মানভূমের লোকসংস্কৃতি ভাদুগানেও ধরা পড়লো বিপুল পরিবর্তন! হঠাৎ কেন এত পরিবর্তন? কারণ কী খরা, করোনা, লকডাউন, বধূ নির্যাতনের মতো ঘটনা

মানভূমের লোকসংস্কৃতি ভাদুগানেও ধরা পড়লো বিপুল পরিবর্তন! হঠাৎ কেন এত পরিবর্তন? কারণ কী খরা, করোনা, লকডাউন, বধূ নির্যাতনের মতো ঘটনা
আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, পুরুলিয়া
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানভূমের লোকসংস্কৃতি পুরুলিয়ার ভাদুগানেও পরিবর্তন। 'ভাদু' একটি কৃষি উৎসব। ভাদ্র মাসে ধান চারা সবুজ ও সতেজ হয়। মাঠ জুড়ে চাষীদের চোখে নতুন আশা ভরসা জেগে ওঠে। বর্ষা বা ভরা ভাদ্রে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলে এর নাম ভাদু উৎসব। আর এর গান হল "ভাদুগান"। এবার পুরুলিয়ায় অনাবৃষ্টির কারণে অনেক চাষি ধানের চারাই রোপন করতে পারে নি। তাই ভাদু গানেও এসেছে পরিবর্তন।
পুরুলিয়ার মেয়েদের কাছে ভাদু উৎসব খুবই জনপ্রিয়। এবার পুরোনো যে সকল ভাদুগাণ তাকে বাদ দিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন আধুনিক' ভাদুগান'। আর সেই ভাদুগাণে খরা করোনা-লকডাউন ও বর্তমান সমাজে অত্যাচারিত বধূ নির্যাতনের একাধিক গান তৈরি করে গাওয়া হল ভাদুর জাগরণে। এই উৎসবের কোন পুরোহিতের দরকার হয় না, কোন মন্ত্র - তন্ত্রও লাগে না।এই উৎসবের প্রধান সম্পদ "গান"।
ভাদ্র মাস শুরু হওয়ার সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ ভাদুর প্রতিমা আনার হিড়িক পড়ে যায়। সারা মাস সেই ভাদুর প্রতিমার সামনে বিশেষ করে সরাক, বাগদি, বাউরি সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সধবা, বিধবা, কুমারী সমস্ত শ্রেণীর মহিলারা একসঙ্গে জড়ো হয়ে ভাদু গান গায়। এবার সেই ভাদুগাণ পরিবর্তন করে তারা গাইছে এইভাবে-
"ভাদু কিসকে আলি
এতবড় খরার বাজারে সবাইরেই পকেট খালি।
ভাদু কিসকে আলি।
আবার তারা গাইছিল
"শাশুড়িতে ধরে মারে
শশুর কিছু বলে না
গুনের দেওয়র চোখ মারে মা
জানে পাড়া পরগণা।"
কিংবা
"এক পিঠ চুল আমার
পিঠের পরে রহে না
শাশুড়িতে তেল দেয় না
চুলের যতন জানে না।"
বর্তমানে জেলার এই লোকসংস্কৃতি গাণে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে মেয়েরা অভিযোগগুলি তুলে ধরেছে ।ভাদুগাণের পুরনো যে সকল গান শোনা যেত, তাতে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সমস্যা সহ সবুজ ধান চারা মনে আনন্দ জাগরণের গান গাইত। বিয়ের সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাবারা সেই সময় এক জামাই কে দুই কন্যা দান করতেন। তা ভাদুগানে তুলে ধরা হত এই ভাবে-
"কাশীপুরে দেখে আইলাম
দালান কোঠায় টিকটিকি
এমনই বাবার বিবেচনা
এক জামাইকে দুই বিটি"।
এই সকল পুরনো ভাদুগান ভুলে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে রাজনীতির প্রভাবও দেখা গেছে লোকসংস্কৃতি "ভাদুগানে"। আধুনিক মোবাইলে জিও
সিম নিয়েও তৈরি হয়েছে ভাদুগান।-
"ভাদু আমার তাকিয়ে দেখো
সিম এসেছে Jio
এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও।
গত বছর স্পীড ছিল না,
টু জি থ্রি জির জন্য
ফোর জি যখন এসে গেছে
এবার ব্যাপার অন্য ।"
এই ভাদুকে কেন্দ্র করে জেলায় অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বেশি প্রচলিত কাহিনীটি হল "পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজার ভদ্রেশ্বরী বা ভানু নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। বীরভূমের এক রাজপুত্রের সঙ্গেঁ তার বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়। বিয়ের দিনই বর আসার ঠিক আগে রাজপরিবারের সকলের অজান্তে আত্মহত্যা করে রাজকন্যা ভাদু। এর পিছনে রাজকুমারী অন্ত্যজ শ্রেণীর এক যুবককে ভালোবাসত। প্রেমের এই খবর ভয়ে রাজাকে বলতে না পেরে নিজেকে নিজেই শেষ করে ফেলেছে বলে প্রচারিত। রাজরানী এই সংবাদ পেয়ে মূর্চ্ছা যেতে থাকে। রানীর অবস্থা দেখে প্রজারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। তখন প্রজারা ঠিক করে ভদ্রেশ্বরীর বা ভাদুর স্মৃতি উৎসব করবে তারা। এই প্রস্তাবে রাজাও সম্মত হয়। তখন থেকেই গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হতে থাকল "ভাদু উৎসব ' ও তার গান। বর্তমানেও সেই উৎসবে কমতি নেই পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি "ভাদু গানে"।
জেলার লোকসংস্কৃতি ও ছৌ-ঝুমুর রির্সোস সেন্টারের গবেষক সুভাষ রায় বলেন, পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির মধ্যে "ভাদু উৎসব " একটি বড় উৎসব। এই উৎসবের মূল বিষয় "গান"। সেই গানে এবারে বধূ নির্যাতনের অত্যাচারের কথা, করোনা, লকডাউনের মত বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েরা তুলে ধরেছেন ভাদুগানে। এই গানের মাধ্যমে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জ্ঞান ও পারদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় শিল্পীদের মধ্যে। কারণ গান তৈরি করা থেকে সঠিক অর্থ, সুর, তাল, ছন্দ সমস্ত কিছুই ঠিকমত তৈরি করতে যথেষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন। যা দেখতে পাওয়া গেছে এই শিল্পীদের মধ্যে।


