তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল! অর্থনীতির ভাষায় 'ডেড ওয়েট লস'

তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল! অর্থনীতির ভাষায় 'ডেড ওয়েট লস'
ড. গৌতম সরকার
‘Never think that war, no matter how necessary, nor how justified, is not a crime.’
গত বছরের জুলাই মাস থেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কণ্ঠে যুদ্ধের সুর শোনা যাচ্ছিল। তাঁর মূল অভিযোগ ছিল, ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মদতে রুশ বিরোধী কাজকর্ম করে চলেছে। বারংবার সতর্ক করেও কোনও সমাধান হচ্ছে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোর ৫:৫৫ মিনিটে পুতিন ইউক্রেনের বুকে তাঁদের 'সামরিক অভিযান'-এর কথা ঘোষণা করলেন।
আর ঠিক আগেরদিন অর্থাৎ বুধবার রাতে আমেরিকায় ইউক্রেনের সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তৃতীয় জরুরি বৈঠক বসেছিল। আলোচনা শেষে রাষ্ট্রসংঘের প্রধান পুতিনকে ধ্বংসের রাস্তা ছেড়ে শান্তিপূর্ণ বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আবেদন জানান। দুর্ভাগ্যবশত সেই আবেদনে কর্ণপাত করেননি পুতিন। যুদ্ধই তাঁর কাছে সমস্যা মোকাবিলার একমাত্র পথ বলে মনে হয়েছে।
ভাবতে অবাক লাগে গ্লোবালাইজেশনের যুগে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-প্রযুক্তি, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ক্রমশ কাছাকাছি হচ্ছে, পৃথিবী আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে 'গ্লোবাল ভিলেজ'-এর তকমা পাচ্ছে, তখন আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ কখনও কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যুদ্ধ হল মধ্যযুগের বর্বরোচিত শাসনের প্রধান অস্ত্র যখন দখল এবং সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন ছিল দেশের উন্নয়ন ও প্রসারণের মূল চাবিকাঠি। যুদ্ধ মূলত একটি শক্তিশালী এবং দূর্বল দেশের মধ্যে সংঘটিত হয়। প্রবল দেশের শক্তির আঘাতে দূর্বল দেশটি ছারখার হয়ে যাওয়ার আগে সামরিক ক্ষমতার সাথে সাথে তীব্র মনের জোর এবং দেশপ্রেম যোগ করে প্রবলতর প্রতিপক্ষেরও যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে থাকে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হওয়ার মুখে ইউক্রেন অর্থনীতি, তার মধ্যেই ইউক্রেনের দাবি প্রথম পাঁচদিনের যুদ্ধে তারা প্রায় চার হাজার রুশ সেনাকে হত্যা করেছে, এর সাথে ১৪৬ টি ট্যাঙ্ক, ২৭টি যুদ্ধবিমান, ২৬টি হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে।
এটা সত্যি ইউক্রেনের প্রবল প্রতিরোধে রাশিয়া এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেনের দুটো শহর ছাড়া আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করতে পারেনি। তাই বলতে হয়, যুদ্ধ রাশিয়ার উদ্দেশ্য কতটা সফল করতে পারবে সে কথা ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যুদ্ধ দুটি দেশের অর্থ, প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদের যে ক্ষতিসাধন করছে, সেটিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় 'ডেড ওয়েট লস', যেটি কোনোভাবেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাই আলোচনার শেষে এই বাক্যটাই স্মরণে আসে, "Two armies that fight each other is like one large army that commits suicide."
"The two most powerful warriors are patience and time."
Leo Tolstoy
রাশিয়ার মূল ক্ষোভের জায়গা হল পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপ। শুরুতে তারা আক্রমণ চালায় রুশভাষী এলাকা ডনবাসে। তারপর আস্তে আস্তে ক্রিমিয়া, ওডেসা, বেলারুশ সংলগ্ন উত্তর ইউক্রেন রুশ সৈন্যবাহিনীর আক্রমনের আওতায় চলে আসে। রুশ সৈন্যবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রসামগ্রী নিয়ে অতি সহজেই ঢুকে পড়ছে পূর্বের ক্রামোতোস্ক থেকে শুরু করে পশ্চিমের লুৎস্ক, উত্তরের চেরনিহিভ আর দক্ষিণের খেরসন। এর মধ্যে রাজধানী শহর কিয়েভও অনেকটাই রুশদের দখলে চলে এসেছে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই পরমাণু অস্ত্র আর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের ভয়ে কাঁপছে রাজধানী শহরের ২৫ লক্ষ মানুষ।
রাষ্ট্রসংঘের অনুরোধ অস্বীকার করে রাশিয়ার এই যুদ্ধ ঘোষণা একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি পশ্চিমী দেশগুলো। ফলে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে রাশিয়ার উপর। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাশিয়াকে বেপরোয়া দেখাচ্ছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে রাশিয়ার আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া ইউরোপের আকাশসীমায় রাশিয়ার বিমান চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সামনাসামনি ইউক্রেনের পাশে অস্ত্র হাতে না দাঁড়ালেও পশ্চিমী দেশগুলো ভিতরে ভিতরে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে, এ ব্যাপারে রাশিয়া নিশ্চিত। আর এটাই রাশিয়াকে আরও মরিয়া করে তুলেছে। সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার হল, ভ্লাদিমির পুতিন ইতিমধ্যেই তাঁর দেশের পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রক পর্ষদকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়া হল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরমাণু অস্ত্রসম্ভার সম্পন্ন দেশ। তাদের দখলে আছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিপুল সম্ভার। পরমাণু যুদ্ধ একবার শুরু হলে কে শত্রু আর কে মিত্র, কে বড়লোক কে গরীব, কে ক্ষমতাবান কে ফকির, মৃত্যুর কাছে কোনও ভেদাভেদই থাকবে না। তখন কারোর জন্য শোক করারও কেউ থাকবে না। কথায় আছে- 'Only dead have seen the end of war'.
"The more you sweat in peace, the less you bleed in war."---
Norman Schwarzkopf
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত নতুন কিছু নয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সেইসময় মস্কো থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় ইউক্রেন। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরির মতো ইউরোপের আরও অনেক দেশ রাশিয়ার সঙ্গ ত্যাগ করে ন্যাটোর সাথে হাত মেলায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সাম্যবাদী রাশিয়াকে প্রতিহত করতে আমেরিকার নেতৃত্বে তার অনুগামী দেশগুলোকে নিয়ে একটি সামরিক জোট 'উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা' বা 'ন্যাটো' গড়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়, যেটি রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। পুতিনের মতে, রাশিয়া আর ইউক্রেন এক জাতি। দুই দেশের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। ইউক্রেনের প্রচুর মানুষ রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ইউক্রেনের বর্তমান সরকার পশ্চিমী দেশগুলোর সাথে হাত মেলাতে চায় এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধাচারী ন্যাটো-য় যোগ দিতে চায়। এটি কোনোভাবেই তাঁর দেশের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই যুদ্ধ শুরু। গত কয়েকদিনে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ইউক্রেনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কখনও শোনা গেছে রাজধানী শহর কিয়েভের দখল নিয়েছে রুশ সেনা, কখনও খবর এসেছে ইউক্রেনীয়রা শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছে। তবে এটা সত্য যুদ্ধ যত এগিয়েছে রাশিয়ার উপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। মুখে স্বীকার না করলেও সেই চাপের কারণেই ইউক্রেনের সাথে শান্তিবৈঠকে বসতে রাজি হয়েছে পুতিনের সরকার। রুশ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন, ইউক্রেনের সাথে শান্তি আলোচনা করতে বেলারুশে পৌঁছে গিয়েছে তাঁর প্রতিনিধি দল। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির দাবি, তিনি কথা বলতে পারেন, তবে সেটা কখনোই রাশিয়ার মিত্রদেশ বেলারুশে নয়। তিনি কোনও নিরপেক্ষ দেশে আলোচনা স্থল করার আর্জি জানিয়েছেন। ঠিক তারপরই রাশিয়ার পরমাণু পর্ষদ নড়েচড়ে বসার কারণে বেলারুশেই শান্তি আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন জেলেনস্কি। যদিও দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা শান্তি বৈঠকের কোনও সুপ্রভাব চোখে পড়ছে না। কারণ যুদ্ধ নিজের মতো হয়ে চলেছে, তার সাথে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে ধ্বংস, মৃত্যু ও হাহাকার। বৈঠকে ইউক্রেনের দাবি ছিল, শুধু ইউক্রেনের অন্য অঞ্চল থেকেই নয়, রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া এবং ডনবাস থেকেও সমস্ত সেনাবাহিনী ও যুদ্ধসরঞ্জাম সরাতে হবে। তবে বৈঠক শেষে রাশিয়া কী চাইছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
"Know thyself know the enemy. A thousand battles a thousand victories."----
Sun Tzu
শুধু বাইরে নয়, ঘরেও সমালোচনার শিকার পুতিন। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের সই সহ যুদ্ধবিরোধী পিটিশন জমা পড়েছে প্রেসিডেন্টের দপ্তরে। এই পরিস্থিতিতে মস্কোও ভিতরে ভিতরে চাইছে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় এই যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিও কম কিছু হচ্ছে না। অন্যদিকে প্রায় গোটা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে জারি হওয়া আর্থিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞায় রুশ অর্থনীতি ধুঁকতে শুরু করেছে। পুতিন এটিকে পশ্চিমী বিশ্বের 'অবন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ' বলে অভিমান করলেও এর সরাসরি প্রভাব রাশিয়া খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। তাই আগামী দিনগুলোয় রাশিয়া কী করে সেদিকে নজর রেখেই গোটা বিশ্ব উদগ্রীব অপেক্ষা করছে।
এই যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। ভারত ন্যাটোর সদস্য নয়, তাই রাশিয়ার সাথে ভারতের সামনাসামনি কোনও শত্রুতা নেই। তবু চিন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক এই মুহূর্তে ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ বলা যাবে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেরদিনই, অর্থাৎ গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুদ্ধ বন্ধ করার আর্জি জানিয়ে পুতিনের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জের রাশিয়া বিরোধি প্রস্তাবে ভোটদান থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে ভারত। এখানে আবেগের চেয়ে কূটনীতিকেই প্রাধান্য দিয়েছে ভারত সরকার, যদিও এই কার্যকারণের আন্তর্জাতিক প্রভাব কি পড়বে তা সময়ই বলবে।
“War does not determine who is right, only who is left.”
Bertrand Russell.
যুদ্ধ কোনও সমস্যার সমাধান নয়, যুদ্ধ হল সমস্যার শুরু। এই বোধে যতদিন না আপামর মানবজাতির প্রতীতি ঘটছে ততদিন যুদ্ধের নামে গ্রহ জুড়ে চলবে ক্ষমতাহীনের উপর ক্ষমতাধরের দাদাগিরি ও অত্যাচার। এর ফলে কেউ ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হচ্ছে কিনা সেটা গৌণ, কিন্তু বিশ্বের সামগ্রিক সম্পদ এবং উন্নয়নের অবক্ষয় ঘটছে সেকথাটি নিঃসংকোচে বলা যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই 'গ্লোবাল ভিলেজ' শব্দবন্ধটি খুব ক্লিশে শোনায়। আসল কথা আমরা যত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তিতে সচ্ছল হচ্ছি তত বেশি এই গ্রহকে মনুষ্য বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলছি। এই সংকট এতটাই তীব্র যে আগামীকাল কী ঘটতে চলেছে আমরা কেউ জানিনা।
" I know not with what weapon World War III will be fought but World War IV will be fought with sticks and stones.” Albert Einstein.
বিপ্রতীপে পথচলা শুরু হয়ে গেছে, প্রস্তরযুগে প্রত্যাবর্তন শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ ………..xxxxx…………


