স্নানের সাজা

স্নানের সাজা
সুমন ঘোষ
সারা গা চুলকোতে চুলকোতে চামড়া ওঠার জোগাড়। চল আজ চান করতে যায়। কতদিন চান করিনি বলতো?
মেরুদন্ড খাড়া করে থাকা পুরনো শালগাছের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে সূর্য। তাপে জ্বলতে থাকে সারা গা। শুধু রাতটা নিশ্চিন্ত। গভীর জঙ্গলে শনশন হাওয়া বয়। মাঝেমাঝে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আবার সকাল হলেই এক অবস্থা। সকাল দশটা থেকেই গা জ্বালা শুরু।
আর সহ্য করতে পারছি না। বলেই সোঁ সোঁ করে খাড়া গাছ বেয়ে অনেকটা উঠে গেল সুচেতা। গাছেদের ফাঁক দিয়ে নিজের চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পৌঁছে দেয় মাঝ মাঠে। মাঠ জুড়ে ধূ ধূ। দু’চারটে ছাগল গরু ছাড়া কিছু দেখা গেল না। মালিকরা বুঝি সূর্যের উল্টোদিকে খেজুর গাছের সরু ছায়ায় গা এলিয়ে পা মেলে বসে রয়েছে।
চোখ ঘুরতে ঘুরতে এবার পুকুর পাড়ে। মাঝপুকুরে কয়েকজন ছেলেছোকরা দু’ফাঁক করছে জল। ঢোলডান্ডা গাঁয়ের মেয়ে মরদরা একে একে চান করতে আসছে। কাপড় কাচছে। গরুর গা ধোয়াচ্ছে।
সোঁওওওও করে নিমেষে অত বড় গাছ থেকে মাটিতে নামলো সুচেতা। মনটা ফুরফুরে। মুখ থেকে শুধু বেরোলো, চল। দুম করে গা ডুবিয়ে আসি।
জল দু’ফাঁক করে বাচ্চাদের মাঝপুকুরে যাওয়া দেখলে কে থামতে পারে? সুচেতার গা যেন আরও বেশি করে চুলকাচ্ছে। সূর্যটা যেন আরও কয়েকগুন তাপ নিয়ে শরীর পুড়িয়ে দিতে হাঁ করে আসছে। আহা, একবার চান করলে কিছুদিন তো নিশ্চিন্ত। জঙ্গলের মাঝেই যেন দু’হাত নাচিয়ে সাঁতার কাটছে সুচেতা।
সুচেতার জিদ জানে ভীমা। আর কোনও উপায় নেই বুঝেও বলে, একটু থাম। জামা, গামছাটা তো নিতে হবে?
সেই আছিলায় একবার জঙ্গলের একটু ধারে যায় ভীমা। গাছের আড়াল থেকে মেপে নেয়। তারপর গামছা, জামাকাপড়, তেল নিয়ে হাজির।
আচ্ছা এতটা যাবো, চান করবো, কিছু হবে না তো?
ভীমার ডান কাঁধের হাড় চেপে ধরে সুচেতা। আআআআ চিৎকার করে ভীমা বলতে থাকে, ছাড় ছাড়।
ভীমার শরীর একটু ভারী। কিন্তু তাতে সুচেতার কী? এমনভাবে ধরেছে যে ভীমা কাবু।
ওরে ছাড় ছাড়। নাহলে তোর ওপর পড়ব। তোরই কিন্তু হাত পা ভাঙবে।
ঘড়ির কাঁটায় তখন দেড়টার মতো। এসময় এখানে পারদ ৪৪ ডিগ্রিতে ধাক্কা মারে।
গাছের ছায়া সূর্য রশ্মির সঙ্গে লড়াই করতে করতে জীবনভর ক্লান্ত। তবু গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু সুচেতা ভীমারা ঠিক এতটা প্রকৃতির নয়। ভীমারও চান করতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই এমন নয়। সে সুচেতার মতো দুঃসাহসী হলেও ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষপাতী নয়।
দেখ, খোচরদের বুঝে ওঠা কঠিন। কদিন আগেই তো দেখলি, কী হল। গাছের মগডাল থেকে ওভাবে টারজানের মতো না লড়লে, কী হত কে জানে? পাল্টা নিতে কী কৌশল ফেঁদেছে কে জানে? যাওয়া কী ঠিক হবে?
প্রশ্নটা না করে পারল না ভীমা। সুচেতা একটু বিরক্ত হলেও প্রাণ খুলে হাসল। হাসির মধ্যেও যে এত অদ্ভূত তেজ থাকে তা আগে দেখেনি ভীমা।
ভীমা কথা না বাড়িয়ে বলল, চল, তোর ইচ্ছেই পূরণ হোক।
সুচেতা একটু গম্ভীর হয়েই বলল, আমি দেখে নিয়েছি চারদিক। জামাকাপড় আনতে গিয়ে তুইও তো দেখলি। টিকটিকি নেই। তবু এত ভয়! শোন, মেশিনটাও নে।
ভীমা কথা বাড়ায় না। সুচেতা সবদিনের একরোখা। গোঁ চাপলে ছাড়বে না। গামছা, তেল, জামার সঙ্গে মেশিনও নিল। জঙ্গল থেকে বেরোনোর আগে আর একবার জরিপ করে নিল সব কিছু।
গরুর গা ধুইয়ে ফিরছে বলাই সিং, চান্টু মুর্ম্মুর বৌ শবরী কাপড় কাচা শেষে সন্ধ্যা আর কচিকে নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই লু এসে মুখ পুড়িয়ে পালাচ্ছে। সারা মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক’টা গরু, ছাগল। শুকনো আলের দু’চার জায়গায় একটু সবুজ দেখে মুখ ঘষতে ঘষতে ঠোঁট আর মুখ ব্যাথা করছে। কিন্তু পেটের ক্ষিদে মিটছে না। এই সময়টা আবার টিকটিকিদের খাবার সময়।
অনেকটা নিশ্চিন্তেই বেরোলো দু’জনে। গল্প করতে করতে ছোট্ট খেজুর গাছটা পেরিয়ে পুকুরপাড়ে। চোখ লাটাইয়ের মতো ঘুরেছে মাঠ জুড়ে।
হঠাৎ ভীমা দাঁড়ালো। তা দেখে দাঁড়ালো সুচেতাও। ভীমা ঈশারা করল, পুকুরপাড়ের ওদিকটায় কেউ নেই তো? একটু দেখে নিই। ওদিকটায় আবার একটু ঝোপ থাকায় সামনের অনেকটা অংশ দেখা যায় না।
চারটে চোখ লাটাইকে হার মানায়। দু’টো ছাগল ঘাস খাচ্ছে। একটা গাই, সঙ্গে বাছুরও আছে।
সুচেতা ভীমার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, টিকটিকিরা থাকলে ছাগল, বাছুর এত নিশ্চিন্তে ঘাস খেতে পারত?
ভীমাও তার কথায় সাই দিল। সাহসে ভর করে দু’জনে পুকুরপাড়ে ওঠার আগে কানে কানে আর একদফা আলোচনা করে নিল। ভীমা চলে গেল দক্ষিণ দিকের কোনে। সুচেতা পাশের কাঁটাঝোপ থেকে পাতার ফাঁক গলে দেখে নিচ্ছে চেহারাগুলো। না, গ্রামেরই সবাই আছে। তবু ভরসা নেই। ঘাটের কাছেই মেশিনগুলো রাখবি। উত্তরের ঘাটটা ফাঁকা আছে। ওখানেই যাব চল।
ঘাটের কাছে গরুর পায়ের খুরে গর্ত হওয়া মাটি আর একটু ভেঙে মেশিনগুলো রেখে গামছা চাপা দিল সুচেতা। তারপর আধডোবা পাথরে বসে পা দুখানা জলের মধ্যে রেখে খেলা শুরু করল। কখনও ডান পা তো কখনও বাঁ তুলছে। জল নড়ছে। শরীর শীতল হচ্ছে।
হি হি করে হাসতে হাসতে ভীমাকে আদর মাখানো গলায় নির্দেশ দিল, এই গা টা ঘষে দে তো? আচ্ছা করে ঘষবি। যেন পুরনো সব ময়লা চলে যায়।
পরুল জালিতে সাবান মাখিয়ে সারা গা ঘষতে থাকে ভীমা। আহ, কী আরাম। এই পুকুর, মাঠ-ঘাট-জঙ্গল। এক সময় কত ঘুরেছে সুচেতা। যেখানে মন চেয়েছে সেখানেই গিয়েছে। আর এখন? এই পুকুরেই তো মা বাটি সাবান দিয়ে সারা গা ঘষে দিত দু’চার মাস ছাড়া। মাথা দিয়ে কালো জল বেরোতো। সবাই বলতো, এ মা বন-কুলির যত ধূলো সব তোমার মেয়ের মাথায় নাকি গো? মা বিরক্ত হয়ে বলতো, ঘষতে কী দেয় গো? এ যেন কুস্তি করা।
মাথায় সাবান ঘষলে যে ফেনা হয় ক’জন জানে এ গাঁয়ে? শুধু এ গাঁ নয়, আশপাশের বিশ পঞ্চাশ গাঁয়ের কেউ জানে না।
চোদ্দ কিলোমিটার দুরে বাঁশপাথর গ্রামের মন্ডলদের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল সুচেতার। হাতে গোনা বার তিনেক মায়ের সঙ্গে হাটে গিয়েছিল। বাবা মাঝেমধ্যে ফায়ফরমাস খাটতো বলে মন্ডল ঘরের ভেতর ঢোকার অনুমতি ছিল ওদের। একবার দুপুরে দেখেছিল, ওদের ঘরের মেয়েটা যখন স্নান করছিল তখন মাথায় থোক থোক সাদা সাদা কী যেন। মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা, দেখো, কেমন ম্যাজিক। মাথায় সাদা সাদা কেমন উঠছে। চুল দেখা যায়নি।
তখন হাসতে হাসতে মন্ডলগিন্নি বলেছিল, না গো, ম্যাজিক না। আমার মেয়ের আবার মাঝে মধ্যে শাম্পু না করলে চলে না। ওর জন্যেই তো ওর বাবা শহর থেকে এটা কিনে আনে। হাতে রাখলে চটচট করে। মাথায় দিলেই আদরে গলে এমন হয়।
মা-কে যেন চোখের সামনে দেখছে সুচেতা। টালির ছাউনি দেওয়া একখানা ঘর। তাতেই বাবা, মা, সুচেতা ও ভাই থাকত। বাঁদিকে ছাউনি বাড়িয়ে একটু ঘেরা। তারই এক জায়গায় উনুন। মা রান্না করে। পাশে চারটে ছাগল আর একটা গাই, বাছুর থাকে। গাইটা দুধ দেয়। তাই সহজে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় না। ঘাস কেটে, পাতা কুড়িয়ে ঘরে আনা হয়। খাওয়ানো হয়? তবে ছাগলগুলো চরাতে যেতে হয় জঙ্গলে।
গাঁয়ের ইস্কুলে এত নিয়মের বহর নেই। তাই ছাগলগুলো পাশের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েই ক্লাসে বসত সুচেতা। মাঝেমধ্যেই জানালাহীন ক্লাসঘর থেকে দেখে নিত কত দূরে রয়েছে ছাগলগুলো ।
গ্রামের পাশেই ঘন জঙ্গল। দলমার দামাল হাতিরা আসে। বনশুয়োরও তো আছে। যদি মেরে ফেলে। গভীর জঙ্গলে হারিয়ে যায় ছাগল। আর ফিরে না আসে। তা অবশ্য আগে কখনও হয়নি। কিন্তু সেদিন একটি ছাগল বাচ্চাকে কিছুতেই খুঁজে পেল না সুচেতা। টিফিনের সময় থেকেই তাকে দেখতে পায়নি। সারা জঙ্গল চষে বেড়িয়ে সন্ধের মুখে বাকিদের নিয়ে ঘরে ফিরল। বাচ্চা ছাগলটাকে না দেখতে পেয়ে মা রেগে আগুন?
বাচ্চাটা কোথায় রে হতচ্ছাড়ি? হাত পা নাড়িয়ে নাচতে নাচতে চলে এলি যে!
সুচেতা বোঝানোর চেষ্টা করেছে, সেই টিফিনের সময় থেকে সারা জঙ্গল ঘুরে বেড়িয়েছে সে। কোথাও খুঁজে পাইনি। সঙ্গে তার মাও উঁহুঁহুঁহুঁ করে ডেকেছে। তবু সাড়া দেয়নি। সন্ধে হলে আবার কী বিপদ হবে কে জানে? তাই আর সে দেরি না করে বাকিদের নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
বৃষ্টি হলে বছরে একবার ধান চাষ হয়। নাহলে সব গেল। জঙ্গলের কাঠপাতা কুড়িয়ে সংসার চলে। সারাদিন জঙ্গলের কাঠ-পাতা কুড়িয়ে বোঝাই করে আনার সময় কতবার যে ফরেস্টার কেড়ে নেয় তার হিসেব রাখে কার সাধ্য! তাই তো গরু, ছাগল চাষ। যদি দু’টো পয়সা মেলে। সেই ছাগলের বাচ্চা হারালে কার মাথার ঠিক থাকে?
মায়ের মাথায় আগুন। হাতের কাছে থাকা ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে গেল, তোর মতো তো ও ঘরের খায়নি। জঙ্গলের খেত। বড় হয়ে টাকাও দিত। ওকে আনতে পারলি না তো নিজে এলি ক্যানে? ঘরের অন্ন ধ্বংস করতে? এখুনি চলে যা। ছাগল না পেলে ঘরে ঢুকবি না। তোর মুখ দেখতে চাই না।
মা যতটা চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলেছিল, মেয়ে কথাগুলো মন দিয়ে শুনেছিল তার থেকে অনেক বেশি শরীর শক্ত করে। ঝাঁটার বাড়ি তার গায়ে লাগেনি। মনে লেগেছিল। একটি শব্দও উচ্চারণ না করে সে শান্তভাবে মায়ের দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। ঝাঁটা মারতে মারতে মা যখন হাঁপিয়ে পড়েছিল, তখনও সে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। মা ঘরে ঢোকার পর উল্টোদিকে হাঁটা দেয়। কাঁকর বিছানো পথে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ। মাঝ মাঠ পেরিয়ে, খেজুর গাছটা ছাড়িয়ে পুকুরের ধার দিয়ে জঙ্গল। জঙ্গলে ঢোকার আগে একবার খড় আর টালির ছাউনি ঘেরা গাঁ-টার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর ফ্রক পরা চার ক্লাসের মেয়েটা একটার পর একটা গাছ পিছনে ফেলে ছোট্ট টিলাটা ছাড়িয়ে গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে ঢুকে গেল। জন্ম থেকে জঙ্গলের পাশে বাস করা মেয়েটির এত গভীর জঙ্গলে ঢোকা এটাই প্রথম।
কতটা হেঁটেছে সে? আর কী ফিরতে পারবে কখনও? ভাবতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে বলেছিল, মা, অন্ন ধ্বংস করতে আর কখনও ফিরব না।
দু’হাতে চোখ চেপে কতক্ষণ কেঁদেছিল মনে নেই। সেই যে সকালে দু’মুঠো মুড়ি খেয়ে ছাগল নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল, সে কথাও ভুলে গিয়েছিল। এ পেটে ছুঁচোরাও ডন টানতে আসে না। হয়তো তারা জানে, এখানে ডন টানা বেকার।
রাতের জঙ্গলের একটা নিজস্ব সুর থাকে। যা একেবারেই প্রকৃতির নিজস্ব। সে সুর কাটলো একজনের ডাকে। চমকে উঠল সুচেতা। এ যে মানুষ! এত গভীর জঙ্গলে এত রাতে মানুষ কেন? হাতি, বনশুয়োরের কথা শুনেছে। বড়বড় শিয়াল, অজগর সাপের কথাও জানা। সে সব দেখলে দেখলে অন্য অনুভূতি। জঙ্গলে সেটাই দস্তুর। কিন্তু মানুষ?
ওই বয়সে ভাবার মতো আছেই বা কী?
তার আগেই মমতা-মাখা পুরুষকন্ঠ বলে উঠল, কে মা তুমি? এত রাতে এখানে কী করছো?
মা এর কাছ থেকে তীব্র যন্ত্রণায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসা বালিকা কারও মা হতে পারে? গাঁয়ের কাকা-জ্যাঠারা মা বলে ডাকত, সেটা তার শোনা। কিন্তু একজন অচেনা মানুষ! তাহলে এও কী তেমনই কেউ?
দু’পায়ে রাখা মুখটা তুলে ভয়ে ভয়ে তাকানোর চেষ্টা করল সুচেতা। তখনও তার গাল থেকে মুখ, চোখেরও অনেকটা ঢাকা নিজের দু’হাতের মুঠোয়।
আবার তিনি বললেন, আমার সঙ্গে এসো। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি বুঝি?
তখনই পেটের ভেতর থাকা খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। কিছু না বলে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।
বয়স্ক মানুষটি তার পাশে বসে পিতৃ স্নেহে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর হাত ধরে চলল। জঙ্গলের পাশে বাস করেও কোনদিন বুঝতে পারেনি জঙ্গলও এত গভীর হতে পারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কোনও আলোর রেখা নেই। শুকনো পাতার উপর ঝুপঝুপ পা ফেলার শব্দ শুধু। মাঝে মাঝে খড়খড় শব্দ। হয়তো কোনও প্রাণী চলে যাচ্ছে নিজেদের খুশি মতো। এটা তো তাদেরই জায়গা। জোর করে ঢুকে পড়েছে সে। এভাবেই চলতে চলতে পৌঁছলো জঙ্গলের ভেতরে থাকা একটি নীচু জায়গায়। অনেকটা অংশ জুড়ে গাছ নেই। দু’তিন জায়গায় ছোট ছোট ত্রিপল খাটানো। তাঁবুর মতো। তাঁবুর বাইরে বসে জনা কয়েক। তাদের মধ্যে মেয়েও আছে।
একটি খাটিয়ায় তাকে বসতে বলে লোকটি চলে গেল দু’জন মেয়ের কাছে। কি যেন বলল অস্ফুটে। দু’টি মেয়েই চলে এলো তার কাছে। নানা গল্প করতে থাকলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আদরে। রুটি আর আলু ভাজা খাইয়ে পাশে শুয়ে ঘুমও পাড়িয়ে দিল। ঠিক যেমনটা মা করত। কখন যে যে ঘুমিয়ে পড়লো কে জানে।
তারপর ইতিহাস। প্রতিদিন এক অন্য শৃঙ্খলায় জীবন যাপন। যা বোঝার সাধ্য তার ছিল না। প্রথম খটকা লেগেছিল পোশাকে। এরা তো গাঁয়ের লোকজনের মতো তেমন করে শাড়ি পরে না। কিন্তু তা নিয়ে ভাবার মতো সময় মেলেনি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই দেখলো একজন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলছে, আর নয়। এখুনি গোটাতে হবে। টিকটিকি লেগে গেছে।
কয়েক সেকেন্ডই লেগেছিল মাত্র। ত্রিপল, উনুন, কাঠ, জামাকাপড় আর একটি বস্তায় কিছু লুকোনো জিনিস নিয়ে দ্রুত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল সকলে। শুধু কয়েকজনকে দেখল হাতে বন্দুক। যা আগে পুলিশের হাতে দেখেছিল। এভাবে প্রায় ঘন্টাচারেক। কোনদিকে হেঁটেছিল, কোথায় গিয়ে পৌঁছল তার কিছুই জানে না সে।
পরে জেনেছিল যে লোকটি তাকে সেই রাতে হাত ধরে এনেছিল তার নাম চন্দন। প্রতিদিন সকালে পড়াতো। সে পড়ার মধ্যে ছিল বয়ে চলা জীবন। যার শুরু হয়েছিল দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাওয়া দিয়ে। প্রশ্ন করত নিজেই। দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাস? রেশনে চাল, গম, চিনি, কেরোসিন পাস। হাসপাতালে চিকিৎসা? গাঁয়ে জলের কল আছে? জল পড়ে?
উত্তরও দিত নিজেই। না, কিচ্ছু নেই। অথচ, সব কিছুর জন্যই নাকি টাকা আসে! টাকা দেয় সরকার। কিন্তু গরিব মানুষ নাকি তা পাই না।
শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, এক অন্য জগৎ। গাঁয়ে কখনও একথা শোনেনি। একথা বলেনি কেউ। জঙ্গলে বসে থাকা মানুষগুলো জানলো কী করে? চন্দনই তার উত্তর দিয়েছিল, বদলে দিতে হবে। পাল্টে দিতে হবে। তার জন্যই তো লড়াই। কেউ কিছু দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। তার জন্যই অস্ত্রও ধরতে হবে।
ছোট্ট চার ক্লাসের মেয়েটা একটু একটু করে বাড়ছে। হাত শক্ত হচ্ছে বন্দুকের হাতলে। এক সময় বন্দুক কথা শুনতো ওই সরু আঙুল গুলোর। গুলি কথা শুনতো চোখের চাউনির। জঙ্গল ফাটিয়ে হাসতে হাসতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল চার ক্লাসের মেয়েটা, আমি পারি। পারব। কে আছো আমায় আটকে দেখাও।
বহু লড়াইয়ে প্রশিক্ষিত কেন্দ্রীয় বাহিনী পিছু হঠছে। নিশানা ছিল অব্যর্থ। রোগা লিকলিকে মেয়েটা সাঁ সাঁ করে গাছে উঠতে পারে। এক দৌড়ে জঙ্গল ভেদ করে পালাতে পারে আর এক জঙ্গলে। গাছও টের পায় না।
এমন সময় ভীমা বলে উঠল, আর কতক্ষণ ঘষব রে হতচ্ছাড়ি। আজই কী ধরা পড়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
হুঁশ ফিরল সুচেতার, চল এবার জলে নামি। সূর্যের তাপে জলও তেতে। জলের গভীরে ডুব সাঁতার দেয় সুচেতা, ভীমা। শ্বাস বায়ু শেষ হলে জলের ওপরে মুখ তোলে। পুকুর পাড়ের দিকে চোখ চলে যায় ভীমার।
এই সুতা দেখতো, ওটা কে রে? সুচেতার নামটাকে এভাবেই ছোট করে সুতা বানিয়েছিল ভীমা।
দেখ তো কোনও খোচর নাকি?
সুচেতার চোখ লাটাই হয়ে বোঝার চেষ্টা করে। না না। কারও ঘরের জামাই টামাই হবে। এই তো পরপর ক’জনের বিয়ে হল। শুনলি তো।
ভীমার মন কূ গাইছে। জামাইরা এলে এমন পাজামা পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়ায় ঠিক, তাই বলে পুকুর পাড়ে আসবে কেন? দেখ না কেমন দামি পাঞ্জাবী মনে হচ্ছে।
সুচেতার স্মার্ট উত্তর, শুনেছি গয়েশকাকার মেয়ের নাকি শহরে বিয়ে হয়েছে। হয়তো ওদের ঘরের জামাই। গাঁয়ের পুকুর দেখেনি। চান করা তো দুরের কথা।
গাঁয়ের মেয়েরাও তো চান করছে? জামাইয়ের কী লজ্জা সরম নাই নাকি? নতুন জামাই যে লা। ভীমাও সপাটে জবাব দেয়।
কথাটা ভুল নয়। এভাবে গাঁয়ের জামাই পুকুরে এসে মেয়েদের স্নান করা দেখবে, এটা তো গাঁয়ের চালচলনে নেই। তাছাড়া নতুন জামাই একা বেরোবে কেন? সঙ্গে শ্যালিকা, শালারা তো থাকবে?
প্রথম ঝটকা লাগলো সুচেতার। নিমেষে বলল, ভীমা ডুব মার। ডুব দিয়ে ঘাটের দিকে এগো।
সুচেতার অর্ডার মতোই কাজ হল। মাঝপুকুর থেকে ঘাটের অনেকটা কাছে পৌঁছল এক ডুবে। জল থেকে মাথা তুলতেই দেখল জলপাই পোশাক!
এখন কী করবে? মেপে নিল দূরত্ব। ওই ঘাট থেকে পুলিশ দৌড়ে এলেও মিনিট পাঁচেক তো বটেই। ওরা সাঁতরে গেলে মিনিট তিনেকে ঘাটে পৌঁছবে।
ঘাটে পৌঁছনোর সিদ্ধান্তই নিল সুচেতা। ভীমাকে বলল, মার ডুব। এক ডুবে ঘাটে। উঠেই সোজা মেশিন ধরবি। আমি আছি জানলে পুলিশ বাড়াবাড়ি করবে না। ভুলে যাস না, গাঁয়ের জনা কুড়ি মেয়েমরদ এখনও ঘাটে। গুলি চালালে সবাই মরবে!
যেমন নির্দেশ তেমন কাজ। জলের ভেতরে থাকা ওই কঠিন সময়ে শপথও নিল। গরমে যত কষ্টই হোক না কেন আর কখনও স্নান করতে আসবে না। কিন্তু এবার তাকে পালাতেই হবে। ছকও কষেছিল জলের ভেতরেই। উঠেই কিভাবে দৌড়ে ঘাটে যাবে। কিভাবে ফায়ার শুরু করবে। তারপর কোন দিকে পালাবে। যাতে পুলিশ ডেরা না বুঝতে পারে।
ডুব সাঁতার থেকে উঠেই সুচেতা যা দেখল, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। পুকুরের চারদিক তখন জলপাই আর জলপাই। পৃথিবীতে অন্য কোনও রঙ থাকতে পারে ওখানে স্বপ্নেও ভাবা অসম্ভব।
এবার? সুচেতার দিকে তাকিয়ে ঈশারা করল ভীমা।
পাল্টা ঈশারা না করে ধীরে ধীরে জল ভেঙে ঘাটের দিকে এগোলো সুচেতা। মেশিন তখনও কয়েক হাত দূরে। তার আগেই মহিলা পুলিশ এসে ভেজা কাপড়-সহ জাপটে ধরল। একই অবস্থা ভীমারও। তারপর আর কেউ কাউকেই দেখতে পেল না। নিমেষে দু’জনকে দু’দিকে নিয়ে উধাও যৌথবাহিনী।
সুচেতা ভাবতে থাকে ভীমার কথা। আর ভীমা সুচেতার কথা। চলতে চলতে বছর দশেক গড়িয়ে গেল। সুচেতা তখন জেলে। খবর গেল, এবার মাওবাদীদের কয়েকজন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদি তারা মূলস্রোতে ফিরতে চায়। সরকারই সব ব্যবস্থা করবে। সেই তালিকায় সুচেতার নামও রয়েছে। সুচেতাকে রাখা হল শহরের একটি হোমে। না, সবার সঙ্গে দেখা নয়। যদি কেউ দেখা করতে আসে তাকেও নজরদারির তালিকায় রাখা হবে। আরও তিন বছর কাটলো এভাবে।
দ্বিতীয় তালিকায় ভীমার নাম। কাকতালীয় হলেও ভীমাও হাজির হল সেই হোমে। দু’জনের সেই আলিঙ্গন যেন যুগযুগ ধরে চলছে। জড়িয়ে ধরে দু’জনের মুখ দু’দিকে। চলছে তর্কটাও। তোর জন্যেই আমরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লাম। চান করতে না এলে কী এমন হত?
হাসতে হাসতে সুচেতা বলছে, তুই যদি এতক্ষণ ধরে আমার মাথা না ঘষে দিতি কখন আমরা স্নান করে ফিরে যেতাম। পুলিশ টেরও পেত না। আর যদি মাঝপথে দেখা হত? তাহলে আবারও পুলিশকে বুঝিয়ে দিতাম, সুতার আঙুল আর দৃষ্টি কখনও ভুল করে না।
এত বছর পরেও সুচেতার একই জিদের কথা শুনে চমকে ওঠে ভীমা, সে কি রে? এখনও মনের মধ্যে...?
না, এটা সুচেতার পুরো মনের কথা নয়। তাই মায়ের প্রস্তাবটা নিয়েও এখন মাঝে মধ্যে। মা গ্রামের বাড়িতেই আছে। কষ্ট একই রকম। সব শুনে একজন বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। কিন্তু বিয়েতে এখুনি রাজি হয়নি সুচেতা। বিয়ে করে চলে গেলে তো সংসার করতে হবে। মাকে দেখবে কে?
আমি আরও একটু ভাবছি বলে মুচকি হাসে। সে হাসির মধ্যে গুলি বেরোনোর মতো ঝাঁঝ নেই। পারিবারিক এক মাদকতা আছে।
….


