উজ্জ্বলতা হারিয়ে ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে উঠছে পৃথিবী, ধ্বংসের ঠিক কতটা আগে দাঁড়িয়ে আছি আমরা

উজ্জ্বলতা হারিয়ে ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে উঠছে পৃথিবী, ধ্বংসের ঠিক কতটা আগে দাঁড়িয়ে আছি আমরা
ড.গৌতম সরকার
আধুনিক মানব জাতির অবস্থা ঠিক পূর্বাশ্রমের 'কালিদাস'-এত মতো, যে ডালে বসে আছে সেই ডালেরই আগায় নিরন্তর কোপ বসিয়ে চলেছে। কোপ পড়তে পড়তে ক্ষতবিক্ষত সেই ডালের এখন মূল গাছ থেকে খসে পড়ার উপক্রম। পৃথিবীও যত দিন যাচ্ছে ততই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, মানুষেরই কর্মফলে দিনদিন এই গ্রহ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। অথচ আজ থেকে ২০০ কোটি বছর আগে যখন ধীরে ধীরে এই গ্রহ ঠান্ডা হল, গড়ে উঠল বায়ুমণ্ডল, তামাম সৌরজগতের মধ্যে কেবলমাত্র এই গ্রহেই প্রাণের সঞ্চার ঘটা শুরু হয়েছিল। আর আজ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে আসছে, আগামী ২০০ কোটি বছর পর পৃথিবী আবার নিষ্প্রাণ হয়ে উঠবে। মাঝের এই ৪০০ কোটি বছরে মানুষের প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা লোভ, ভোগ, হিংসা, লালসা ফলে-ফুলে ভরা, শস্যশ্যামলা এক সপ্রাণ গ্রহকে শীতল, অন্ধকার, নিষ্প্রাণ একটা গ্রহতে পরিণত করবে।
গবেষণার মূল দুই অগ্রণী হলেন আমেরিকার 'জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি'-র ভূ-বিজ্ঞানী অধ্যাপক ক্রিস রেনহার্ড আর জাপানের 'তোহো বিশ্ববিদ্যালয়'-এর পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক কাজুমি ওজাকি জাবি। তাঁদের মতে, সূর্যের তাপে ভস্মীভূত হওয়ার অনেক আগেই বিষাক্ত মিথেন গ্যাসে ভরে যাবে পৃথিবী। অক্সিজেনের লেশমাত্র না থাকায় প্রাণ স্তব্ধ হয়ে যাবে। ক্ষতিকর বিকিরণ এবং সূর্যের প্রচন্ড তাপে ধ্বংস হয়ে যাবে ওজোনস্তর, গোটা পৃথিবীতে বিরাজ করবে শুধুমাত্র মিথেন গ্যাস। মানুষ তো দুরস্ত, নামমাত্র কয়েকটি অণুজীব ছাড়া কোথাও কোনও প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না।
ইদানিং এক নতুন উপসর্গ বৈজ্ঞানিকদের নজরে এসেছে, ক্রমশ ঔজ্বল্য হারিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে আমাদের নীল গ্রহ, এবং সেটা ঘটছে খুব দ্রুত গতিতে। একদিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের অতিবৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর 'জ্বর' বেড়ে চলেছে, জলবায়ুর নিয়মবহির্ভূত উল্টোপাল্টা পরিবর্তনে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিপদে পড়ছেন, অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের মতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির দরুন কমে আসছে পৃথিবীর উজ্জ্বলতা। সম্প্রতি 'জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স' নামক একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে এমন দাবি করা হয়েছে। গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ দুই দশকে প্রতি বর্গমিটারে পৃথিবীর ঔজ্জ্বল্য আগের তুলনায় আধ ওয়াট করে কমে গেছে। গবেষকরা উপগ্রহ চিত্র ও সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, পৃথিবী থেকে আলোর প্রতিফলন প্রায় ০.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীতে আগত সূর্যকিরণের মাত্র ৩০ শতাংশ পৃথিবী প্রতিফলনের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেয়।
পৃথিবীর দিন দিন নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি তথ্যের উপস্হাপন ঘটিয়েছেন। সূর্যের যে আলো পৃথিবীতে আসে, সেই আলো পৃথিবী প্রতিফলিত করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা বিভিন্ন পরিবেশ পরিবর্তন জনিত কারণে পৃথিবীর প্রতিফলন ক্ষমতা কমে আসছে। সূর্যের আলো পৃথিবীর সারফেসে প্রতিফলিত হয়ে চাঁদ আলোকিত হয়। পৃথিবীর সূর্যরশ্মি প্রতিফলনের মাত্রা কতটা কমছে সেটি বুঝতে বিজ্ঞানীরা চাঁদের উজ্জলতা পরিবর্তনের মাত্রাটিও পরিমাপ করে দেখেছেন। তাঁদের মতে গত ২০-২৫ বছরে সমুদ্রের তাপমাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে সমুদ্রের উপরিভাগের মেঘগুলি আগের তুলনায় অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছে। মেঘের ঔজ্বল্য হারানোকে একটি মূল কারণ হিসেবে বৈজ্ঞানিকরা উপস্থাপন করছেন। তাঁদের মতে মেঘের ঔজ্বল্য হারানোর ফলেই পৃথিবী থেকে আগের তুলনায় কম সূর্যালোক মহাকাশে প্রতিফলিত হচ্ছে। এর ফলে অনুজ্জ্বল হয়ে ওঠার পাশাপাশি পৃথিবীর তাপমাত্রাও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। উল্লিখিত গবেষণাপত্রটি এটিও জানিয়েছে, পৃথিবীর উজ্জ্বলতা হ্রাসের ঘটনাটি মূলত ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বেশি ঘটেছে।
বিষয়টির আকস্মিকতা হতভম্ব করে দিয়েছে গবেষণাপত্রটির মূল লেখক আমেরিকার 'নিউ জার্সি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি'-র তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ফিলিপ গুডেকে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, 'এতদিন বিজ্ঞানের জানা ছিল বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীতল থেকে বেশি পরিমাণ সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে, কিন্তু এই গবেষণালব্ধ ফল উল্টো কথা বলছে'।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও আলোচনায় পৃথিবীর দিনদিন নিষ্প্রভ হয়ে ওঠার বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে।
প্রথমটি হল, উত্তপ্ত সমুদ্র জল পৃথিবীর উজ্জ্বলতা কমার মূল কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে উষ্ণায়নের ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে একেবারে নিচের স্তরে থাকা মেঘগুলো ঔজ্বল্য হারাচ্ছে সবথেকে বেশি। ফলে সেই মেঘ আর আগের মত সূর্যালোক প্রতিফলন করতে পারছে না। এর সাথে এটাও লক্ষ্য করা গেছে, প্রশান্ত মহাসাগরের উপর যে সব এলাকায় উজ্জ্বল মেঘের স্তর আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে উঠছে, সেই সব এলাকায় মহাসাগরের তাপমাত্রাও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
দুই, সূর্যের আলো পৃথিবীতে প্রতিফলিত হয়ে আলোকিত হয় চাঁদ। বিগত কুড়ি বছর ধরে পৃথিবীর তল দ্বারা প্রতিফলিত সূর্যরশ্মি বা অ্যালবেডোর পরিমান কমে গেছে, যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে হ্রাস পেয়েছে গত কয়েক বছরে। গবেষকদের মতে, সূর্য থেকে আসা রশ্মির পরিমান নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর- সূর্যের উজ্জ্বলতা এবং গ্রহের প্রতিফলন ক্ষমতা। জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে অ্যালবেডোর পরিমান হ্রাসকেই বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের উজ্জ্বলতা কমার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন।
তিন, গত দুই দশক ধরে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার 'বিগ বিয়ার সোলার অবজারভেটরি'-র বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা এবং আনুবীক্ষণিক পদার্থ সূর্যরশ্মি শোষণ করে অন্তরীক্ষে ফিরিয়ে দেয়, সেইসব রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় না। এছাড়া মেঘস্তরে উপস্থিত প্রচুর দূষণজাত পদার্থ একইরকম সূর্যালোক শোষণের কাজ করে। এই সবকিছুর সম্মিলিত ফল হল পৃথিবীর উজ্জ্বলতা হ্রাস।
চার, জীবাশ্ম তেলের, বিশেষ করে ডিজেলের, অসম্পূর্ণ দহনের ফলে বাতাসে কালো কার্বনকণার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। যদিও কালো কার্বন বা ঝুল সামগ্রিক বায়ু দূষণের একটি নগন্য শরিক মাত্র, তবে এর উপস্থিতি সমুদ্রতল থেকে দুই কিলোমিটার(৬,৫৬২ ফুট) উপরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এই দূষণ সৌরবিচ্ছুরণ শোষণ করে সমুদ্রের উপরিতলের উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেয়। বিজ্ঞানীদের মতে 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং' সৃষ্টিতে এই কালো কার্বন কণার অবদান কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঠিক পরেই। এই কার্বন কণা সৌরশক্তি শোষণ করে হিমালয়ান অঞ্চলে গ্লেসিয়ার গলাতে অবদান রাখে। সর্বোপরি, সূর্যালোকের শোষণ বৃদ্ধি এবং প্রতিফলন হ্রাস ঘটিয়ে উত্তর মেরু অঞ্চলের বরফকেও অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে করে তুলেছে।
পৃথিবীর উজ্বলতা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তাভাবনা সচেতনভাবে শুরু হয় বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে। পৃথিবী নামক এই গ্রহ যে ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে উঠছে সেটা প্রথম থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে উজ্জ্বলতা হারানোর দ্রুত গতি বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাছাড়া এই নিষ্প্রভতার মাত্রা দেশ, কাল, উচ্চতা, সময় ভেদে আলাদা আলাদা, কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই হ্রাসের মাত্রা ৪-২০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য মূলত উষ্ণায়নকেই দায়ী করেছেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলই উষ্ণায়নের স্বীকার, তবে যে অঞ্চলগুলি বায়ুদূষণের মূল উৎস অঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত সেগুলো সাধারণভাবে এখনও শীতল এলাকা হিসেবে ভালো আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমেরিকার পূর্বাঞ্চল পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় বেশি ঠান্ডা। তবে সভ্যতার উন্নয়ন, নগরায়ন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি প্রদর্শিত আধুনিক জীবনযাত্রা আর বেশিদিন কোনো অঞ্চলকেই সুস্থ থাকতে দেবে না। তাই পৃথিবীর আজ গভীর অসুখ। এই অসুখের একমাত্র দাওয়াই মানুষের সদিচ্ছা, সচেতনতা এবং দূরদর্শিতা। কালিদাস তো কোন এক মহাপুরুষের আশীর্বাদের কল্যানে পরাশ্রমে পূর্বাশ্রমের অদূরদর্শিতা পরিত্যাগ করে জ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষিত, সবজান্তা আধুনিক মানুষের সেইরকম বিবর্তন কোন পথ ধরে আসবে, বা আদৌ আসবে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর কে দেবে।
লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক


