বিজয়ার প্রণাম ও নারকেল নাড়ু / গল্প

বিজয়ার প্রণাম ও নারকেল নাড়ু / গল্প
29 Oct 2023, 01:55 PM

বিজয়ার প্রণাম ও নারকেল নাড়ু / গল্প

 

সুমন ঘোষ

 

হৈ হৈ করে ছুটছে একদল বালক। চতুর্থ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিরও দু’একজন সে দলে। হাতে পলিথিন প্যাকেট। এ পাড়া থেকে সে পাড়ার গলি দিয়ে যেতে যেতে একজন বললো, চল, এই বাড়িতে দু’জন বুড়োবুড়ি আছে। প্রণাম করি।

চতুর্থ শ্রেণি বিট্টু চিৎকার করে উঠলো, না। একটা নারকেল সন্দেশও মিলবে না। কেন যাব প্রণাম করতে।

নবম শ্রেণির সলিল তখন বলে উঠলো, চল না। প্রণাম করবো তো। দশমীতে তো এটাই রেওয়াজ। সবাই মিষ্টি দেবে তার মানে কী? তা বলে প্রণাম করবো না!

বিট্টু বলে, দাদা, এখনও পলিথিনের প্যাকেটটা তলায়। হাতে গোনা ক’টি সন্দেশ জমা হয়েছে। তার থেকে চলো ওই পাড়ায় যায়। বাবুদের বাড়িতে শুনেছি এবার বোঁদে এনেছে। সবাইকে বোঁদে দিচ্ছে। এরা নাড়ু করে। এত কিপটে যে, খরচ হবে বলে চিনি গুলে নাড়ু বানায়। নারকেলও দেয় না!

দূর বোকা। নারকেল দেয় না হয়তো। কিন্তু গরিব বলে নয়। দু’জন বুড়োবুড়ি থাকে। ছেলে বাইরে চাকরি করে। টাকা আছে। কিন্তু কে বাজার করে দেবে, কে নারকেল ফাটিয়ে কুরে দেবে, কে বা বানিয়ে দেবে বল তো? তাই পারে না। কিন্তু নাড়ুতে নারকেল থাকে না বলে আশীর্বাদ নিবি না?

অগত্যা সকলেই ঢুকলো। গিয়ে দেখে গিন্নিমা আর বাবু বসে রয়েছেন। পাশে একটা কাঁসার থালা। তাতে সাজানো নারকেল নাড়ু। টপাটপ দু’জনকেই প্রণাম করলো সকলে। গিন্নিমা অভিমান ভরে বললেন, দাদু ভাই, তোমরা বসো না। একটু কথা বলি। কে কার ছেলে একটু বলো তো দেখি।

কথা বলতে বলতেই গিন্নি মা সবাইকে দু’টো করে নাড়ু দিলেন। বিট্টু একটা নাড়ু খেয়ে দেখলো তাতে নারকেলও দেওয়া রয়েছে। একটু অবাক হল।

কথা বলতে বলতে গিন্নি মা বললেন, নারকেল কোরার আর সামর্থ্য নেই। তাই চিনি গলিয়েই নাড়ু করতাম। এবার শরীরটা একটু ভালো। শখ হয়েছিল নারকেলের নাড়ু বানাবো। পাশের বাড়ির পাল বৌমা সব শুনে বললো, গিন্নি মা তোমায় কষ্ট করতে হবে না। আমি নারকেল কুরে দিয়ে যাব। তারপর আমি আর তোমাদের দাদু মিলে নাড়ু বানিয়েছি। কেমন হয়েছে বলো তো দাদুরা?

বিট্টুর রাগ ততক্ষণে মাথা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। বেনে বউদের বাড়ি, ঘোষাল বাড়ি, পাল বাড়িতে যে নানা রকম করে। কেউ কেউ আবার মিষ্টির সঙ্গে ঘুগনিও বানায়। শালপাতার ঠোঙায় দেয় সব। বাকি সব ঘরে তো নারকেল নাড়ু রয়েছেই। কেউ কেউ বোঁদে, কেউ আবার জিলিপিও আনে। তাহলে কেন অকারণ দু’দুটো প্রণাম খরচ করবো? তাও আবার নারকেল বিহীন নাড়ুর জন্য।

এবার নারকেল রয়েছে শুনে রাগ একটু অবশ্য কমেছে বিট্টুর। কিন্তু তর সইছে না। কারণ, প্লাস্টিকের প্যাকেটটা তলানিতে। এই সময়ে দ‌ুমদাম আর পাঁচটা ঘর ঘোরা হত। প্রতি ঘরে অন্তত একটা ঘরে নাড়ু। প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভুড়িটা একটু হলেও বাড়তো। এখানে সময় নষ্ট করলে চলবে কী করে? এরপর ব্যানার্জী পাড়া, তেলি পাড়া, দক্ষিণপাড়া – এখনও সব বাকি। দেখতে দেখতে রাত ৮টা বাজে। বিজয়া দশমীতো কী হয়েছে। রাত ৯টার মধ্যে ঘরে না ঢুকলে বিপদ। বাবার দু’হাত পিঠে পুজোর ঢাক বাজাবে। এত রাত পর্যন্ত বিজয়া ছাড়া আর যে বাইরে থাকার অনুমতি মেলে না। তাও আবার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে।

তা বুঝে অষ্টম শ্রেণির দীপেন বলে বসে, বিট্টু গিন্নিমাকে প্রণাম করিসনি এখনও যে। দুম করে তো নারকেল নাড়ু খেয়ে নিলি।

সূযোগটা গিলে নিল বিট্টু। দুমদাম করে দু’জনকেই প্রণাম করে বললো, আসি গিন্নিমা। পাড়ার সবাইকে প্রমাম করতে হবে তো। নাহলে আবার বাবা-মাকে গিয়ে বলবে। তখন বাবা রাগ করবে।

গিন্নিমাও আর না করেননি। বিট্টুকে আর একবার কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, অনেক বড় হও দাদুভাই। নাও আর দু’টো নাড়ু। মাঝে মাঝে এসো দাদু ভাই।

তারপরই মুহুর্তের মধ্যে ‘চল’ বলে উধাও সকলে। এখনও কম করে ৩০-৪০টা বাড়ি বাকি। যদি একটা করেও নাড়ু দেয়, কিছুটা পেটে বাকিটা পলিথিন প্যাকেটে। এই দিনটাই তো মিষ্টির এত মজা। শ্রদ্ধা-প্রণামের আছিলায় শুধুই মিষ্টিমুখ।

তার মাঝে জ্বালাও কম নেই। বিশেষত, ঘোষবাড়িতে। সবে বিয়ে হয়ে এসেছে দু’টো বউ। বয়স অল্প। পা দু’টো বাড়িয়ে বসে থাকে প্রণাম নেবে বলে। বিরক্ত হলেও করতে হয়। ঘোষবাড়িতে ঢোকার আগে ভাবতে লাগলো বিট্টু। যাই হোক এবার তেমন ঘটনা ঘটেনি। ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, হাতে গোনা তিনজন বয়স্ক মানুষ। প্রণাম শুরু করতেই ঘোষ ঠাকুমা বললেন, এই যে বাবা তোমরা এলে। বৌমারা এখন বাড়িতে নেই। ওরা এই প্রণাম করতে বেরোলো পাশের বাড়িতে। তুতো শ্বশুর-শাশুড়িদের। বিট্টুর মনটা আনন্দে নেচে উঠলো।

ঘোষ ঠাকুমা তখন একটা করে সবাইকে নাড়ু দিয়ে বললো, মিষ্টিমুখ কোরো। এবার বৌমারা ঘুঘনি রান্না করেছিল বটে, কিন্তু কেউ নেই তো। আমার তো বয়স হয়েছে, তাই দিতে পারলাম না বাবা।

সব শুনে সবাই নাড়ু নিয়ে বেরোনোর উপক্রম করছে অমনি বিট্টুকে দেখা গেল, ঘোষ গিন্নির পায়ের ব্যাথা, কোমরের ব্যাথা নিয়ে গল্প করতে। এমনকী, গল্প করতে করতে সিমেন্টের খুঁটির পাশে রাখা আসনে বসে খুঁটিতে হেলানও দিল। বাকিরা দরজার কাছে গিয়েও ভাবতে লাগলো, চলে যাবে নাকি থামবে। সকলে যখন ঈশারা করছে কী করবো তখন দেখা গেল, সদ্য বিবাহিত দুই বৌমা ঘরে ঢুকলো। যে বিট্টু তাদের প্রণাম করতে হবে বলে বিরক্ত হয়ে গা চুলকোতো সে সবার আগে গিয়ে দু’জনকে দুমদাম প্রণাম করে বসলো। হাসতে হাসতে বললো, বৌদি তোমাদের প্রণাম করবো বলেই যাইনি। আশীর্বাদ কোরো।

তারাও গদগদ হয়ে বললো, আরে ঠাকুরপো, বোসো বোসো। তোমাদের জন্য ঘুগনি বানিয়েছি। নারকেল দিয়ে। খেয়ে তারপর যেও।

বিট্টু লজ্জার খাতিরে বলে, না, না বৌদি, থাক। আমাদের আবার অ‌নেক জায়গাতে যেতে হবে। আজকের দিনে প্রণাম না করলে সকলে খারাপ বলবে।

সেকি, খাবে না। এত কষ্ট করে বানিয়েছি। বলেই ছোট বৌদি মুখ ভ্যাংচালো।

বিট্টুর তো তখন থরহরি কম্পমান। যদি একবার বলে বসে, তবে চলে যাও, তখন কী হবে?

বিট্টু তখন তড়িঘড়ি বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে, কই রে তোরা। বৌদিরা যে রাগ করছে। জলদি আয়।

অমনি হুড়মুড়িয়ে বাকিরা ঘরে ঢুকলো দরজার কাছ থেকে। তারপর সাঁটিয়ে খেলো ঘুঘনি। এরপর এগোনোর পালা। এখনও পলিথিনের প্যাকেট অর্ধেক ভর্তি হয়নি। কোথাও এত দেরি করা যাবে না। তাহলেই ক্ষতি। পরেরদিন গেলে বলবে, কাল এলে না কেন? কাল মিষ্টি ছিল। তখন প্রণাম করাটাই লস। মিষ্টিহীন মাথা নিচু করে পায়ে হাত দেওয়া।

বাইরে বেরিয়েই বিট্টু সকলকে নির্দেশ দিল, আর কোথাও দেরি না। এবার ম্যারাথন দৌড়। আজকেই সব বাড়ি ঘুরে প্রণাম শেষ করতেই হবে। সিদ্ধান্ত হল, সবাইকে প্রণাম করা যাবে না। তাহলে সময় নষ্ট। এক একজন এক একজনকে প্রণাম করে মিষ্টির থালার সামনে যে বসে থাকে তার কাছে চলে যেতে হবে। অবশ্যই মিষ্টির থালা যার কাছে, সবাই তাকে প্রণাম করবে। নাহলে কিন্তু মিষ্টি মিলবে না।

এখন বৃদ্ধ বয়সে বিট্টু ভাবে, মিষ্টির থালার সামনে তাঁর স্ত্রী। আর সে ঘরজুড়ে পায়চারি করে। এখন আর সেভাবে কেউ প্রণাম করতে আসে না। যারা আসে, তাঁদের মিষ্টি দিলেও খেতে চায় না। সুগার আছে বলে এড়িয়ে যায়। দুর্গাপুজোর সময় বেড়েছে। চতুর্থী থেকে পুজো শুরু। দশমীর পর কার্নিভাল। শুধু মাঝপথে দশমীর আনন্দটাই কেমন উধাও। নীলকন্ঠ পাখি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রণাম, হাতে পলিথিনের প্যাকেট, নারকেল দেওয়া সন্দেশ পাওয়ার আনন্দ –আর তার স্বাদ মেলে না। যেটুকু সৌজন্য তা কেবলই হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেজে। বড়জোর কেউ কেউ ফোনেই প্রণাম সেরে নেয়। মনটা ভার হয়ে গেল বিট্টুর। কোথায় যে হারিয়ে গেল সেই আনন্দ তা ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে জল চলে এলো তার।

Mailing List