভিন্ন স্নায়ুকে উদ্দীপিত করতে পারে। কিন্তু কোন আণবিক সংকেত পদ্ধতি অবলম্বনে তাপ, শৈত্য, এবং স্পর্শ ইত্যাদি প্রভাবগুলি স্নায়ু আবেগে পরিণত হয় সেটি জানা ছিলনা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর জুলিয়াস এবং আর্ডেমের আবিষ্কার সেই রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করেছে। নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লাল মরিচের সক্রিয় উপাদান ক্যাপসেইসিন ব্যবহার করে স্নায়ুর উদ্দীপককে চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছেন ( যা ত্বককে তাপমাত্রার পরিবর্তনে সাড়া দিতে সাহায্য করে) ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্বের অধ্যাপক জুলিয়াস। অন্যদিকে দেহকোষে বিভিন্ন ধরণের 'চাপ সংবেদনশীল কোষের' (যেগুলি যান্ত্রিক উন্মাদনায় সাড়া দেয়) সন্ধান পেয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মলিকিউলার বায়োলজিস্ট এবং নিউরো-সায়েন্টিস্ট আর্ডেম পাটাপুটিয়ান।

    

 

মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে স্নায়ু। এর কাজ হল, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণ করা এবং মস্তিষ্কপ্রসূত নির্দেশ অঙ্গ বা কোষে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু কোন মেকানিজম অবলম্বন করে এই বিশাল কর্মকান্ড প্রতিনিয়ত চোখের পলকে ঘটে চলেছে সেটির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা হাজার হাজার বছর ধরে অন্ধকারে ছিলেন। সপ্তদশ শতকে এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিজ্ঞানী রেনে ডেকার্ট। সেই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে বিজ্ঞানীরা স্নায়ুর সন্ধান পান। ধাপে ধাপে চর্চায় জানা যায় বিভিন্ন ধরণের অনুভূতির জন্য বিভিন্ন স্নায়ু কাজ করে। কিন্তু কিভাবে কাজ করে সেই ব্যাপারটি এতদিন পরিষ্কার ছিলনা। এই দুই বিজ্ঞানীর আবিষ্কার দীর্ঘদিনের অনুত্তর প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

   

 

স্নায়ু আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা একমত পোষন করেন যে, স্নায়ুই ঠান্ডা, গরম, স্পর্শ এবং যেকোনো যান্ত্রিক প্রভাবকে জৈব সংকেতে পরিণত করে। এই রূপান্তরকরণ কার্যের জন্য নিশ্চিতরূপে স্নায়ুতে বিভিন্ন ধরণের অণুগ্রাহক উপস্থিত রয়েছে৷ নোবেলজয়ী দুই মার্কিনী বিজ্ঞানী সেই অনুগ্রাহকদের খুঁজে বের করেছেন। বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, স্নায়ুরোগের চিকিৎসা চিরকালই চ্যালেঞ্জিং। জুলিয়াস এবং আর্ডেমের আবিষ্কৃত রিসেপ্টর যদি স্নায়বিক দিক দিয়ে ইতিবাচক সাড়া পায় তাহলে আগামী দিনে পেইনকিলার সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্ভাবনে অবদান রাখবে যা বিভিন্ন রোগের যন্ত্রণার উপশম ঘটাবে।

  

জুলিয়াস তাঁর গবেষণায় সংজ্ঞাবহ নিউরনের cDNA লাইব্রেরি একটি কার্যকরী পর্দায় ফেলে এমন একটা জিনের সন্ধান চালান যেটি লাল মরিচের ক্যাপসেইসিন ব্যবহার হরে আপাতভাবে নিষ্ক্রিয় কোষগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। সেই পর্দায় জুলিয়াস একটি cDNA সঙ্কেতবহ অভিনব 'আয়ন চ্যানেল'-এর ( TRPV1) সন্ধান পান এবং দেখতে পান উত্তাপের মাত্রার বৃদ্ধির সাথে সাথে  ওই চ্যানেল কার্যকরী হয়ে ওঠে। TRPV1 আবিষ্কৃত হবার পর ডেভিড এবং আর্ডেম আলাদাভাবে TRPM8 নামের একটি সংবেদনশীল গ্রাহক আবিষ্কার করেন, যেটি ঠান্ডা অনুভূতিতে সাড়া দেয়। পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু TRPM গ্রাহক আবিষ্কার তাঁদের কাজকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ডেভিডের এই TRPV1 আবিষ্কার স্নায়ু রোগ নির্ধারণ এবং নিরাময় সংক্রান্ত নিত্যনতুন আবিষ্কারের পথ খুলে দেবে।

     

আর্ডেম তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারে একইভাবে একটি কার্যকরী পর্দায় যান্ত্রিক উদ্দীপক দ্বারা প্রভাবিত কোষের মধ্যকার জিনের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি দুটি আয়ন চ্যানেল আবিষ্কার করেন- PIEZO1 এবং PIEZO2, যেগুলো যান্ত্রিক গ্রাহক হিসেবে অভিনব। আর্ডেমের আবিষ্কারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনি প্রমান করেছেন PIEZO2 হল শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মেকানিজম যেটি আমাদের স্পর্শানুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। পরবর্তী গবেষণায় আর্ডেম PIEZO1 এবং PIEZO2-এর আরও অনেক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের সন্ধান পান যেটি তাঁকে রিসেপ্টর আবিষ্কারে সম্যক সাহায্য করেছে।

  

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এই পুরস্কার প্রবর্তন করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেল। তাঁর উইলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি এই পাঁচটি বিভাগে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে 'অর্থনীতি' বিষয়টি এই পাঁচটি ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত হয়। এখনও পর্যন্ত ১১৩ জন চিকিৎসা বিজ্ঞানী পুরস্কৃত হয়েছেন। এই বছর পুরস্কৃত দুই বিজ্ঞানীর আবিষ্কার বহুদিনের অনাবিষ্কৃত এক বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দিয়েছে। প্রতিমুহূর্তে ঘটতে থাকা শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম, আমাদের অনুভূতি, স্পর্শ, চেতনা কিভাবে বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ প্রভাবক দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেই আপাত সহজ অথচ বিজ্ঞানের নিরিখে অতীব কঠিন কর্মপদ্ধতির সঠিক এবং বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণে সাহায্য করবে।

 

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক

Mailing List