বিছানায় অজান্তে মূত্র ত্যাগেও উপকার মেলে! কালো জামের বহুবিধ উপকারিতা লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

বিছানায় অজান্তে মূত্র ত্যাগেও উপকার মেলে! কালো জামের বহুবিধ উপকারিতা লিখছেন ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
জাম একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। স্বাদে টক-মিষ্টি, মিষ্টি, সামান্য কষা।এর পুষ্টিগুণ অনেক; আমরা অনেকেই জানি না। ফলটি চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের সর্বত্র কম-বেশি পাওয়া যায়।অন্য সব মৌসুমি ফলের তুলনায় জামের স্থায়ীত্বকাল কম।
বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium cumini,
Eugenia cumini (L.) Druce
Eugenia jambolana Lam.
Syzygium jambolanum DC.
ইংরেজি: Java plum, Jambul, Malabar plum,তামিল ভাষায় নাভা পাজহাম, তেলুগু ভাষায় একে বলা হয় নেরেদু পান্ডু, কানাড়া ভাষায় নেরালে হান্নু এবং মালায়ালাম ভাষায় নাভাল পাজহাম।জাম নানা দেশে নানা নামে পরিচিত, যেমন-জামুন, জাম্বুল, জাম্ভুল, জাম্বুলা, জাম্বু, জামব্লাং, জাভা প্লাম, কালো প্লাম, কালোজাম, জাম্বোলান, ড্যামসন প্লাম,পর্তুগিজ প্লাম, ডুহাট প্লাম,জাম্বোলান প্লাম, ইত্যাদি। ফিলিপিন্সে একে ডুহাট বলা হয়।Myrtaceae পরিবারভুক্ত একটি ফল।
জাম ভারতবর্ষের নিজস্ব ফল।ভারতবর্ষ থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে এবং বর্তমানে বিশেষ করে এটি সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে বেশি দেখা যায়।
জাম গাছে মার্চ - এপ্রিলে ফুল আসে। জামের ফুল ছোট এবং হালকা সুবাসযুক্ত। মে - জুন মাসে ফল বড় হয়। ফলটি দেখতে ১ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার লম্বা, প্রায় ডিম্বাকার লম্বাটে।শুরুতে এটি সবুজ রঙের থাকে যা পরে গোলাপী হয় এবং পাকলে কালো বা কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এটি খেলে জিহ্বা বেগুনি হয়ে যায়। সচরাচর কালো হয়, তাই কালো জাম বলি।বর্তমানে থাইল্যান্ড থেকে উচ্চফলনশীল সাদা জাম ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গে কিছু জায়গায় সবে চাষ শুরু হয়েছে।
এই গাছ ১৪ থেকে ৬০ ফুট বা এর বেশিও লম্বা হতে পারে।পাতা সরল,বড়,চামড়া পুরু এবং চকচকে।গাছ চির সবুজ। চকচকে পাতা এবং চিরসবুজ হবার কারণে বেশ সুন্দর দেখায়।
প্রধানত দুটো জাতের জাম পাওয়া যায়। জাতগুলি হলো ক্ষুদি জাত- খুব ছোট হয় এবং বহালি বা মহিষে- বেশ বড় ও মিষ্টি।বীজ ছোটো,শাঁস বা মাংসল অংশ বেশি। এটি বর্ষাকালে পাওয়া যায়।ফলের গা কালো এবং খুব মসৃণ পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা। ফলের খোসার ঠিক নিচ থেকেই গাঢ় গোলাপী রংয়ের টক মিষ্টি শাঁস থাকে।
প্রতি ১০০ গ্রাম পুষ্টিগত মান:
শক্তি ৬০ কিলোক্যালরী, শর্করা ১৫.৫৬ গ্রাম, স্নেহ পদার্থ ০.২৩ গ্রাম, প্রোটিন ০.৭২ গ্রাম, ভিটামিন এ ৩.০ আন্তর্জাতিক একক, থায়ামিন বি১ ০.০০৬ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন বি২ ০.০১২ মিলিগ্রাম, ন্যায়েসেন বি৪ ০.২৬০ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড বি৫ ০.১৬০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.০৩৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৪.৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৯ মিলিগ্রাম, লোহা ০.১৯ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৭৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১৪ মিলিগ্রাম, জল ৮৩.১৩ গ্রাম
জামের উপকারিতা:
বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া এবং চীনে জামের ব্যবহার হয়ে আসছে। হেকিমী, আয়ুর্বেদী এবং ইউনানী চিকিৎসাতেও জাম ব্যবহার করা হয়।জামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, জিংক, কপার, গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ ও ফ্রুকটোজ, ফাইবার,অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও স্যালিসাইলেটসহ অসংখ্য উপাদান। যা স্বাস্থ্যের বিভিন্নভাবে উপকার করে থাকে।
জামের প্রধান ব্যবহার টক মিষ্টি সুস্বাদু ফল খাদ্য হিসেবে।জামের বীজ দিয়ে নানান রোগের আয়ুর্বেদী চিকিৎসা করা হয়, যেমন -বহুমুত্র।জামের বীজ, ছাল ও পাতা হজমের সমস্যা,উচ্চ রক্তচাপ, মাড়ির প্রদাহ ইত্যাদি রোগে ব্যবহৃত হয়। জাম থেকে মদ ও সিরকা তৈরি করা যায়।
দাঁত এবং মাড়ির জন্যেও ভীষণ উপকারি জাম। জামের পাতায় অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল গুণ রয়েছে। এর পাতা শুকিয়ে তা টুথ পাউডারের মধ্যে দিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এর ফলে মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, দাঁতের ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে।
জামে অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল এবং অ্যান্টি ইনফেক্টিভ গুণ রয়েছে। তার সঙ্গে ম্যালিক অ্যাসিড, গ্যালিক অ্যাসিড,অক্সিলিক অ্যাসিড,ট্যানিন রয়েছে। যা শরীরের সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে।
ভিটিমিন C এবং মিনারেলের সঙ্গে ভিটামিন A পাওয়া যায় জামে। যার চোখের জন্য ভীষণ উপকারি।
ডায়াবেটিস নিরাময়ে সাহায্য করে :
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য জাম ভীষণ উপকারী। গবেষণায় জানা যায়, নিয়মিত জাম খাওয়ার ফলে ৬.৫ শতাংশ মানুষের ডায়াবেটিক কমে গেছে। জাম ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে শরীর সুস্থ রাখে। এতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রয়েছে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।ডায়াবিটসের চিকিৎসায় জাম গাছের পাতা এবং গাছের ছাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক চা চামচ জামের বীচির গুঁড়া খালি পেটে প্রতিদিন সকালে খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
হার্ট ভালো রাখে :
জাম রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হার্ট ভাল রাখে।জাম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে।
শরীরের দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমিয়ে দেহের প্রতিটি প্রান্তে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়।
মানসিকভাবে সতেজ রাখে:
জামে গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ ও ফ্রুকটোজ রয়েছে, যা মানুষের কাজ করার সক্ষমতা বাড়ায়।জাম স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ দূর করে :
জামে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি থাকায় ভিটামিন সি-এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া মুখের দুর্গন্ধ রোধ, দাঁত মজবুত, মাড়ি শক্ত এবং মাড়ির ক্ষয়রোধ করে এই ফলে থাকা রস, লবণ ও পটাসিয়ামের মতো উপাদান গরমে শরীর ঠাণ্ডা এবং শারীরিক দুর্বলতাকে দূর করতে সাহায্য করে। জামে থাকা প্রচুর পরিমাণ আয়রন রক্তস্বল্পতা দূর করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করে :
জামে কম পরিমাণে ক্যালোরি থাকে। তাই যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা খাদ্য তালিকায় জাম রাখতে পারেন ক্যান্সার প্রতিরোধে উপকারী :
জাম মুখের ভেতর উৎপাদিত ক্যান্সারের সহায়ক ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব থেকে দেহকে রক্ষা করে মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রঙিন ফলের ভেতর যে পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে, এর মধ্যে জামে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যৌগিক উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে।জাম লড়াই করে জরায়ু, ডিম্বাশয় ও মলদ্বারের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে।
সাদা বা রক্ত আমাশয়:
জামের কচি পাতার রস ২-৩ চা-চামচ একটু গরম করে ছেঁকে নিয়ে খেলে ২-৩ দিনের মধ্যে সেরে যায় সাদা বা রক্ত আমাশয়।
অরুচি ও বমিভাব :
পাকা জাম লবণ মাখিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা রেখে, সেটা চটকে পুঁটলি বেঁধে টানিয়ে রাখলে যে রস ঝরে পড়বে, সেটা ২০-২৫ ফোঁটা প্রয়োজনবোধে এক চা চামচ পানি মিশিয়ে খেতে দিলে পাতলা দাস্ত, অরুচি ও বমিভাব কমে যায়।
বিছানায় প্রস্রাব :
শিশু-বৃদ্ধ অনেকেই বিছানায় অজান্তে মূত্র ত্যাগ করে ফেলে। ফলে বৃদ্ধরা অসুবিধায় পড়েন এবং সন্তানের জন্য মায়েদের অসুবিধায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে ২-৩ চা চামচ জাম পাতার রস (বয়স অনুপাতে মাত্রা) ১/২ চা চামচ গাওয়া ঘি মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খাওয়ালে এক সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপকার হবে।
জ্বরের সঙ্গে পেটের দোষ :
যাদের জ্বরের সঙ্গে পেটের দোষ থাকে, তারা এ পাতার রস ২-৩ চা-চামচ একটু গরম করে ছেঁকে খেলে উপকার হয়।
এছাড়া জামে রয়েছে ফাইটো কেমিক্যালস আর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, এবং সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি দেয়। প্রতিরোধ করে ইনফেকশনের মতো সমস্যাও। জামে পাওয়া গেছে অ্যালার্জিক নামে এক ধরনের এসিডের উপস্থিতি, যা ত্বককে করে শক্তিশালী। ক্ষতিকর আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মির প্রভাব থেকে ত্বক ও চুলকে রক্ষা করে।এর অ্যালার্জিক এসিড ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
আধাপাকা (ডাঁসা) জাম খাওয়া উচিত নয়।খালি পেটে জাম উচিৎ নয় এবং জাম খাওয়ার পর দুধ খাওয়া উচিৎ নয়। মৌসুমি ফল খান সুস্থ থাকুন।
লেখক: উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
................


