থাইল্যান্ড ভ্রমণ: বার্ড-এলিফ্যান্ট শো থেকে জু সাফারি অসাধারণ অভিজ্ঞতা / প্রথম পর্ব

থাইল্যান্ড ভ্রমণ: বার্ড-এলিফ্যান্ট শো থেকে জু সাফারি অসাধারণ অভিজ্ঞতা / প্রথম পর্ব
05 Feb 2023, 01:00 PM

বার্ড-এলিফ্যান্ট শো থেকে জু সাফারি, রমণীয় থাইল্যান্ড

ড. গৌতম সরকার

মধ্যবিত্ত বাঙালীদের বিদেশ ভ্রমণ আইটিনেরারিতে থাইল্যান্ড বেশ ওপরের দিকে থাকে। কারণ হিসেবে অবশ্যই 'কম খরচে বিদেশ সফর' ব্যাপারটা প্রাধান্য পাবে। তবে ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আসা বাঙালীরা এই থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বাঙালীর ভ্রমণকে 'দীপুদা' বলে ঠাট্টা করে। করুক ঠাট্টা!!আমি আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণে থাইল্যান্ডকেই বেছে নিলাম এবং প্রায় দশ রাত্রি এবং এগারো দিনের সফরে আমার প্রতি মুহূর্তে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল এত ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। প্রথমবার দেশের বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি তাই এই ট্যুরের প্ল্যানিংটা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই শুরু করেছিলাম। দেশের মধ্যে যতটুকু ঘুরেছি, নিজেদের ব্যাবস্থাপনাতেই ঘুরেছি, ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নিইনি। আসলে নিজে নিজে বেড়ানোর জায়গা বাছা, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট কাটা, হোটেল বুকিং, গাড়ি ঠিক করা সবকিছুর মধ্যে একটা মজা আছে। অর্থাৎ বেরিয়ে পড়ার অনেক আগেই জায়গাটি আপনি অনুভবে ছুঁতে পারবেন, সেটা একটা দারুন অনুভূতি। এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেড়াতে গেলেও সিংহভাগ কাজ করতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু এই বিদেশ-বিভূঁই সফরে সবকিছু নিজে করা কি ঠিক হবে! একটু ধন্দে ছিলাম। আমার স্ত্রীরও একটু টেনশন ছিল। দুজন মিলে বিদেশে গিয়ে কোনো বিপদে না পড়ি! আমার কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল, আরে দেশটা তো একেবারে হাতের কাছে, ফ্লাইটে দিল্লি যেতে যা সময় লাগে, ব্যাংকক পৌঁছতেও ঠিক একই সময়, ওই আড়াই ঘণ্টা। সেইমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম।

রয়্যাল প্যালেসের প্রবেশদ্বার

ধাপে ধাপে  প্রয়োজনীয় কাজগুলো সারলাম: প্রথমেই গেলাম বাড়ির কাছে কসবা Acropolis র ঠিক পাশের বিল্ডিং Rene Tower এ ভিসা অফিস। ওখান থেকে ভিসা ফর্ম নিয়ে, যাবতীয় তথ্য ভরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সমেত জমা দিয়ে দিলাম। অফিস থেকে জানাল তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ভিসা বাড়িতে পৌঁছে যাবে। ভিসার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ফ্লাইট বুক করে ফেললাম। আমাদের যাতায়াত বাদ দিয়ে দশ রাত্রির ট্যুরে ব্যাংকক, ক্র্যাবি, ফুকেট আর পাট্টায়া ঘুরবো। সেইমতো ব্যাংকক আসা-যাওয়া, ব্যাংকক থেকে ক্র্যাবি, আর ফুকেট থেকে ব্যাংককের টিকিট কেটে নিলাম। তারপর করে নিলাম এই চারটে জায়গার হোটেলে বুকিং। হোটেল বুকিং করতে কিন্তু বেশ ধৈর্য্য লাগবে। যেহেতু অনলাইন বুকিং- আপনাকে আপনার বাজেট অনুযায়ী হোটেল খুঁজে, খুব ভালো করে রিভিউ পড়ে বুক করতে হবে। এতকিছু করেও ফুকেটে আমরা কিন্তু মনের মতো হোটেল পাইনি। তাই এটা একটু সময় নিয়ে করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই হল ভ্রমণের গৌরচন্দ্রিকা, অর্থাৎ বেরোনোর আগে আপনাকে কি কি ঠিকঠাক ভাবে করতে হবে। তারপর একটা কাজই বাকি থাকে-দূর্গা দূর্গা বলে বেরিয়ে পড়া।

রয়্যাল প্যালেস

২৫শে ডিসেম্বর, ২০১৯র ভারতীয় সময় রাত চারটেয় আর থাইল্যান্ডের সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় (দেড় ঘন্টা এগিয়ে) Don Mueng এয়ারপোর্টে আমাদের নিরাপদ অবতরণ হল। ভিসা আগে থেকে করে রাখার কারণে ইমিগ্রেশন এবং লাগেজ কালেকশনে দেরি হল না। তখনও পরিবর্তিত সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারিনি তাই কিছুক্ষণ অযথা সময়ক্ষেপ করে এয়ারপোর্টের মধ্যেই একটা স্থানীয় সিমের খোঁজে বেরোলাম। কারণ এখানে আসার পরই আমার ভোডাফোনের দুটি সিমই দেহ রেখেছেন। একটা নেট সিম ভরে ট্যাক্সি ধরে হোটেলে এলাম তখনও ব্যাংকক শহরের পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার ব্যাংককে সব হোটেলেই চেক ইন টাইম দুপুর দুটোয় আর চেক আউট বারোটায় (যদিও ব্যবসায়িক ফায়দা ছাড়া আর কোনও কারণই মাথায় এল না)। ঘরে ঢোকার যেহেতু সুযোগ নেই তাই হোটেলে লাগেজ জমা রেখে রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করে কাছের এক ট্রাভেল অফিসে গেলাম। ওখানে একটি মেয়ে খুব সুন্দর ভাবে আজকের সারাটাদিন নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কিভাবে ঘুরতে পারি বুঝিয়ে দিল। তবে পরের দিনে সাফারির বুকিংটা করে রাখলাম। কারণ, ওই ট্যুরটা নিজেরা করা যায় না, কোনও গ্রূপের সাথেই করতে হবে। ওখান থেকে বেরিয়ে ঠিক করলাম কিছু খেয়ে নিয়ে আজকের ভ্রমণ শুরু করব। কিন্তু খাবার দোকান খুঁজে পাওয়া এক ঝক্কি!ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান চোখেই পড়ে না। যা দুএকটি চোখে পড়ল তাদের শাটার বন্ধ।

ওয়াট ফো, শায়িত বুদ্ধ

 খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান সকাল সাড়ে দশটার আগে খুলবে না, তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে নটা। অগত্যা অনেক খুঁজে রাস্তার ধারের দোকান থেকে কাঁচা পাউরুটি আর এককাপ করে কফি খেয়ে বিদেশ ভ্রমণের প্রথম দিনটা শুরু করলাম। তারপর সারাদিন ধরে কখনো ট্যাক্সি, কখনো টুকটুক, কখনও বা চাওফ্রায়া নদীর বুকে ফেরি ইত্যাদি করে দিনটা কাটল।

চাওফ্রায়া নদী থেকে অরুণ ওয়াট

বোট রাইড

  ব্যাংকক শহরটির অবস্থান চাওফ্রায়া নদীর দু’তীরে। আমাদের হোটেলের পাড়ে রয়েছে রয়্যাল প্যালেস (সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা প্রথম রাম নির্মিত), এমেরাল্ড বুদ্ধা মন্দির, ওয়াট ফো (এটিও একটি বুদ্ধিস্ট টেম্পল), আর এসামশন ক্যাথেড্রাল আর চাওফ্রায়ার ওপর পারে ওয়াট অরুণ মন্দির (The Temple of Dawn)। আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আধঘন্টায় পৌঁছে গেলাম গ্র্যান্ড প্যালেসে। চাওফ্রায়া নদীতীরে অবস্থিত এই প্যালেসের প্রধান আকর্ষণ হলো পান্নার বুদ্ধমন্দির। অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত প্রাসাদ এবং বুদ্ধমন্দির পর্যটকদের যারপরনাই মোহিত করে। এখানকার প্রবেশ মূল্য ৫০০ ভাট প্রতিজন অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ১২৫০ টাকা। তারপর দেখবেন সংলগ্ন মিউজিয়াম। এখানে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এবং নয়নমনোহর মূর্তি ও ম্যুরাল খুব ভালো লাগবে। ওখানে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে গেলাম প্রাসাদ থেকে কিছু দূরে 'ওয়াট ফো'। মন্দিরটির কারুকার্য এবং সোনার তৈরি শায়িত বুদ্ধের বিরাট মূর্তির সূক্ষ্ম কাজ অনবদ্য। থামের আড়াল থাকার কারণে বুদ্ধের পুরো অবয়বের ছবি পেতে আপনাকে রীতিমতো কসরত করতে হবে। ওখান থেকে বেরিয়ে পেট আবার জানান দিচ্ছে, 'তেল চাই, নইলে একপাও নড়বো না'। আসলে শরীরের দোষ নেই, গতকাল রাত থেকে সেভাবে খাওয়া হচ্ছেনা। তবে এখানে কোনও রেস্তোরাঁর সন্ধান পেলাম না। অগত্যা একটা দোকানে বসে ইনস্ট্যান্ট নুডলস আর কফি খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম। খেয়েদেয়ে একটু দম নিয়ে চাওফ্রায়া নদী পেরিয়ে পৌঁছলাম ওপারের  'ওয়াট অরুণ বুদ্ধমন্দির'। মন্দিরটি স্তূপাকৃতি , চাওফ্রায়া নদীর বুক থেকে সূর্যাস্তের ইঁট রঙা আলোয় মন্দিরের সিল্যুয়েট মনের গভীরে দাগ কেটে যায়। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে 'ওয়াট রাকাং বুদ্ধমন্দির'।

ওয়াট রাকাং বুদ্ধ মন্দির

 

ওখান থেকে এপারে ফিরে এসে আবার একটা টুকটুক ধরে প্রচুর জ্যাম ঠেলে ঘন্টা খানেকের সফরে পৌঁছলাম 'এসামশন ক্যাথেড্রাল'। কিন্তু গিয়ে দেখলাম চার্চ বন্ধ, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে চার্চের অন্দরমহল দেখার সৌভাগ্য হলো। ওখান থেকে ফিরে সোজা হোটেল।

 আজ এগুলো দেখলাম। কাল যাব সাফারি পার্ক, ডলফিন শো, হাতি ভিলেজ আর ফ্লোটিং মার্কেট।

ব্যাংককে আমার চিরাচরিত মর্নিং ওয়াক হচ্ছে না। আজ সাফারি ওয়ার্ল্ড যাওয়ার কারণে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে তৈরি থাকতে হয়েছিল, তাই সকালে নিজের মতো করে শহর ঘুরে বেড়াতে পারিনি। আর কালকেও পরবর্তী গন্তব্যে যেতে ওই একই সময় বেরোতে হবে। এটা আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর। আজ সকাল সাতটা চল্লিশে বেরিয়ে সাড়ে নটা নাগাদ সাফারি ওয়ার্ল্ডে পৌঁছলাম। গাড়িতে এক মহিলা গাইড ছিলেন। উনি মন্দের ভালো ইংরেজি বলেন। ব্যাংককের মূল সমস্যা হলো ভাষা। প্রায় কেউই ইংরেজি বলতে তো পারেই না, কিছু বোঝেও না। এখানে রাস্তা হারিয়ে গেলে গুগল বাবাজি ছাড়া আর কেউ আপনাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছনোর দিশা বাতলাবে না।

   সাফারি ওয়ার্ল্ড বেশ কয়েক হাজার একর জুড়ে বিস্তৃত, তার একদিকে বিভিন্ন শোয়ের জঙ্গম ব্যবস্থা, অন্যদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বন্য প্রাণীদের বিচরণ ভূমি। আমাদের সফর শুরু হলো ওরাংওটাং শো দিয়ে, এরপর যথাক্রমে বার্ড শো/এলিফ্যান্ট শো, আর কাউবয় শো দেখে প্রথম পর্ব শেষ করলাম। তারপর  কমপ্লিমেন্টারি লাঞ্চ (প্যাকেজের মধ্যে) শেষ করে করলাম বোট সাফারি। এটার জন্যে দুজনকে ৩৫০ করে ৭০০ baht দিতে হল। একটা আধো অন্ধকার টানেলে কিছুটা কৃত্রিম ভাবে সাজানো ভয়-অন্ধকার পথ ধরে প্রায় দশ মিনিটের সফর বেশ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। এরপর হাজির হলাম ডলফিন শো দেখতে। অসম্ভব সুন্দর শো, একাধিক ডলফিনের সিংক্রোনাইজেশন আর উপস্থিত বুদ্ধির খেলা মুগ্ধ করল। একমাত্র কাউবয় স্টান্ট শো বাদ দিয়ে সবগুলোই বেশ উচ্চমার্গের ছিল, তবে ডলফিন শোয়ের কোনও তুলনা ছিল না। একটাই সমস্যা ছিল, বড়দিনের ছুটিতে কয়েক সহস্র হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল তার মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয়। এমনিতে খারাপ লাগছিল না, তবে প্রতিটি শোয়ের পর দৌড়ে দৌড়ে পরের শোয়ের জায়গায় পৌঁছতে হচ্ছিল। কারণ, শোয়ের মজা নিতে গেলে আর ভাল ছবি তুলতে গেলে আপনাকে ঠিকঠাক জায়গা বেছে বসতে হবে। সবশেষে ছিল আজকের ট্যুরের সেরা আকর্ষণ জু সাফারি।

কাঁচে ঘেরা গাড়িতে বসে অনাবিল প্রকৃতির উন্মুক্ত অঙ্গনে সমস্ত বন্য প্রাণীর জীবনযাপনের উদ্ধত স্বাধীনতার দৃশ্য আমাদের প্রায় পেড়ে ফেললো। সেই মুক্তাঙ্গনে কে ছিল না!!! হরিণ, জলহস্তি, গন্ডার, অজস্র পাখি (পেলিকান, রাজহাঁস, এমু, অস্ট্রিচ, বক, ম্যাকাও, ইত্যাদি), জিরাফ, জেব্রা, মোষ, বাঘ, সিংহ, হিমালয়ান ভালুক ইত্যাদি। ফেরার পথে বাজার এলাকায়(ইন্দ্রা স্কয়ার) নেমে অল্প কিছু baht খসিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

    কাল সকাল সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে যাবো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। আমাদের পরের গন্তব্য ক্রাবি আইল্যান্ড। ওটা একটা অন্য আইল্যান্ড তাই অন্য এক গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করব।

(চলবে..)

ছবিগুলি তুলেছেন লেখক। লেখক অর্থনীতির অধ্যাপক।

Mailing List