সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে বনিকদের আনা খাদ্যবস্তুই  এখন বাংলার নিজস্ব খাবার

সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে বনিকদের আনা খাদ্যবস্তুই  এখন বাংলার নিজস্ব খাবার
07 Nov 2021, 05:46 PM

সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে বনিকদের আনা খাদ্যবস্তুই  এখন বাংলার নিজস্ব খাবার

 

 

অমিতাভ হালদার  

 

 

 

‘শক হুন-দল পাঠান মোগল’ সবাই ভারতে এসে  এক দেহে হল লীন। ভারতে এসেছে ইংরেজ, পর্তুগীজ , ফরাসিরাও । তারা শুধু ‘ সাত সাগর তেরো নদী’ পার হয়ে এদেশে আসেনি, সঙ্গে নিয়ে আসে তাদের সংস্কৃতি । এমনকি নানা খাবারও।  সেই সব খাবার বাইরে থেকে এলেও এখন সেগুলি স্থান পেয়েছে বাঙালির থালায়।

 

কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। এই সঙ্গে একটু আলু সিদ্ধ আর পোস্ত বড়া হলে তো ‘ পুরো জমে ক্ষীর’।

আর শুনতে বা মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি  যে আমাদের, বিশেষ করে বাঙালিদের,  প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় যে খাবার আমরা খাই তার এক বৃহৎ অংশ এসেছে বিদেশ থেকে। বিশেষ করে সব্জি ও ফল । এরা আমাদের এত পরিচিত ও বাঙালিয়ানায় ভরপুর যে এদের নাম শুনলে অধিকাংশ বাঙালি বা ভারতীয় বিশ্বাস করবে না বা গাজাখুরি তথ্য বলে ভাববে । এই মুহূর্তে আমাদের খাবারের থালায় থাকা খাদ্যের প্রায় ৬০-৭৫ শতাংশ খাদ্যবস্তু এসেছে ভারতের বাইরে থেকে,। আর সেগুলি এনেছেন এদেশে বানিজ্য করতে আসা বনিকেরা।

প্রথমেই নাম করি যে বস্তুটির সেটা হলো আলু। প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার  বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার  পেরুর রেড ইন্ডিয়ানরা আলুর চাষ শুরু করেছিল  আন্দিজ পর্বতমালার ঢালে ও পাদদেশে । ১৫শ শতকে স্প্যানিশরা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা থেকে আলু নিয়ে আসে ইউরোপে । ভারতে আলু প্রবেশ করে ১৭ শতকে।   পর্তুগিজ বনিক বা জলদস্যুদের মাধ্যমে । যারা এর সাথে পরিচিত হয়েছিল পাশের দেশ স্পেন থেকে । এই মুহূর্তে আলু পৃথিবীর চতুর্থ প্রধান খাদ্য – ভাত, গম, ভুট্টার পরে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০০০ বিভিন্ন প্রজাতির আলু চাষ হয় এবং মানব প্রজাতির (বাঙালি তো বটেই ) দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এর গুরুত্ব কি তা বলা নিষ্প্রয়োজন । আলু শুধু সুস্বাদুই নয় ,অন্যতম পুষ্টিকর ও ক্যালরি সমৃদ্ধ এক খাদ্যবস্তু। ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসকরা অনেকেই আলু আর ভাত নিষেধ করেন । রুটি খেতে বলেন। কিন্তু ১০০ গ্রাম আলু ও গমে ক্যালরির পরিমান যথাক্রমে ৭৭ ও ৩৩০ কিলো ক্যালরি এবং কার্বোহাইড্রেটের পরিমান ১৭ ও ৫৬ গ্রাম । অর্থাৎ যিনি রুটি খান তিনি রুটির বদলে সমপরিমান আলু খেলে তার খাদ্যে অনেক কম ক্যালরি ও কার্বোহাইড্রেট থাকার সম্ভবনা ( এই প্রসঙ্গে একটি কথা জরুরী – আলুর গ্লাইসেমিক্স ইন্ডেক্স গমের চেয়ে বেশি , এটা রক্তে সুগার বাড়াতে পারে ) ।

বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ( লাইকোপেন ) ও ভিটামিনসমৃদ্ধ সব্জির মধ্যে অন্যতম হল টমেটো । এই অতি পরিচিত সব্জিটি প্রথম চাষ শুরু করেছিল দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার পেরু ও ইকুয়েডরের আদি রেড ইন্ডিয়ানরা ও মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো অঞ্চলের আজটেক সভ্যতার রেড ইন্ডিয়ান্ জাতির মানুষেরা। আজটেকদের এক প্রচলিত ভাষা ‘নাহুটি’ তে tomati , স্প্যানিশে  পরিবর্তিত হয়ে হয় tomate , সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় এল tomato । বলা বাহুল্য  পর্তুগিজ বনিকদের হাত ধরেই এই পরিচিত ফল বা সব্জিটি আমাদের দেশে আসে। ষোড়শ শতাব্দীতে বম্বে বন্দরের আশেপাশে প্রথম টমেটোর চাষ শুরু হয়। আর টমেটো সস আমেরিকানদের আবিস্কার।

 

পেঁপে । হ্যাঁ  ঘোরতর বাঙালি ও ভারতীয় ফল পেঁপে আমাদের দেশের ফলই নয়। উদ্ভিদবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে এরও আদি উৎপত্তি বা চাষ শুরু করেছিল মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে রেড ইন্ডিয়ান জাতির মানুষেরা । সেখান থেকে স্প্যানিশদের হাত ঘুরে ব্রিটিশ ও ডাচ ঔপনিবেশিকদের দ্বারা এই ফল পৌঁছায় কারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয়েশিয়ায়। এরাই ১৫৫০ নাগাদ এই সুস্বাদু ফলকে নিয়ে আসে ভারতবর্ষে । ভারত থেকেই পেঁপে চীনে গিয়েছিল।  এবং ভারতেই  বর্তমানে পেঁপের সবচেয়ে বেশি চাষ হয়।  প্রাচীন মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানরা জেনেছিল কাচা বা পাকা পেঁপে দিয়ে মাংস ম্যারিনেট করে রাখলে বা সেদ্ধ করলে মাংস খুব তাড়াতাড়ি সুসিদ্ধ হয়। কয়েক হাজার বছর পর আমাদের রান্নার কড়াইয়ে আজও আমরা একই পদ্ধতি ব্যবহার করি। পেঁপে ভিটামিন সি, এ এবং অ্যান্টিওক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এক পরিচিত সুস্বাদু ফল ।  গ্রাম বাংলার প্রায় সব বাড়িতে দেখা যায় এই গাছ।

পেয়ারা মতো অতিপরিচিত ফলের উৎস সন্ধান করলেও বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এই ফলটিও এসেছে আমেরিকা ভুখন্ড থেকে। এর আদিম বাসভুমি মেক্সিকো, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর অঞ্চল । পেরুতে ৪৫০০ বছর আগে পেয়ারার ফলন শুরু হয়েছিলো । ১৮শ শতকে পেয়ারার চাষ শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। ভারতে এই ফলটি নিয়ে আসে পর্তুগীজরা ১৭শ শতকে ।

আমাদের খুব জনপ্রিয় ফল কলা। না, এটাও ভারতের নয়।  কলার আদিমতম  উৎস স্থল অস্ট্রেলেশিয়ার পাপুয়া নিউগিনি। নিউগিনির কুক সোয়াম্প অঞ্চলে যে ফাইটোলিথ পাওয়া গেছে তার থেকে জানা যায় প্রায় ৮০০০- ১০০০০ বছর আগে পাপুয়া নিউগিনিতে কলা ফলত। এখান থেকে ফলটি আসে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, মালয় উপদ্বীপে এবং মালয় উপসাগরের ও ভারত মহাসাগরের বানিজ্য পথ ধরে অস্ট্রোনেসিয়ান বনিকদের মাধ্যমে কলার প্রসার ঘটে দক্ষিন এশিয়া,  ভারত উপমহাদেশ, আফ্রিকা,  পশ্চিম এশিয়া  ও এশিয়ার অনান্য অংশে। পাকিস্তানের কোটদিজিতে খনন করে যে ফাইটোলিথ পাওয়া গেছে তা সিন্ধু সভ্যতায় প্রায় ৫৩০০ বছর আগে কলার উপস্থিতি প্রমাণ করে।  ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বে কলার সর্বাধিক উৎপাদনকারী দুটি দেশ হলো ভারত ও চীন (৪০%)।

 

ঝিঙে ( Sponge gourd ) সব্জিটিরও উৎপত্তি দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় । স্প্যানিশরা এটাকে নিয়ে যায় আফ্রিকায় । মিশর থেকে ঝিঙ্গে ইউরোপে প্রবেশ করে ১৬ শতাব্দীতে এবং খুব সম্ভবত পর্তুগিজ বা ইংরেজ বনিকেরা এটাকে নিয়ে আসে ভারতে।

 

শীতকালে বাঙালির রান্না মানেই ফুলকপি এবং বাঁধাকপি । এই বাঁধাকপিও ( cabbage) আমাদের দেশের সব্জি নয়। প্রায় তিন  হাজার বছর আগে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ও উত্তর পশ্চিম ইউরোপে এক ধরনের বন্য বাঁধাকপির চাষ শুরু হয়।  ইউরোপ থেকে এই সব্জি আসে আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশে মুলত বনিক ও ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে। ১৫শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যে এই উপনিবেশিকরাই ভারতবর্ষে বাঁধাকপির আবির্ভাব ঘটায় । ১৮শ শতকে বাঁধাকপি ভারত থেকে যায় জাপানে এদের হাত ধরেই।

 

বাঁধাকপির  মতো ব্রাসিকা গ্রুপের আর একটি অতি সুস্বাদু ও বহুল পরিচিত সব্জি ফুলকপি ( cauliflower )। ফুলকপির চাষ ও ভক্ষন প্রথম শুরু করে ভূমধ্যসাগরের এক ছোট্ট দ্বীপ সাইপ্রাসের লোকেরা। ঐতিহাসিক প্লিনির লেখায় এর উল্লেখ আছে ,  গ্রিকরা  এই সব্জি খাদ্য হিসাবে খুব পছন্দ করত । ১২শ -১৩শ শতকের আরব উদ্ভিদবিদ ইবন-আল-আজম ও ইবন-আল-বাতরের লেখায় পাওয়া তথ্য অনুসারে,  মধ্যযুগে সাইপ্রাস থেকেই এই আনাজ আরবে প্রচলিত হয়।  কিন্তু অবাক করা তথ্য হলো তারপর আরব বনিকরা ও আরব আক্রমনকারীরা কিন্তু একে নিয়ে আসে নি  ভারতের রান্নাঘরে। ভারতের মাটিতে ফুলকপির চাষ শুরু হয়েছে নাকি মাত্র ১৫০ বছর আগে। ডাঃ জেমসন ১৮২২ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফুলকপি নিয়ে আসেন ভারতের উত্তর প্রদেশে, এবং সাহারানপুরে নাকি প্রথম ভারতীয় ফুলকপির ফলন শুরু হয়।

বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তানে প্রথম গাজরের ( carrot) চাষ শুরু হয়েছিল আজ থেকে অন্তত ছহাজার বছর আগে। প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির বেশ কিছু জায়গায় ৪০০০-৫০০০ বছরের পুরানো গাজরের বীজ পাওয়া গিয়েছে।  ১ম শতকে রোমানদের লিপিবদ্ধ করা বিবরনে গাজরের উল্লেখ আছে।  ৮ম শতাব্দীতে আরব মুরদের দ্বারা গাজরের প্রবেশ ঘটে  আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় – স্পেনে। প্রাচীন গাজরের রঙ ছিল বেগুনী । এখন যে গাজর আমরা খাই সেই কমলাবর্ণের গাজরের চাষ শুরু হয়েছিল  আফগানিস্তানেই,  দশম –একাদশ শতাব্দী নাগাদ। ভারত ও এশিয়ার অনেক স্থানে দশম শতক নাগাদ যে গাজর ফলত তার রঙ ছিলো বেগুনী । ১১ -১২শতকে ইজরায়েল ও গাজা পালেস্টাইন অঞ্চলে লাল ও কমলা দুই প্রকারের গাজরের কথা পাওয়া যায় । আরব-আন্দালুস অঞ্চলের ইবন-আল-আজম ও ইবন-আল-বাতরের লেখাতেও একই কথা পাওয়া যায়। ১২শ শতাব্দী নাগাদ চিনের নদী অববাহিকায়  ও ১৬শ -১৭শ শতাব্দীর সময়ে জাপানের কৃষিক্ষেত্রে গাজর ফলতে শুরু করেছিল।

 

আনারস (pine apple ) আমাদের দেশের ফল নয়। যতদূর জানা যায়, ব্রাজিল ও  প্যারাগুয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পারানা-পারাগুয়ে নদী অববাহিকায় প্রথম আনারসের চাষ শুরু করেছিল সেখানকার রেড ইন্ডিয়ান জনজাতির মানুষরা । এখান থেকে এই ফল ছড়িয়ে পড়ে সারা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-৮০০ অব্দের মধ্যে পেরুতে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০০সাল নাগাদ মেক্সিকোতে এর ফলন শুরু করেছিলো ইনকা ও আজটেক রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতার মানুষরা। সভ্য জগতের বা ইউরোপের মানুষদের মধ্যে কলম্বাসই প্রথম আনারসের সাথে পরিচিত হন । ১৪৯৩-র ৪ নভেম্বর যখন তিনি গুয়াদেলোপ দ্বীপে পৌঁছান  । ১৫৫০ সাল নাগাদ পর্তুগিজ বনিকেরা আমাদের দেশে নিয়ে আসে আনারস। এবং ভারতের পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে এর আবাদ শুরু হয়। স্প্যানিশরা একে বলত pina , পর্তুগীজ ভাষায় abacaxi , ডাচ ও ফরাসিরা ডাকত  anas নামে। এই শব্দগুলোই বিবর্তিত হয়ে আনারস বা pine-apple হয়েছে।

আলুর কথা আগেই বলেছি । এবার রাঙ্গালুর ( sweet potato) কথা শুনুন। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে রাঙ্গালুর চাষ শুরু হয়েছিলো । প্রায় একই সময়ে ইউকাটান উপদ্বীপ ও মেক্সিকোর অনান্যস্থানে রাঙ্গালুর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায় । এখান থেকেই এই মিষ্টি আলু পৌঁছায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ,  ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ও ইউরোপে । কলম্বাস ইউরোপীয়দের সাথে নবআবিষ্কৃত ভূভাগ থেকে আনা যে সমস্ত নতুন বস্তুর পরিচয় করিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলো এই খাদ্যটিও । যদিও আধুনিক গবেষণা বলছে, রাঙ্গালুর আদিমতম উৎস ভারতীয় উপমহাদেশ। আড়াই কোটি বছর আগেই গন্ডোয়ানা ভূভাগে মর্নিংগ্লোরি নামক উদ্ভিদ প্রজাতির উদ্ভব হয়।  এই মর্নিংগ্লোরি পরিবারের মধ্যে পড়ে রাঙ্গালু । উত্তরপূর্ব ভারতের মেঘালয়ে ২৫ মিলিয়ন বছরের পুরাতন মর্নিংগ্লোরি-র ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে।

আপেলের আদি জন্মভুমি মধ্য-এশিয়া । তিয়ানসান পর্বতমালায় ৪০০০- ১০০০০ বছর আগে এর চাষ আরম্ভ হয় । তারপর রেশমপথ ( silk route ) বেয়ে এই উত্তম উপাদেয় ফল পৌঁছয় পশ্চিম এশিয়ায়,  ইউরোপে ও আমেরিকায়। স্যামুয়েল ইভান স্টোকস নামে এক আমেরিকান ১৯১৬ সালে হিমাচল প্রদেশের থানেদার নামক এক পাহাড়ি গ্রামে প্রথম ভারতের আপেল গাছটি রোপন করেন। আমেরিকার লুসিয়ানা থেকে  রেড ডিলিসিয়াস ও গোল্ডেন ডিলিসিয়াস জাতের আপেল চারা নিয়ে এসে তিনিই প্রথম ভারতীয়দের আপেলের সাথে পরিচয় করান। ১৯২৬ সালে এই বাগানেই ফলে প্রথম ভারতীয় আপেল । ভারতপ্রেমী এই সাহেবের সম্বন্ধে আর একটি তথ্য হলো ইনি ভারতে এসেছিলেন কুষ্ঠ রোগীদের সেবায় জীবন অতিবাহিত করবেন বলে। স্টোকস হিন্দু ধর্ম গ্রহন করে সত্যানন্দ স্টোকস নাম নেন ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটেন।

বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশষ্য গম ।  খৃস্টপূর্ব ৯৬০০ এর কাছাকাছি সিরিয়ায় ও দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে প্রথম গমের চাষ আরম্ভ হয়। ৬৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই খাদ্য শষ্যের চাষ শুরু হয় গ্রীস , সাইপ্রাস ও ভারতীয় উপমহাদেশে ।

বিশ্বের তৃতীয় প্রধান খাদ্যশষ্য ভুট্টার প্রথম চাষ করেছিল মেক্সিকোর রেড ইন্ডিয়ানরা, ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বালসাস নদী উপত্যকায় । এই শষ্য ৬০০০-৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশেপাশে পৌঁছায় কলম্বিয়ায় । ৬৭০০ আগে  পেরু ও  ৪৫০০ বছর আগে আমেরিকার প্রায় সমস্ত  অঞ্চলে ভুট্টার ফলন শুরু হয়েছিল। এখন ভুট্টা আমেরিকার দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য শষ্য, গমের পরেই। ভারতে ভুট্টা নিয়ে আসে পর্তুগীজরা, ১৭ শতক নাগাদ।

আজকে দুনিয়ার প্রায় সমস্ত রান্না ঘরে প্রস্তুত হওয়া খাবারে লঙ্কা ( chilli pepper ) এক অন্যতম উপাদান। সমগ্র এশিয়া, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা , আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের মানুষ খাবারে ঝাল পছন্দ করেন। খাদ্যে ঝাল আমাদের স্বাদকোরককে উজ্জিবীত করে ও লালাগন্থি থেকে লালানিঃসরন ঘটিয়ে খাদ্যকে স্বাদযুক্ত ও রুচিকর করে তোলে। ভারতে লঙ্কা আসার আগে রান্না করা খাদ্যে ঝাল স্বাদ আনার জন্য ব্যবহৃত হতো গোলমরিচ । গোলমরিচ প্রচুর উৎপাদিত হত কেরালায় । প্রায় ৭৫০০ বছর ধরে লঙ্কার ব্যবহার হয়ে আসছে বলে জানা গিয়েছে । মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মানুষরা এর ব্যবহার শুরু করেছিল ৭৫০০ বছর আগেই। দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, বলিভিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির লঙ্কার উৎপাদন হত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কলম্বাসই প্রথম এই বস্তুটিকে নিয়ে আসেন ইউরোপে । স্পেন , পর্তুগাল , দক্ষিণ ইউরোপ ঘুরে এই লঙ্কা ভারতে ও এশিয়ার অনান্য স্থানে প্রবেশ করেছিলো ইউরোপীয় বনিকদের মাধমে। পনেরো শতকে ভারতে লঙ্কা নিয়ে আসেন পর্তুগিজ বনিকরা।

 

আর এক উপকারী মশলা মেথি বা fenugreek এর সাথে  ভারতের পরিচয় হয়েছিল বানিজ্যের সূত্রে। সুপ্রাচীনকাল থেকে মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়া ও সুমেরীয়ায় মেথির ব্যবহার হতো। ইরাকের তেল হালাল নামক স্থানে খনন করে ৬০০০ বছরের পুরাতন পোড়া মেথি পাওয়া গিয়েছে।

ধনে /ধনেপাতা ( coriander ) আরেক অত্যন্ত উপকারি রান্নার উপাদান। ধনেপাতায় আছে প্রভুত পরিমাণে ভিটামিন কে ,অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও খনিজ পদার্থ । এর আসল উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক আছে। ধনের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নমুনা পাওয়া গিয়েছে ইজরায়েলের  নাহাল হেমার গুহায়, যা ৬০০০-৮০০০ বছরের পুরাতন বলে প্রত্নতাত্বিকদের ধারণা। মিশরে তুতেনখামেনের সমাধিতে ধনের অস্তিত্ব প্রমান করে অতি প্রাচীনকালে উত্তর আফ্রিকায় ধনের চাষ ও ব্যবহার হতো । ইবেরাস পাপিরাসে পাওয়া ধনেপাতার উল্লেখও প্রমান করে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে মিশরে এর ব্যবহার হত । প্রধানত পশ্চিম-এশিয়া আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইয়োরোপে এর চাষ শুরু হয়েছিলো এবং ওই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সুপ্রাচীনকাল থেকে ব্যবসাবানিজ্যের সম্পর্ক থাকায় প্রাচীন যুগেই এই মশালা আমাদের দেশে আসে।

এই প্রসঙ্গে বলি , আমাদের অতি পরিচিত আরও কয়েকটি সব্জি যেমন বেগুন, কচু, লাউ, কুমড়ো , শুক্তোর উপাদান নিম,  করলা, উচ্ছে , নানা জাতের সিম ,বিন এবং ফলের মধ্যে আম - এদের আদি উৎপত্তিস্থল বা বাসভূমি এশিয়া , আফ্রিকা , ভারতীয় উপমহাদেশ । সে অর্থে এরা প্রকৃত ভারতীয় বা বাঙালি খাবার।

ওপরের তথ্যগুলো থেকে এইটুকু ধারনা করা গেলো যে অধিকাংশ বাঙালি ও ভারতীয় খাদ্যের উপকরণ বিদেশ থেকে এসেছে ।

অনেক ফল ও সব্জি , আনাজ সারা মানবজাতিকে চিনিয়েছে মধ্য, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার অর্ধ-সভ্য রেড ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর মানুষেরা। যাদের ইউরোপের শ্বেতাঙ্গরা বলতো অর্ধসভ্য , অসভ্য , বন্য । এবং যাদের সম্পদ , বাসস্থান , চারণভূমি , অরণ্য , দেশ, প্রাণ  সভ্য ইউরোপিয়ানরা কেড়ে নিয়ে এদের অস্তিত্বকে করে তুলেছিলো বিপন্ন , তারাই সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য রেখে গিয়েছে খাদ্যের সম্ভার। আজকের সভ্যদুনিয়ায় আমাদের খাবারের টেবিলে,  ফ্রীজে, বাজার ,রেস্টুরেন্টে বা মলে যে বিপুল বৈচিত্র্যময় খাদ্য সাজানো থাকে তাদের মূল উপাদান এই বুনো লোকগুলোই প্রথম আবিস্কার করেছিল কয়েক সহস্র বছর আগে, বিপদসংকুল অরণ্য , পাহাড়, তৃণভূমিতে খুঁজে খুঁজে ।

আর একটি কথা না বললেই নয়। সারা পৃথিবীকে এত অজস্র খাদ্যের সাথে পরিচয় করিয়েছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বনিক, জলদস্যু , অভিযাত্রী ,  আক্রমণকারীরা । আমাদের দেশে অধিকাংশ ফল ও সব্জি এনেছে পর্তুগিজ বনিকরা। ঔপনিবেশিকতা যেমন মানবসভ্যতার কালো অধ্যায় , তেমনি উপনিবেশিকরাই দুনিয়ার কোণে কোণে মানবজাতির কাছে নিয়ে গেছে নতুন নতুন খাদ্য,  নব-সংস্কৃতি, ভাষা , সারা পৃথিবীতে হয়ে চলা জ্ঞান, চিন্তা,  বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কার। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে এদের অবদানও অনস্বীকার্য। আর এদের হাত ধরে আসা খাবার এখন হয়ে গিয়েছেন বাঙালির নিজস্ব ।

 

( লেখক পেশায় নাট্যকর্মী)

Mailing List