সার্জিক্যাল শিল্পের ভবিষ্যৎ! একদা বঙ্গের শেফিল্ড আজ ধ্বংসের মুখে, কারণ খুঁজলেন ড. গৌতম সরকার

সার্জিক্যাল শিল্পের ভবিষ্যৎ! একদা বঙ্গের শেফিল্ড আজ ধ্বংসের মুখে, কারণ খুঁজলেন ড. গৌতম সরকার
ড. গৌতম সরকার
আবার একটা ভোট হয়ে গেল, আকাশে-বাতাসে যথারীতি প্রতিশ্রুতির ফানুস উড়ে বেরিয়েছে, মানুষ কিছু বিশ্বাস করেছে, আবার কিছু করেনি৷ পশ্চিমবঙ্গের বারুইপুরের কয়েকশো পরিবারের চোখেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। ক্ষমতাশীল দলের প্রতিশ্রুতি বাণী, বারুইপুরের সার্জিক্যাল শিল্প আবার 'জগৎ-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।' মানুষের ক্ষোভ এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর সার্জিক্যাল শিল্পকে বাঁচাতে বহু ব্যয়ে তৈরি 'কমন ফেসিলিটি সেন্টার' এখনও চালু হয়নি। সরকার পক্ষের দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি সমন্বিত এই কেন্দ্র প্রায় প্রস্তুত, ভোটের পরপরই চালু হয়ে যাবে। 'বারুইপুর সার্জিক্যাল ইন্স্ট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন' (বাসিমা)-এর সাবেক সম্পাদক কমল দাসের কথায় ক্ষোভ ফুটে ওঠে, তিনি বলেন, "বাম আমলে সার্জিক্যাল শিল্পকে বাঁচাতে ২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের শিল্পোন্নয়ন নিগম (ইউনিডো) একটি সার্ভে করে 'কমন ফেসিলিটি সেন্টার' তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল এবং এখানকার কারিগরদের আধুনিক প্রযুক্তিতে সড়গড় করতে ‘স্মল স্কেল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’কে (এসআইএসআই) দায়িত্ব দিয়েছিল। ইউনিডোর পরামর্শ মেনে ২০০৪ সালে কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে ক্লাস্টার ডেভলপমেন্টের কাজ শুরু হয় এবং পরের বছর ৪ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। সেই অর্থে বেশ কিছু আধুনিক মেশিন কেনা হলেও বেশ কিছু বরাদ্দ অর্থ অননুমোদিত থাকায় দুটি অতি আবশ্যকীয় মাইক্রো টুলিং মেশিন কিনতে পারা যায়নি। এর ফলে উৎপাদন গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় দিক দিয়েই মার খেতে থাকে। বারুইপুর সার্জিক্যাল শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক এবং উৎপাদকদের ক্ষোভ, অর্থের অভাবে, প্রযুক্তির অভাবে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি জিনিস সস্তায় কিনে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গুণগত উৎকর্ষতা সামান্য বাড়িয়ে বিদেশি সংস্থাগুলি চড়া দামে বাজারে বিক্রি করছে। এতে তারা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের ক্ষোভ, সরকার এই ব্যাপারে একটু সচেতন হলে শুধু বারুইপুর এলাকা থেকেই বছরে কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারতো।
সারা দেশ জুড়ে শিল্পের হাহাকার, রাজ্যে তো বটেই। নতুন শিল্পের আকালের কালে পুরোনো প্রতিশ্রুতিমান শিল্পগুলোর ধ্বংস রাজ্য তথা দেশের উন্নয়নের পরিপন্থী। অথচ ১৮৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিল্পের তৈরি ছুরি, কাঁচি, ফরসেপ এবং অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে একসময় এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত। কয়েকবছর আগেও কল্যাণপুর, বিষ্ণুপুর, জুলপিয়া, চন্দনেশ্বর, চম্পাহাটি, মগরাহাট, চাকদা, উস্থি, বেহালায় প্রায় ৬০০টি কারখানায় এই সমস্ত যন্ত্রপাতির উৎপাদন হত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভাবে লাখেরও বেশি মানুষের রুজি-রোজগারের সংস্থান হত, বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হত। এখন সেটা কমতে কমতে সাত-আট কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে হাজার দুই মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে। শিল্পের দৈন্যদশা দেখে বর্তমান প্রজন্ম এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, একটা সময়ে রমরমিয়ে চলা শিল্পের এই বেহাল দশা কেন? মূল কারণ সরকারের উদাসীনতা হলেও আনুষঙ্গিক আরও অনেক কারণ আছে। এক, বিশ্বায়নের ধাক্কা। ১৯৯৭ সাল থেকে চিন আর পাকিস্তান উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় সস্তায় উন্নত মানের যন্ত্রপাতি তৈরি করতে শুরু করে। যার ফলে ভারতের রপ্তানি বাজার মার খায়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের সিয়ালকোট এবং চিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে দ্রব্য আস্তে আস্তে ভারতীয় বাজারও দখল করতে শুরু করে। বাসিমা'র পক্ষ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়, তবে সবকিছু ঢেলে সাজাতে যে পরিমান অর্থের দরকার তার জন্য সরকারি সাহায্য জরুরি ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সরকার সেভাবে এগিয়ে আসেনি। দুই, শুধু বাইরের নয় দেশের মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফিলিপসের মত বড় সংস্থার সঙ্গে বারুইপুরের প্রান্তিক শিল্পীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেননি। এছাড়া তখনকার বোম্বাইয়েও সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন, সার্জিক্যাল জিনিসপত্র তৈরির দুটো ধাপ থাকে। একটা ধাপে প্রযুক্তির প্রয়োজন ঘটে আর অন্যটিতে কারিগরি দক্ষতা ও শৈল্পিক উৎকর্ষতা। দ্বিতীয়টিতে বারুইপুর চিরকাল এগিয়ে থাকলেও এখানকার শিল্পীরা মার খেয়ে যায় প্রযুক্তিতে। চার, অস্ত্রোপচারের জিনিসপত্র তৈরির মূল উপাদান হল ভালো মানের স্টিল। স্থানীয় বাজারে যে স্টিল পাওয়া যায় সেগুলি খুব ভালো মানের না হওয়ায় মুম্বাইয়ে এবং বিদেশে প্রস্তুত দ্রব্যসমূহের সাথে প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে বাসিমার সদস্যরা ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’-র মত বড় বড় সংস্থাগুলির কাছ থেকে স্টিল কিনে একটা স্টিল ব্যাংক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনাতেও বাধ সাজছে অর্থের অভাব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুশলী কারিগরের অভাব। দক্ষ কারিগরেরা বেশি মজুরির আকর্ষণে ঘন ঘন কোম্পানি বদল করে, যার ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে৷
একদিন যে বারুইপুর বঙ্গের ‘শেফিল্ড’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল, আজ সেই শিল্প অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশরা চলে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, একের পর এক সরকার বদল হয়েছে, তার মধ্যে একদা গর্বের শিল্পের চরম দুরবস্থা কাটানোর জন্য সব সরকারের আংশিক প্রয়াস পরিলক্ষিত হলেও সর্বাত্মক চেষ্টার অভাব ছিল খুব স্পষ্ট৷ এমতাবস্থায় নির্বাচনের আগে সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি বাক্যগুলি স্থানীয় মানুষকে সেভাবে স্পর্শ না করলেও যে কয়েকশো পরিবার বা কয়েক হাজার মানুষের এই শিল্প থেকে রুটি-রুজির সংস্থান হয়, তারা এখনও আলাদিনের প্রদীপের সন্ধানে নিরত অপেক্ষায় থাকে। ভোটের আগে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতিতে সেই সন্ধান একটু গতি পায়, এই মাত্র।
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
তথ্যঋণ: ইন্টারনেট


