পাচার হওয়া মেয়েরাই পরে পাচার কাজেও যুক্ত হয়! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১১, লিখছেন সুখেন্দু হীরা

পাচার হওয়া মেয়েরাই পরে পাচার কাজেও যুক্ত হয়! নারীপাচার যুগে যুগে: পর্ব – ১১, লিখছেন সুখেন্দু হীরা
সুখেন্দু হীরা
নারীপাচার জগতে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যারা একসময় পাচার হয়েছিল তারাই পরবর্তীকালে অন্যতম পাচারকারী হয়ে ওঠে বা পাচারকার্যের সহায়ক হয়ে ওঠে। যে মেয়েটি একসময় পাচার হয়ে যৌনপল্লীতে এসেছিল, তিনি ভবিষ্যতে যৌনপল্লীতে একটি 'কোঠির' মালকিন হয়ে ওঠেন। তিনি তখন নাবালিকা বা পাচার হওয়া নারীদের কিনে ব্যবসা চালান। যৌনপল্লীতে যেসব বাড়িতে থেকে যৌনকর্মীরা ব্যবসা চালান, সেই সব বাড়ির মালকিনদের মাসি বলা হয়। এই মাসিরাও একদিন পাচার হয়ে হয়তো এসেছিলেন। এ যেন কলেজে র্যাগিং-এর মতো। যে নবাগতরা আজ র্যাগিং হচ্ছে, তাঁরাই আগামী বছর নবাগতদের র্যাগিং করবে।
এই চিত্র অবশ্য আজকের নয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল ৯৯ জন মেয়ে কলকাতায় বারবনিতাদের কাছে মানুষ হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু বারবনিতার কন্যারা নেই। অনেক ক্ষেত্রে দক্তক নিয়েছেন, বা কিনে নিয়েছেন কোনও গরীব পরিবারের কাছ থেকে। উদ্দেশ্য একটাই এই শিশুদের ভবিষ্যতে যৌন ব্যবসায় নামানো হবে। কারণ এই শিশুদের পালক বারবনিতারা যখন বৃদ্ধা হবেন, তখন এই শিশুরা বড় হয়ে দেহ ব্যবসায় নেমে যা উপার্জন করবেন সেই উপার্জনে ভাগ বসাবেন। অথবা শিশুরা দায়িত্বজ্ঞান বসত অভিভাবক বারবনিতাদের দেখভাল করবেন।
এক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন বারবনিতাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। তাদের বয়স হলে, রূপ-যৌবন চলে গেলে এছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। অনেক বারবনিতা শেষ বয়সে কোনও বাঁধাবাবু, যৌনপল্লীর দালাল বা অন্য কোনও লোকের সঙ্গে কোথাও সংসার পাতে, অতীতের উপার্জন ভেঙে খায়। আর যদি সে বাড়িওয়ালী হয়ে উঠতে পারে তাহলেতো কথাই নেই। যাদের ভাগ্যে এগুলো হয়ে ওঠেনা তাঁরা পতিতা পল্লীতেই ঝিগিরি বরে পেট চালায়। অনেকের ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। এরকম অনিশ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্থ জীবন বেছে নেওয়ার থেকে, সেই যৌনকর্মী চাইবে আরও অনেককে এই পথে নামিয়ে ভবিষ্যৎ জীবন নিরাপদ করতে।
আমরা দেখেছি উত্তর-পশ্চিম ভারতে যেখানে পুরুষদের তুলনায় নারীদের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম, সেই অঞ্চল থেকে পুরুষরা এসে বাংলা থেকে গরীব মেয়েদের বিবাহ করে নিয়ে যায়। কোনও একটি মেয়ের দালাল মারফৎ বা অন্য কোনও ভাবে ভিনদেশে হয়েছিল। সেই বিবাহিত মেয়েটি পরে এই রকম বিবাহের দালালি বা ঘটকালি করে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গ্রামের কোনও মেয়ে যে ভাবেই হোক সে পাচার হয়েছিল। সে ফিরে এসে তার জীবনের ভুয়ো রঙিন গল্প শুনিয়ে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যায় আরও কয়েকজনকে।
পুনরায় পাচার হতেও দেখা যায়। অনেক সময় উদ্ধার হওয়া মেয়েরা আর বাড়িতে থাকতে চায় না। কারণ ওই অন্ধকার জগতে যেটুকু স্বাচ্ছন্দ, নাগরিক সুখ পেত গ্রামে ফিরে সেটা সে পায় না, সে এবার স্বেচ্ছায় পালায়, সঙ্গে নিয়ে যায় হয়তো কোনও অসহায় মেয়েকে।
সম্প্রতি কিছু পাচারের ঘটনা সামনে এসেছে, তা হল মা ও মেয়ে একসঙ্গে পাচার হওয়া। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার গরিব ঘরের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর কন্যা যখন সদ্য কিশোরী হয়, তখন তিনি (মা) যুবতীই থাকেন। এরা স্বামী পরিত্যক্তা হলে পাচারকারীদের পোয়াবারো। এক ছিপে দুই মাছ।
এমনও দেখা গেছে মা মেয়ে এক সঙ্গে পাচার হয়েছিল। উদ্ধার হবার পর মা নতুন বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছেন। বয়ফ্রেন্ডের সহায়তায় মেয়েকে আবার বিক্রি করে দিয়েছেন। কারণ তিনি তো এই লাইনে ঘাতঘোত সব জেনে গেছেন।
শিকারী (Accused) ধরল শিকার (Victim) -কে, আবার শিকার বড় হয়ে ভবিষ্যতে শিকারী হল। সে আবার শিকার ধরল। এভাবে শিকারী থেকে শিকার এবং শিকার থেকে শিকারী। এই যুগপৎ অবস্থান বদলের মাধ্যমে নারী পাচারের ব্যাটনটা নীরবে রয়ে গেছে পাচারকারীদের হাতে।
তথ্য ঋণ: বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত তথ্য।


