বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে স্রেফ না খেতে পেয়ে! 'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়'

বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে স্রেফ না খেতে পেয়ে! 'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়'
ড. গৌতম সরকার
কোভিড আতঙ্ক এখন একটু স্তিমিত, যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একই বিক্রমে হয়ে চলেছে, অদূর ভবিষ্যতে যার থামার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, ঠিক সেই সময় আন্তর্জাতিক মানচিত্রে একটি তথ্য তামাম বিশ্বকে আরেকবার কাঁপিয়ে দিল।
তথ্যটি হল, এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে স্রেফ না খেতে পেয়ে। এমাসের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠিতে এই তথ্য সরবরাহ করেছে ৭৫টি দেশের ২৩৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই তালিকায় 'অক্সফাম', 'সেভ দ্য চিলড্রেন', 'প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল'-এর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থাগুলিও আছে। সেই চিঠিতে তারা জানিয়েছেন, 'এটা কোনও একটা নির্দিষ্ট দেশ বা মহাদেশের সমস্যা নয়। এই সমস্যা তামাম বিশ্বের। সকলের কাছে অনুরোধ, অভুক্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাদের একটু খাবার দিয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করুন।' এই সমস্ত সংস্থার ক্ষোভ, বিশ্বের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতারা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পৃথিবীকে আর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে দেবেন না। তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সম্পুর্ণ রূপে ব্যর্থ তার জ্বলন্ত প্রমান হল সোমালিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের আরও কয়েকটি দেশ যারা আজ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় ৩৪ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ চরম ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে। পেটে খিদে নিয়ে মারা যাচ্ছে দৈনিক ১৯ হাজার ৭০০ জন মানুষ। হিসেবটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতি চার সেকেন্ডে একজন। এই পরিসংখ্যান কোডিড পূর্ববর্তী হিসেবের প্রায় দ্বিগুণ। আজ সোমালিয়া, নাইজিরিয়া, ইথিওপিয়া, ইয়েমেনের মত দেশগুলিতে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ওই খোলা চিঠিতে বলা হয়েছে, অতিমারি পর্বে ধনকুবেরদের সম্পত্তি বেড়েছে কয়েক গুণ, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খাদ্যসঙ্কট। একদিকে কৃষিতে নব নব প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটছে, আবার একই সঙ্গে কৃষি বিশ্ববাসীকে খাদ্য নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, এই উলটপুরাণ অতি শীঘ্র সংশোধন করতে না পারলে একবিংশ শতাব্দীও দুর্ভিক্ষের চরম লজ্জা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। এটি কোনও দেশ, অঞ্চল না ভূখণ্ডের সংকট নয়, এটি হল মানবতার সংকট। তাই বিশ্বের সমস্ত দেশকে একজোট হয়ে এর প্রতিকারের উপায় বের করতে হবে।
কোভিড-১৯ বিশ্বের সমস্ত দেশকে লকডাউনের পথে যেতে বাধ্য করেছিল। ফলস্বরূপ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। গত একবছর ধরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বিশ্ব অর্থনীতি ধীরে ধীরে নিরাময়ের পথে চলেছে। তাই প্রশ্ন হল, অর্থনীতি যখন মন্দা পরিস্থিতি সামলে ওঠার চেষ্টা করছে তখন কেন মানুষ নতুন করে খিদের জ্বালায় প্রাণ হারাচ্ছে?
বিশ্ব জুড়ে ঘটে চলা যুদ্ধ, গৃহ যুদ্ধ এবং হিংসাকেই এই খাদ্যভাবের মূল কারণ হিসেবে দেখছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। একদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলতে থাকা অনন্ত যুদ্ধ, অন্যদিকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উদ্ভূত গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি, প্যালেস্টাইন-ইজরায়েল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের প্রবর্তন ইত্যাদি কারণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার। চাহিদা-যোগানের ভারসাম্যে বড়সড় ফাটল ধরার কারণে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা ক্রমশ লাগামছাড়া হয়ে পড়ছে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়া তেল আর ইউক্রেন গম রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। কোভিড মহামারী সমস্ত দেশের অর্থনীতির ওপরেই কম বেশি প্রভাব ফেলেছে। ফলস্বরূপ বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্য ঋণ ও অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে গরিব দেশগুলির সমস্যা আরও প্রকট রূপ ধারণ করেছে। তবে সমস্যার এটাই শেষ নয়। ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট-এর অনুমান বলছে, চলতে থাকা খাদ্য সংকট ২০৩০ সালে চরমে পৌঁছাবে। অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়বে আরও ৬৭ কোটি। বিশেষজ্ঞরা এর প্রধান কারণ হিসেবে আগামী দিনে কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রধানত দায়ী করেছেন।
অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেনা ভারতও। বরঞ্চ বৈশ্বিক গড়ের হিসেবে ভারতে এই সমস্যা আরও গভীর। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৫ বছর আগে, কয়েকদিন আগেই ষোড়শোপচারে উদযাপিত হল স্বাধীনতা দিবস, অথচ এখনও প্রতিনিয়ত না খেতে পেয়ে মরছে মানুষ। রাজধানী দিল্লি থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনাহার, অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর খবর নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে, মূলত শহরাঞ্চলের বস্তি ও ঝুপড়িবাসীদের মধ্যে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশে 'পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম'-এর আওতায় দরিদ্র মানুষদের জন্য 'রেশন কার্ড'-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই বস্তি ও ঝুপড়িবাসীর অধিকাংশেরই কোনও রেশন কার্ড নেই। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেট্রো শহরে কাজের সন্ধানে আসা মানুষগুলোর স্থানীয় এলাকায় বসবাসের কোনও গ্রহণযোগ্য প্রমাণপত্র থাকে না। অথচ দেশের প্রতিটি নাগরিককে খাদ্য সুরক্ষা একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শর্ত সাপেক্ষে খাদ্য সুরক্ষা প্রদান নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের সামিল। তাই সঠিক এবং উপযুক্ত নীতি প্রয়োগ মারফত সমাজের গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের পুষ্টিকর খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ সরকারের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের নিঃশর্তে ন্যূনতম বেঁচে থাকার উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।
ভারতের এই মুহূর্তে জনসংখ্যা ১৪০ কোটি ছুঁইছুঁই। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টিজনিত কারণে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। 'সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' এবং 'ডাউন টু আর্থ' পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারতের বহু মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় অসুখে ভুগছে। অপুষ্টির কারণে ভারতে মৃত্যু হয় প্রতি বছর ১০ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের। 'ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট'-এর হিসেবে, শুধুমাত্র ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ৯ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটের সমস্যায় পড়বে। একটা কথা খুব স্পষ্ট, দুর্ভিক্ষজনিত এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সর্বাগ্রে দরকার আন্তর্জাতিক হানাহানি, যুদ্ধ বন্ধ করে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে একটা স্থিতিশীলতা দান।
ভারতে অনাহারের মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে মূলত দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা হ্রাসের ধীর গতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য, লিঙ্গবৈষম্য, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব ইত্যাদির সাথে যোগ করা হয় কোভিড অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলিকে। বিশ্বের ক্ষুধা সূচকের তালিকায় বিশ্বের ১১৬ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১ নম্বরে। অথচ ২০১৪ সালে এই অবস্থান ছিল ৫৫। পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয়, মাত্র আট বছরে কি ভয়ংকর গতিতে আমাদের দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
আজ উৎসবের আবহে চতুর্দিক রঙিন। আমরা যখন গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি, দুর্গাপূজা পেরিয়ে ছট, জগদ্ধাত্রী, গুরু নানকের জন্ম-দিন উদযাপন করবো, রঙিন আলোর ফানুসে আশপাশ রূপকথা হয়ে উঠবে তখনই হয়তো দেশের কোণে কোণে শিশু-বৃদ্ধ-বনিতা খিদের তাড়নায় প্রাণ হারাবে। তাই শুধু প্রথম বিশ্বের নয়, এটা আপামর মানবসমাজের দায়িত্ব নিজেদের অনিয়ন্ত্রিত ভোগব্যয় কমিয়ে যার যতটুকু সম্ভব সাহায্য নিয়ে অভুক্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো। আমাদের জাতীয় স্লোগান হওয়া উচিত 'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়'। এর থেকে আমাদের মুক্তি চাই।
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
তথ্যসূত্র: সংবাদপত্র ও ইন্টারনেট


