‘বুর্জ খলিফা’ নিয়ে মানুষের উৎসাহের শেষ নেই, কিন্তু এর নির্মাণ কাহিনী কতজন জানেন?

‘বুর্জ খলিফা’ নিয়ে মানুষের উৎসাহের শেষ নেই, কিন্তু এর নির্মাণ কাহিনী কতজন জানেন?
দীপান্বিতা ঘোষ
"বুর্জ খলিফা" একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ "খলিফার স্তম্ভ"। আরব আমিরাতের অর্থনীতি মূলত খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে আমিরাত সরকার পর্যটন শিল্পে মনোযোগী হয়েছে। নানা পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মানব নির্মিত এই সর্বোচ্চ কাঠামো।
নির্মাণ কাল:
বুর্জ খলিফার নির্মাণ কাজ শুরু হয় 2004 সালে। এবং এর শুভ উদ্বোধন হয় 2010 সালের 4 জানুয়ারি। বুর্জ খলিফা উদ্বোধন করেন তৎকালীন দুবাই এর শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাক্তম। নির্মাণ কালে এর নাম বুর্জ দুবাই থাকলেও পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এর নামানুসারে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "বুর্জ খলিফা"।
নির্মাণ কৌশল:
ভবনটির স্থাপত্যরীতি হোলো নিউ -ফিউচারিজম। স্থপতি হলেন আড্রিয়ান স্মিথ। নির্মাণে প্রধান ঠিকাদার সংস্থা ছিলো "স্যামসাং সি এন্ড টি'। হাইমোনোক্যালিস নামে ফুলের আদলে তৈরি ভবনটি ধীরে ধীরে উপরে উঠার সঙ্গে সঙ্গে এর বিস্তার কমে এসেছে।
এই গঠনটিতে "টিউব স্ট্রাকচার" পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে তুলনামূলক অনেক কম খরচে বহুতল নির্মাণ করা যায়। বুর্জ খলিফা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের এক প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান। বিশ্বব্যাপী পরিচিত এফ.আর.খান কে "আইনস্টাইন অফ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং" বলা হয়।
বুর্জ খলিফা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে 3 লক্ষ 30 হাজার ঘনমিটার কংক্রিট, 39 হাজার ঘনমিটার স্টীল, 1 লক্ষ 3 হাজার বর্গমিটার কাঁচ এবং 15 হাজার 500 বর্গমিটার স্টেইনলেস স্টীল।
শ্রমবিনিয়োগ:
বুর্জ খলিফা মূলত দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার শ্রমিকরা তৈরী করেছিলেন। অত্যধিক উচ্চতায়, অস্বাভাবিক পরিস্থতিতে শ্রমিকদের রাখা হয়েছিলো। এমনও একটা সময় গেছে যখন প্রায় প্রতিদিন 12000 শ্রমিক দিন রাত কাজ করতো।
তাদের কাজও করতে হত প্রানের ঝুঁকি নিয়ে। বিশেষতঃ বাইরের গ্লাসগুলি লাগানোর সময়। গ্লাসগুলো লাগানোর পর সেগুলি পরিষ্কার করাও ছিলো অত্যন্ত কষ্টকর। বাইরের অংশ পরিষ্কারের সময়, শ্রমিকদের কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিলো না।
উচ্চতা:
বিশ্বের অসংখ্য রেকর্ডধারী বুর্জ খলিফার উচ্চতা 2716.5 ফুট বা 818 মিটার। যা উপরের দিকে প্রায় আধ মাইল বিস্তৃত। 206 তল বিশিষ্ট বুর্জ খলিফার 160 তলা পর্যন্ত আবাসিক। এর উপরের অংশগুলি কারিগরি কাজ পরিচালনা ও সংযোগ রক্ষাকারী নানান কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে 160 তলার উপরে ওঠার জন্য আপনাকে অবশ্যই অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে নিতে হবে।
6 লাখ বর্গফুট বিশিষ্ট এই ভবনে 54 টি এলিভেটর বা লিফ্ট রয়েছে। এগুলোর গতি ঘন্টায় প্রায় 40 কিমি। এই উচ্চগতি সম্পন্ন লিফ্ট ব্যবহার করে এক মিনিটেই 124 তলায় পৌঁছানো সম্ভব। অধিক উচ্চতার কারণে এর নিচের তলা ও উপরের তলার মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য প্রায় 10 ডিগ্রী।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার এর উপরের অংশের অধিবাসীরা আগে সকালের সূর্যকে দেখতে পায় আবার দিনের শেষে বেশিক্ষন সূর্যকে দেখতে পাই বলে উপরের অংশের অধিবাসীদের কাছে দিনের দৈর্ঘ্য সমতলের অধিবাসীদের চেয়ে বেশী হয়। তাই নিচের তলার লোকেরা যখন রমজানে ইফতার করে তার 2 মিনিট পর উপরতলার লোকেরা করে।
বহুমাত্রিক ভবন বুর্জ খলিফা:
নামীদামী হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অফিস, আবাসিক এপার্টমেন্ট, যোগাযোগ ও সম্প্রচার কেন্দ্র বিশিষ্ট ভবনটিতে 3 টি আলাদা প্রবেশপথ রয়েছে। একটি আবাসিক ফ্লোর গুলির জন্য। আর একটি হোটেলে যাওয়ার জন্য এবং অন্যটি বিভিন্ন অফিসের। এর ভেতরে আছে 1000 এর বেশী বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট।
43 তলা এবং 76 তলায় আছে সুইমিং পুল। 158 তলায় রয়েছে মসজিদ। রয়েছে 160 কক্ষবিশিষ্ট হোটেল ও বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণ। এখানে আমেরিকানদের জন্য অগ্রাধিকার চোখে পড়ার মতো। কেননা 9 থেকে 16 তলা পর্যন্ত তাদের জন্যই বরাদ্দ রয়েছে। বুর্জ খলিফায় বসবাসরত মানুষদের জন্য প্রতিদিন প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ লিটার জলের প্রয়োজন হয়। জল সরবরাহের জন্য রয়েছে এক কিমি দীর্ঘ সুগভীর পাইপ লাইন।
এছাড়া এয়ার কন্ডিশনিং এর জন্য 34 কিমি এবং জরুরি অগ্নি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় 213 কিমি দীর্ঘ পাইপ লাইন রয়েছে। বুর্জ খলিফায় একসাথে 25000 মানুষ ধারণ করতে পারে। এতো বিশাল লোক সমাগম করার ক্ষমতা বিশ্বের দ্বিতীয় আর কোন ভবনের নেই।
পর্যটন আকর্ষণের কারণ:
মরুভূমির উপর নিখুঁত স্থাপত্যে তৈরী এই ভবন বিশ্ববাসীর কাছে দুবাই এর গৌরব ও মর্যাদাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। যা নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় 1.5 বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
- ভবন প্রাঙ্গনে একটি ফোয়ারা আছে যা নির্মাণে খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ কৃত্রিম ফোয়ারা "দুবাই ফাউনটেন"। ফোয়ারাটি 600 টি লাইট এবং 50 টি রঙিন প্রজেক্টর দ্বারা আলোকিত। 990 ফুট দীর্ঘ এই ফোয়ারা 500 ফুট উঁচুতে জল বর্ষণ করে। চলতে থাকে আরবি ও ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে জলের নাচন।প্রতি বুধবার থেকে শনিবার আধঘন্টা অন্তর অন্তর এই ফোয়ারার প্রদর্শনী চলে।
- ভবনের দেওয়ালে ও চারপাশের ইন্টেরিয়রে মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক শিল্পী দের আঁকা প্রায় 1000 শিল্পকর্ম দেখা যাবে।
- ভবনের বাইরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিশাল পার্ক,ভবনের চারপাশে রয়েছে 7.4 একরের অপরূপ সুন্দর উদ্যান।এছাড়া 30 একর আয়তনের কৃত্রিম হ্রদ।
- অবসার্ভেশন ডেক। 124 ও 125 তলায় মানে মাটি থেকে প্রায় 500 মিটার উপর থেকে মরুভূমি ও সাগরের মিলন দেখা যায়। এছাড়া 360 ডিগ্রী কোনে পুরো দুবাই শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। টেলিস্কোপের সাহায্যে দিন ও রাতের দুবাই শহরকে আলাদা ভাবে দেখার সুযোগ আছে। এখানে আলাদা টিকিটের মাধ্যমে বুর্জ খলিফা নির্মাণের মাল্টিমিডিয়া চিত্র প্রদর্শনী দেখানো হয়।
148 তলায় অর্থাৎ ভূমি থেকে 555 মিটার উঁচুতে বিশ্বের সর্বোচ্চ অবজারভেশন ডেক অবস্থিত। যা "At the Top SKY" নামে পরিচিত। এখানে পর্যটকদের VIP-র মতো সম্মান দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়। এই ডেকের ইন্টারঅ্যাক্টিভ স্ক্রীন পর্যটকদের জন্য আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ। যার হাইটেক সেন্সরের মাধ্যমে বিভিন্ন শহরের ল্যান্ডমার্কসের উপর দিয়ে হোভারিং করে ঘুরে বেড়ানো যায়।
এখান থেকে আর একবার দুবাই শহরের sky view দেখার সুযোগ হয়। এখানে "দ্য রেসিডেন্স" নামের লবিতে "world voice" নামের একটি ভাস্কর্য আছে। এই ভাস্কর্যের মাঝে অবস্থিত সিম্বল যন্ত্রের মাধ্যমে উপর থেকে জল পড়ার শব্দ অসংখ্য মানুষের কণ্ঠের প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসে।
- এছাড়াও এই ভবনটি বিশ্ববাসীকে যে কারণে আকর্ষণ করে তা হল এটি বেশ কিছু বিশ্বরেকর্ড গড়েছে।
- i) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু free standing structure.
- ii) পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী তলা বিশিষ্ট ভবন।
iii) পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বহিরাঙ্গন পর্যবেক্ষণ ডেক আছে।
- iv) 76 তলায় অবস্থিত সুইমিং পুল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সুইমিং পুল।
- v) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু লিফ্ট।
- vi) 122 তলায় আছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার রেস্টুরেন্ট।
vii) বুর্জ খলিফায় রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় নামাজের ব্যবস্থা।
শুনতে খারাপ হলেও এটাও সত্যি এবং রেকর্ড যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। যিনি আত্মহত্যা করেন তিনি 146 তলা থেকে ঝাঁপ দেন এবং 38 তলায় এসে পড়েন।
কিভাবে যাবেন বুর্জ খলিফা:
দুবাই মলের পাশে ডাউন টাউনে বুর্জ খলিফা অবস্থিত। দুবাই মেট্রোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে রেড লাইন দিয়ে বুর্জ খলিফা স্টেশনে যেতে হবে। এখান থেকে F 13 no বাসে দুবাই মল বাস স্টপেজে নামতে হবে। দুবাই মলের পাশেই বুর্জ খলিফার প্রবেশপথ।
সারা বিশ্বে সুনামের ফলস্বরূপ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে।তবে কর্তৃপক্ষ অনলাইনে টিকিট কাটারও ব্যবস্থা রেখেছে, যা সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় করবে। লেভেল 124,125 এবং 148 মিলিয়ে একটি প্যাকেজ দেবে যার মূল্য প্রায় সাড়ে 11 হাজার। আগে থেকে online টিকিট কাটলে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়।
প্রতিদিন সকাল 11 টা থেকে রাত্রি 10 টা পর্যন্ত গেট খোলা থাকলেও বৃহস্পতি থেকে শনিবার মধ্যরাত অব্দি গেট খোলা থাকে। তাই বেশী সময় ধরে পরিদর্শন করতে চাইলে বৃহস্পতি থেকে শনিবারই আদর্শ। বুর্জ খলিফার 122 তলায় একটি বার ও রেস্টুরেন্ট আছে যার নাম At. Mosphere. এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার রেস্টুরেন্ট।
সম্প্রতি বুর্জ খলিফা তে আরমানি হোটেলের লবি উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানে রাত কাটাতে চাইলে জনপ্রতি প্রতি রাতে 39000 টাকা লাগবে। তবে কাছাকাছি থাকতে চাইলে পাশে কম খরচের হোটেলও আছে।
নির্মাণের উদ্দেশ্য:
মনে প্রশ্ন আসতে পারে এতো খরচ করে এই গগনচুম্বী ভবন নির্মাণের কারণ কি? আসলে আমিরাত সরকার জানে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা। তাই তারা সবচেয়ে বেশী মনোযোগী হয়েছে পর্যটন শিল্পে।
মানবতা সব সময় প্রতিযোগীতা পছন্দ করে।মানুষ চায় বারবার রেকর্ড তৈরী করতে এবং ক্রমাগত সেগুলি ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়তে।আমিরাত সরকার "বুর্জ খলিফা"র মধ্য দিয়ে বহু রেকর্ড তৈরী করেছে"। ফলে সারা বিশ্বকে আকর্ষিত করতে পেরেছে।
অন্যান্য আকর্ষণ:
বুর্জ খলিফা ছাড়া দুবাই এর অন্যান্য আকর্ষণ হোলো হাই এন্ড রিসর্ট, সাদা বালির সৈকত, কৃত্রিম দ্বীপ, শেখ জায়েদ মসজিদ, দুবাই মিউজিয়াম ও বুর্জ আল আরব।
বুর্জ আল আরব হোলো একটি 7 তারা হোটেল।সমুদ্রতীর থেকে 280 মিটার সমুদ্রের ভিতরে কৃত্রিম দ্বীপের উপর এই হোটেল নির্মিত....যা "Best Hotel in World"এবং ""Best Hotel in Middle east এর তকমা পেয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য 5 টি উঁচু টাওয়ার:
১। ইন্ডিয়া টাওয়ার
উচ্চতা: 707.5 মিটার
শহর: মুম্বাই, ভারত।
২। ওয়ারিসন মেরডেকা টাওয়ার
উচ্চতা: 679 মিটার
শহর: কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া।
৩। টোকিও স্কাইট্রি
উচ্চতা: 634 মিটার
শহর: সুমিদা, টোকিও, জাপান।
৪। সাংহাই টাওয়ার
উচ্চতা: 632 মিটার
শহর: সাংহাই, চীন
৫। মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ার
উচ্চতা: 601 মিটার
শহর: মক্কা, সৌদি আরব।
লেখক: ভূগোলের শিক্ষিকা


