ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়ালো, মরক্কো যেন মৃত্যু উপত্যকা

ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়ালো, মরক্কো যেন মৃত্যু উপত্যকা
আনফোল্ড বাংলা প্রতিবেদন: প্রকৃতির হত্যালীলা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন মরক্কোর ভূমিকম্প। এক, দুই, পঞ্চাশ, একশো, পাঁচশো, হাজার, দুই হাজার......। মরক্কোর প্রশাসন এবং সংবাদসংস্থার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত এটাই মানুষের মৃত্যুমিছিলের হিসাব। কোথায় গিয়ে তা থামবে এখনই বলা যাচ্ছে না। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আহতের সংখ্যাও। আহতদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা সংকটজনক। মারাকাশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত শুক্রবার রাতে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ২০১২। কিন্তু এই সংখ্যা যে থেমে যাচ্ছে তা নয়। মারাকাশের প্রত্যন্ত গ্রামে ভূমিকম্পের প্রভাব কতটা পড়েছে, তার হিসাব এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানাচ্ছে, শুধুমাত্র আল হাওয়াজ প্রদেশেই মৃতের সংখ্যা ১২৯৩। কমপক্ষে আহত হয়েছেন ২০৫৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১৪০৪ জনের অবস্থা রীতিমতো গুরুতর। মরক্কো সরকারের পক্ষ থেকে এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের জন্য তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। মরক্কোর ভূতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, গত ১২০ বছরের মধ্যে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে এতবড় ভূমিকম্প হয়নি। ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মরক্কোর বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত অধিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করছে। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ইতিমধ্যেই মরক্কোর প্রতিরক্ষা দফতরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, যা যা সাহায্যের প্রয়োজন তা ইজরায়েল দিতে প্রস্তুত। একইসঙ্গে ইজরায়েলের সেনাবাহিনীকে সবসময় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেকোনও মানবিক সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকাও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও মরক্কোর সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মরক্কোর দুর্ঘটনাগ্রস্ত নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা একযোগে কাজ করছি। মরক্কোর জনগণের যেকোনও প্রয়োজনে আমরা পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।’’
কিছুদিন আগে তুরস্কেও ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তারাও মরক্কোর পাশে থাকার কথা বলেছে। ফ্রান্স এবং জার্মানিও একই কথা বলেছে। কাতার মরক্কোর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস এই সময় বিশ্বজুড়ে সংহতির আবেদন জানিয়েছেন। শুক্রবার রাতে মরক্কোর বুকে রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আছড়ে পড়েছিল। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ‘আফটার শক’ হিসাবে ফের ভূমিকম্প হয়। অবশ্য এর পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। ভূমিকম্পের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, মারাকাশের বাড়ি-ঘরগুলি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। রাস্তা-ঘাটে বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এটলাস পর্বতমালায় কাছে অবস্থিত মৌলে ব্রাহিম গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর ছিল। ভূমিকম্পের পর এই শহরটিকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে গ্রামটি। এই গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব তৌদেতে বলছেন, ‘‘শুক্রবার রাতে হঠাৎই একটা ভয়ঙ্কর কাঁপুনি অনুভব করি। এই কাঁপুনিটি দশ সেকেন্ডের মতো স্থায়ী ছিল। তারপর যা ঘটল এখনও আমাদের কাছে দুঃস্বপ্ন।’’ ভূমিকম্পের জেরে মাটি দু’ভাগ হয়ে গেছে। বাড়িগুলিতে সৃষ্টি হয়েছে ফাটল। আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা নিরাপত্তার খোঁজে তখন দিশাহারা। চতুর্দিক বিধ্বস্ত। বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসাবশেষ সরাতেই একের পর এক মৃতদেহ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে গ্রামবাসীরা। ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের পর তৈরি হয়েছে মৃতদেহের পাহাড়। মৃতদেহগুলির পাহাড়ের কোলে কবর দেওয়া হচ্ছে। সব হারানো মানুষদের মধ্যে একজন জানালেন, ‘‘এখানকার মানুষ খুবই কষ্ট পাচ্ছে। অ্যাম্বুল্যান্স নেই। চিকিৎসক নেই। চিকিৎসার নুন্যতম পরিষেবা পাচ্ছি না। দয়া করে আমাদের বাঁচান।’’
হাসান আইত বেলহাজ এই গ্রামের অবস্থাপন্ন বাসিন্দা। বলছিলেন, ‘‘এই জায়গার বাড়িগুলি ভূমিকম্প রোধক হিসাবে তৈরি করা হয়নি। এই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে কত সময় লাগবে তা ঈশ্বরই জানেন।’’ চিকিৎসকরা খোলা আকাশের নিচেই চিকিৎসা করছেন আহতদের। আহতদের ৬০ কিমি দূরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা হামজা লামঘানি জানাচ্ছেন, ‘‘যখন প্রচণ্ড কাঁপুনি দিচ্ছিল, তখন আমি আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। হঠাৎই সব আলো নিভে যায়। মানুষজন মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে কী ঘটেছে দেখতে গিয়েই সব স্পষ্ট হয়ে যায়।’’ এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘‘ছোটবেলার আমার পাঁচবন্ধু মারা গেছে।’’ মানুষজন বলছিলেন, ‘‘এখন প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’’


