দুই তীর্থভূমিঃ কামারপুকুর ও জয়রামবাটি

দুই তীর্থভূমিঃ কামারপুকুর ও জয়রামবাটি
সুদর্শন নন্দী
কলকাতা থেকে ১০৪ কিলোমিটার দূরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পূণ্য জন্মভূমি কামারপুকুর এবং তাঁর সুযোগ্য সহধর্মীণী আমাদের সকলের মা সারদাদেবীর আবির্ভাবক্ষেত্র জয়রামবাটি। কলকাতা থেকে বিষ্ণপুর বাঁকুড়াগামী প্রায় সব বাসই এই দুটি তীর্থস্থানের উপর দিয়ে আসে। আর ট্রেনও পোঁছে গোছে আরামবাগ পর্যন্ত। সেখান থেকে এই দুটি স্থান ঢিল ছোড়া দূরত্বে। তবে তারকেশ্বর বিষ্ণুপুর লাইনটি সম্পূর্ণ হলে পুরো রাস্তাটি ট্রেনে আসা সম্ভব। কলকাতার জ্যাম নিয়ে একটু বেশি সময় ধরলে চারঘন্টার মধ্যাই পৌঁছে যাবেন হুগলি জেলার কামারপুকুর। আর এরপর আরও ছ কিলোমিটার গেলে বদলে যাবে জেলা। পড়বে বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি।
কী দেখবেন কামারপুকুরে এসে? পাকা ঘরবাড়ি, পিচরাস্তা, শহুরে দোকান বাজার থাকলেও গ্রামীণতা কামারপুকুরের মজ্জায় এখনও। ফলে পাবেন গ্রামের স্বাদ। আর যে জন্য যাওয়া। আধ্যাত্মিক নবজাগরণের রূপকার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মভিটে এই কামারপুকুরে। সেই জন্মভিটে ঘিরে এবং তখনকার কাঁচাবাড়ি ও খড়ের চাল অক্ষত রেখে গড়ে উঠেছে বেলড় মঠের অধীনে কামারপুকুর শাখার রামকৃষ্ণ মঠ। আমরা অনেকেই জানি কামারপুকুর কিন্তু ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে নয়। ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে কামারপুকুরের অদূরে দেরে গ্রামে। সেখানে জমিদারদের অত্যাচারে সব খুইয়ে পিতা ক্ষুদিরাম বন্ধুবর সুখলাল গোস্বামীর আমন্ত্রণে কামারপুকুরে আসেন। কামারপুকুরে সুখলাল নিজের বাড়ির উত্তরে জমি দান করেন ক্ষুদিরামকে বাড়ি তৈরি করার জন্য। সেই থেকে কামারপুকুর হয়ে ওঠে ক্ষুদিরামের আপন গ্রাম। হুগলি, অবিভক্ত মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার সংযোগস্থল এই কামারপুকুর। এখানেই আবির্ভাব গদাধরের। যিনি পরবর্তীকালে তার লীলাক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বর থেকে বিশ্বকে জানাবেন ধর্ম ঈশ্বর প্রভৃতি শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ। ঠাকুরের জন্মস্থান ঢেঁকিশালে নির্মিত হয়েছে সুদৃশ্য মন্দির। খড়ের শোবার ঘরটি ও বৈঠকখানা খড়ের চাল ও মাটির দেওয়ালেরই রয়েছে। ঠাকুরের নিজের হাতে লাগানো আমগাছটি এখন বিশাল শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে ঠাকুরের পূণ্যস্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রসঙ্গতঃ জানাই, ১৯৪৭ এর মার্চ মাসে ঠাকুরের পৈতৃক বাসভবন সহ ৪৫ বিঘা জমি রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে আসে এবং পরের মাসে তারা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখা খোলেন।
কামারপুকুরে মূল দ্রষ্টব্য এই মঠের চৌহদ্দির মধ্যে ঠাকুরের বাসভবন, আমগাছ, জন্মস্থানের উপর নির্মিত মন্দির দেখা। মন্দিরে রয়েছে ঠাকুরের শ্বেতপাথরের মূর্তি। জন্মস্থানের পশ্চিমে রয়েছে কুলদেবতা রঘুবীরের মন্দির। মন্দিরে রঘুবীর শিলা, রামেশ্বর শিবলিঙ্গ ও শীতলার ঘট রয়েছে। নিত্যপূজা হয় এই মন্দিরে। ঠাকুরের ঘরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে নাটমন্দির। এখানেই পিতা ক্ষুদিরামের বন্ধু সুখলালের বসতবাটি ছিল। মঠের মূল গেটে রয়েছে যুগীদের শিবমন্দির। কথিত এই মন্দিরের সামনে ঠাকুরের মা চন্দ্রাবতীদেবী একদিন দাঁড়িয়েছিলেন। তখন এই শিবলিঙ্গ থেকে জ্যোতির্তরঙ্গ তাঁর দেহে প্রবেশ করে। এবং এই শক্তি থেকেই ঠাকুরের জন্মলাভ। এ ছাড়া মঠের পুস্তক স্টলটি ঘুরে নিতে পারেন। রয়েছে রামকৃষ্ণ সাহিত্যের বিপুল পুস্তকের সমাহার। আর দুপুরে প্রসাদ (অন্নভোগ) পেতে সকালে গিয়েই কেটে নিন কুপন। মঠ থেকে বেরিয়ে এসে দেখুন হালদারপুকুর, লাহাবাবুদের পাঠশালা, চিনু শাঁখারির ঘর, ধনী কামরানীর ঘর প্রভৃতি। চাইলে রিক্সা করতে পারেন, নইলে মঠের গেটে অপেক্ষারত গাইডদের পঞ্চাশ একশ টাকা দিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরে নিতে পারেন। কামারপুকুর ভ্রমণের শেষে গ্রামের নামকরণ নিয়ে জানতে পারলাম যে এখানকার আগে নাম ছিল সুখলালগঞ্জ। কোনও এক রাজা অস্ত্র বানাতে প্রচুর কামার নিয়ে আসেন এখানে। পরে তাদের হাতে তৈরি হয় একাধিক পুকুর। সেই থেকেই সুখলালগঞ্জ পরিবর্তিত হয় কামারপুকুর নামে। যাই হোক কামারপুকুর আজ ঠাকুরের ভক্তমন্ডলী ছাড়াও অগণিত মানুষের তীর্থস্থান।
এবার আমরা যাব এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ঠাকুরের সহধর্মীণী আমাদের সবার মা সারদাদেবীর জন্মস্থান জয়রামবাটিতে। মা ছিলেন ঠাকুরের যাবতীয় সাধনা ও সিদ্ধির মূল উৎস। ছিলেন ভারতীয় নারীত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। আজ তিনি বিশ্বজননীও। বাঁকুড়া জেলায় পড়ছে জয়রামবাটি। ১৮৫৩ সালের ২২ শে ডিসেম্বর এই মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেন মা। মায়ের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছে মন্দির। ১৮৫৯ সালের মে মাসে এখানে ঠাকুরের সাথে মায়ের বিয়ে হয়। ঠাকুর জয়রামবাটিতে কয়েকবার এসেছেন। জয়রামবাটিতে দেখুন মায়ের মন্দির, মায়ের পুরানো বাড়ি। মাতৃমন্দির ঢুকতেই ডানদিকে দেখুন মায়ের নতুন বাড়ি। দেখুন মায়ের ব্যবহৃত পুকুরটি। মাতৃমন্দির থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের গলিতে ঢুকে সোজা পৌঁছে যান সিংহবাহিনী মন্দিরে। এখানে মা অনেক সময় আসতেন। এখানকার মাটির গুণে তাঁর পেটের রোগ সেরে যেত। আজও ভক্তরা এখান থেকে মাটি নিয়ে যান ভক্তি সহকারে। চাইলে এখানেও অন্নপ্রসাদ খেতে পারবেন কুপন কেটে। কুপন দেওয়া হয় সকাল নটা থেকে পৌনে এগারটা পর্যন্ত। হলের ভেতর টেবিলে বসিয়েই খাওয়ানো হয় প্রসাদ। থাকতে চাইলে মাতৃমন্দিরের অতিথি নিবাস আগে থেকে বুক করে আসতে পারেন। হাতে একদিন সময় থাকলে এখান থেকে এক ঘন্টার রাস্তা মন্দিরের দেশ তথা মল্লরাজাদের একদা রাজধানী বিষ্ণুপুরও ঘুরে আসতে পারেন। যেতে যেতে নিতে পারবেন জয়পুর জঙ্গলের স্বাদও।
যাওয়া-আসাঃ কলকাতা থেকে কামারপুকুর জয়রামবাটি যাবার অনেক বাস রয়েছে। প্রায় চারঘন্টা সময় নেয়। প্রথমে কামারপুকুরে নামুন। সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে আবার বাসে চেপে গিয়ে দেখে নিন জয়রামবাটি। জয়রামবাটি থেকে সোজা ফিরুন কলকাতা। ট্রেনে এলে আরামবাগে নেমে বাসে আধঘন্টার রাস্তা কামারপুকুর। যারা দক্ষিণবঙ্গ বা বাঁকুড়ার দিক থেকে আসবেন তারা বিষ্ণুপুর বা বর্ধমান হয়ে আসতে পারেন।
থাকা-খাওয়াঃ বেশিরভাগ পর্যটকই দিনের দিনই ফিরে যান। থাকার জন্য কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মঠে যোগাযোগ করতে পারেন। ফোনঃ ০৩২১১-২৪৪২২১
জয়রামবাটি মাতৃমন্দিরেও থাকতে পারেন। ফোনঃ ০৩২১১-২৪৪২১৪
খাবার হোটেল থাকলেও বেশির ভাগ পর্যটক কামারপুকুর বা জয়রামবাটিতে অন্নভোগ গ্রহণ করেন। এই প্রসাদও ভক্তদের খাছে বড়ই আনন্দের।
***********


