প্রথম বুলেট ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা, আর তারপর...

প্রথম বুলেট ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা, আর তারপর...
ড: কাঞ্চন কুমার ভৌমিক
আমি ভারতীয় কৃষিবিজ্ঞানী। চাকুরীর সুবাদে প্রায় সমস্ত রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোরার ফলে সবরকম ট্রেনে যেমন হাইস্পীড এক্সপ্রেস ট্রেন (শতাব্দী এক্সপ্রেস, দুরন্ত এক্সপ্রেস, রাজধানী এক্সপ্রেস ইত্যাদি) আবার ট্রাম, ট্রয় ট্রেন, ন্যারো গেজ ট্রেন ইত্যাদিতে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা আছে।
কিন্তু বুলেট ট্রেন সে জাপানের হোক কিংবা রাশিয়ার। স্পীড ভারতীয় হাইস্পীড এক্সপ্রেস ট্রেনের (১১৫ কিমি প্রতি ঘন্টা) চেয়ে ৪-৫ গুন বেশী। আমরা যে ট্রেন গুলোতে চড়েছি সেগুলোর সর্বোচ্চ গতিবেগ ১০০ কিমি থেকে ১২০ কিমি প্রতি ঘন্টায়। তাই বুলেট ট্রেনের জন্য আরও উন্নত রেলপথ তৈরি করতে হয়।
বুলেট ট্রেন একটি অত্যাধুনিক ট্রেন। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই ট্রেন চালু আছে। জাপান, চিন, ফ্রান্সের মতো দেশে বুলেট ট্রেনে মানুষ যাতায়াত করে। এই ট্রেন প্রথম চালু হয়েছিল জাপানে। ১৯৬৪ সালে জাপানে প্রথম বুলেট ট্রেন চালু করেছিল। পরে আরও কয়েকটি দেশ এই ট্রেন নিজেদের দেশে চালানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে।
ভারত বা বাংলাদেশ এখনও বুলেট ট্রেন চালানোর পরিকাঠামো তৈরি করতে পারেনি। তবে ভারত কয়েক বছরের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু করতে চাইছে। এর জন্য পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিংজি আবের মধ্যে ভারতে বুলেট ট্রেন চালানোর ব্যাপারে কথা হয়েছে।
বুলেট ট্রেন হচ্ছে উচ্চ দ্রুত গতি সম্পন্ন ট্রেন। এই ট্রেনের গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার থেকে শুরু। এটা সর্ব নিম্ন গতিবেগ। যে ট্রেনের গতিবেগ ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার থেকে শুরু সেই ট্রেনকে বুলেট ট্রেন বলা যাবে। বর্তমানে যে বুলেট ট্রেন গুলো চলে তার মধ্যে কিছু ট্রেন আছে যেগুলোর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় ৬০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
জাপানে প্রথম বুলেট ট্রেন চালু হলেও এখন বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে চালানো হয়ে থাকে। Bullet অর্থাৎ গুলির মতো গতি হওয়ার জন্য এই ট্রেনের নাম দেওয়া হয়েছে বুলেট ট্রেন।
বুলেট ট্রেনের জন্য তৈরি রেলপথে ২৫০ কিমি প্রতি ঘন্টায় ট্রেন গুলো চালানো হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণ ট্রেনের রাস্তা আপগ্রেড করে প্রতি ঘন্টায় ২০০ কিমি গতিবেগে চালানো হয়। সাধারণত বর্তমানে বুলেট ট্রেন গুলো ২৫০ কিমি থেকে ৩০০ কিমি প্রতি ঘন্টা গতিবেগে চলে। তবে সবচেয়ে বেশি গতিবেগে বুলেট ট্রেন চলার রেকর্ড আছে সেটা হলো ৫৮১ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা।
বুলেট ট্রেন সাধারণ ট্রেনের থেকে অনেক সুবিধা দিয়ে থাকে। বুলেট ট্রেনে যাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধা অনেক বেশি। এর সাথে বিমানের তুলনা চলতে পারে।
বিমানের তুলনায় সস্তা যাত্রা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিমানের তুলনায় বুলেট ট্রেনে যাতায়াত করা বেশি সুবিধা। আপনি যখন কোনো ছোট শহরে যাবেন তখন সেখানে বিমান চলাচলের ব্যবস্থা না থাকতেও পারে, সেক্ষেত্রে বুলেট ট্রেনে যেতে পারবেন। কিন্তু বিমানের তুলনায় ট্রেনের ভাড়া কম। একটা বুলেট ট্রেনে ১০০০ জনের বেশী যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। যেটা একটা বিমানের তুলনায় অনেক বেশি। বুলেট ট্রেনের সিটগুলো বিমানের সিট এর মতো।
জ্বালানি: বিমানের তুলনায় বুলেট ট্রেনের জ্বালানি খরচ অনেক কম। বুলেট ট্রেনে বিমানের তুলনায় যাত্রী বেশি যাওয়ার কারণে খরচের তুলনায় আয়ের রেশিও বুলেট ট্রেনের বেশি। জাপান, চিন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, উজবেকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, সৌদিআরব, মরক্কো, নেদারল্যান্ড, স্পেন, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশে বুলেট ট্রেনে মানুষ যাতায়াত করে থাকে।
প্রত্যেক বুলেট ট্রেনে ড্রাইভার থাকে। কারণ ট্রেন নিরাপদে চালানোর জন্য অবশ্যই ড্রাইভারের প্রয়োজন। বর্তমানে চালকহীন বুলেটও ট্রেন চালু হয়েছে জাপানে।
বুলেট ট্রেনের সবচেয়ে দীর্ঘ বা লম্বা রাস্তার রেকর্ডটি চিনের দখলে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা রাস্তা চিনে অবস্থিত। এটি চিনের বেইজিং শহর থেকে গুয়াংঝু (Guangzhou) শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। বুলেট রেলওয়েটি ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম চালু হয়েছিল। এই রাস্তাটি ২২৯৮ কিলোমিটার লম্বা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সাথে বুলেট ট্রেনের ব্যাপারে ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০২২ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু করা হবে। কারণ, চলতি বছরটি হচ্ছে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর। এই বছরটি যে গৌরবেরও। তাই চলতি বছরে শুরু হলে তা হবে মাইল ফলক।
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গতির ট্রেন চীনে চলে। ট্রেনটির নাম সাংঘাই মেগ্লেব। কিন্তু জাপান ঘন্টায় ৪৫০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন চালানোর ট্রায়াল করে দিয়েছে।
সেবার সোভিয়েত রাশিয়ায় উজবেকিস্তানে আছি। যাব মোঘল সম্রাট বাবরের জন্মস্থান অর্থাৎ সমরখন্দ। সমরখন্দ আরো একটি কারনে বিখ্যাত, এখানেই তৈমুর লঙের বিশ্ববিখ্যাত সমাধিস্থল আছে।
সকাল সকাল তৈরি। তাসখন্দ শহরের বিখ্যাত তাসখন্দ রেলষ্টেশন থেকে বুলেট ট্রেন ছাড়বে। যথাসময়ে ষ্টেশনে হাজির। টিকিট আগেভাগেই এজেন্সিকে দিয়ে কেটে রেখেছিলাম। নির্দিষ্ট কোচের সিটে গিয়ে বসলাম। অবশেষে বুলেট ট্রেন ছাড়ল।
আমি সামনে লাগানো বোর্ডের স্পীডমিটার টায় বারবার চোখ রেখে চলছি। মুহুর্তের মধ্যেই স্পীড ৩০০-৩৫০ কিমি প্রতি ঘন্টা এবং আরো বাড়তে শুরু করল। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় কোনও ঝাঁকুনি বা শব্দ নেই। এতটাই বুলেট প্রুফ্। ভাবতেই পারছিনা।
ভিতরে প্রত্যেকের জন্য টিভি বা মিউজিক (সবরকম অপশান ) সিস্টেম আছে। চা এবং টিফিনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অবশেষে কত স্বল্প সময়ে বসতে না বসতেই ৪২৫-৪৫০ কিমি রাস্তা ১ ঘন্টা ২৫ মিনিটের একটু বেশি সময়ে পৌঁছে গেলাম। আমার জীবনে, ভারতবর্ষের বাইরে, বিদেশের বহু ফ্লাইটে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু বুলেট ট্রেনের ঝাঁকুনি বা সাউন্ড প্রুফ্ ভীষন সুন্দর ও অত্যাধুনিক। জাপান, রাশিয়া বা ইউরোপ আমেরিকার মতো আমাদের ভারতেও এই ধরনের হাইস্পীড বুলেট ট্রেন ভবিষ্যতে চালু হোক এই অপেক্ষায় থাকবো।



