নেহরুর রাজনৈতিক ভাবনার ভিত্তি তাঁর দার্শনিক ও মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গী

নেহরুর রাজনৈতিক ভাবনার ভিত্তি তাঁর দার্শনিক ও মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গী
সত্যব্রত দোলই
পণ্ডিত নেহরু ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। ভাবুক এক রাষ্ট্রনেতা। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে সেই স্বপ্নের কিছুটা তিনি রূপায়িত করতে পেরেছিলেন। আবার তেমনই অনেক কিছু করে যেতে পারেননি। কিন্তু যতটুকু পেরেছিলেন, তার মধ্যে ঐকান্তিকতার ঘাটতি ছিল না। নির্ভীকভাবে তিনি সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার নীতি ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় রোপণ করার প্রচেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু।
নেহরুর রাজনৈতিক চিন্তা তাঁর দার্শনিক ও মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তাঁর দার্শনিক বোধ বা উপলব্ধি স্পষ্ট না হলেও, বিচ্ছিন্ন বা অসঙ্গত হলেও তাকে সংযুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা তাঁর ছিল। গান্ধীজির মতই ভারতীয় দর্শনের মূল কথা সত্যকে তিনি নিরীক্ষণ করতে চেয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ভাবনায় ও কর্মে। হিন্দু ভাবনা 'সহাবস্থান ও সমন্বয়'-এ তাঁর প্রবল বিশ্বাস ছিল। তিনি বৈচিত্র্য ও বিরোধিতার মধ্যেই ঐক্যের সন্ধান করেছেন। বিপরীত মতাদর্শ, রাজনৈতিক সংঘাত ও বিরোধকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু এদের মধ্যে ঐক্য সূত্রকে তিনি সন্ধান করেছেন। নেহরু মতাদর্শগত কঠোরতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ব্যক্তি, সমাজ, জাতির সমস্যাকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন। বৈজ্ঞানিক যুক্তি তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। রাজনৈতিক চিন্তায় ধর্মের প্রভাবকে তিনি মানতে চাননি। প্রথাগত আচারসর্বস্ব ধর্মে তাঁর আস্থা ছিলনা ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় সমাজে ধর্মের নানাবিধ দার্শনিক সত্তাগুলির প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্বকে তিনি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তাঁকে হয়ত অজ্ঞেয়বাদী মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, বিবিধ জাতি এবং ধর্মগোষ্ঠীর নিরিখে গঠিত সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশ যদি পদে পদে ধর্মকে তার অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, তাহলে তার ফল অতি বিপজ্জনক হতে বাধ্য। এই বিষয়টি শুধু নেহরু নন, গণপরিষদে সংবিধান রচনার কাজে যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরাও মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন।
গ্নিমসেস্ অব ওয়ার্লড হিসট্রি' এবং 'দ্য ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া' গ্রন্থ দুটি নেহরুর স্বচ্ছ ইতিহাস চেতনার প্রকাশ। ইতিহাসকে নেহরু কখনই ঘটনার বিবরণ হিসাবে দেখেন নি, দেখেছেন সমাজ বিকাশের ধারা হিসাবে। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই তিনি সন্ধান করেছেন পরিবর্তন আর প্রগতিকে। ইতিহাসে জনগণের স্থান কী, ইতিহাসের অর্থনৈতিক উপাদান কী, ইতিহাসের শ্রেণিগত অবস্থান কী—সবকিছুকেই নেহরু সন্ধান করেছেন। ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টি দিয়েই তিনি বিচার করেছেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতি, পৃথিবীর ইতিহাস, সমাজ-ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা সব কিছুকেই। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজবাদ, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতা- সব কিছুর ব্যাখ্যায় ইতিহাসের বস্তুবাদী দৃষ্টিকে তিনি প্রয়োগ করেছেন। ভারতের সামাজিক-আর্থিক পরিস্থিতি, আর্থিক-রাজনৈতিক সঙ্কট, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতা, সামাজিক-আর্থিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় তিনি প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বস্তুবাদী চিন্তাকে।
নেহরুর চিন্তার একটি বলিষ্ঠ দিক হল তাঁর মানবিক বোধ। এই মানবিক বোধ দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সভ্যতা, সংস্কৃতি, শান্তি ও সংহতির প্রশ্নকে। সভ্যতার সঙ্কটের মূল হিসাবে রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণকে নির্দেশ করলেও মানবিক শক্তির অবক্ষয়কেই তিনি প্রধান সঙ্কট বলে নির্দেশ করেছেন। কর্ম, সহযোগিতা, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সমতার আদর্শকে এই সঙ্কট মোচনের সমাধান হিসাবে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। নেহরুর মতাদর্শগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নানা সূত্র ধরে। এর মধ্যে প্রধান হল ফ্যাবিয়ান মতবাদ, মার্কসবাদ ও গান্ধীবাদ। কোনও কোনও লেখক মনে করেন, নেহরুর চিন্তা-চেতনায় উনবিংশ শতকের মানবিক উদারবাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। নেহরুর রাজনৈতিক ভাবনায় একই সঙ্গে বুর্জোয়া মতবাদ, মার্কসবাদ, উদারবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ, গান্ধীবাদ পাশাপাশি অবস্থান করত বলে অনেক লেখক মনে করেন। তবে সবকিছুর উপরে মুক্তিবাদ ও প্রয়োগবাদের ছাপই তাঁর চিন্তায় বেশি ছিল। তার চিন্তায় ভারতবোধের সঙ্গে বিশ্ববোধের সমন্বয় ঘটেছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তবে কোন মতবাদের প্রতিই তাঁর স্থির বিশ্বাস বা অটুট আনুগত্য শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েনি। প্রতিটি আদর্শকেই তিনি গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োজন মতো সংশোধন করেছেন। নিজের ভাবনাকেও নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে সংশোধন করেছেন। চিন্তার সমন্বয় নয়, বোঝাপড়াই ছিল নেহরুর বৈশিষ্ট্য।
জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যেই নেহরুর রাজনৈতিক ভাবনা বিকশিত হয়েছে। যে-সময়ে নেহরু তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রস্তুত করছেন, সেই সময়টি জাতীয় আন্দোলনের যুগ। 'ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া' গ্রন্থে নেহরু লিখেছেন, ".....Nationalism was and is inevitable in India of my day...........for any subject country national freedom must be the first and dominant urge, for India with her intense sense of individuality and a past heritage, it was doubly so” 'অ্যান অটোবায়োগ্রাফি' গ্রন্থে নেহরু আলোচনা করেছেন কেমনভাবে জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে ভারতবর্ষে, কিভাবে জাতীয় আন্দোলনের বৃত্তে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। হ্যারো ও কেমব্রিজের ছাত্রজীবনেই ভারতের জাতীয় আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছেন। মতিলাল নেহরু, বালগঙ্গাধর তিলক, গান্ধীজি প্রত্যেকেই কমবেশি নেহরুর জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে প্রভাবিত করেছেন। তবে অন্যান্যদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে আবেগ ছিল নেহরুর তেমনটা ছিল না। জাতীয়তাবাদকে নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসাবে সরলভাবে তিনি দেখেননি। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি ছিল একাধারে সমালোচকের দৃষ্টি ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টি। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রশ্নটিকেই তিনি বিচার করেছেন। নেহরুকে বলা হয় 'আলোকিত জাতীয়তাবাদী'। জাতীয়তাবাদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস, সংকীর্ণ অন্ধ আবেগকে তিনি দেখেন নি. জাতীয়তাবাদকে তিনি দেখেছেন বিশেষ সামাজিক- আর্থিক পরিস্থিতি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন মানবতাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের এক নতুন ভাবনা।
ভারতে জাতীয়তাবাদকে নেহরু পূর্ণ স্বাধীনতার, সম্পূর্ণ স্বরাজের আন্দোলন হিসাবেই দেখেছেন। গান্ধীজির জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকে নেহরু স্বাগত জানিয়েছিলেন এই কারণে যে, গান্ধীজি ভারতের জাতীয়তাবাদকে Selfless struggle of her people' বলে বিচার করতেন। এই জাতীয়তাবাদে কোন সংকীর্ণতা নেই এবং এই জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপুরক। ভারতের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতা, বৈষম্য যুক্ত নয়। এদেশের জাতীয়তাবাদ অখণ্ড জাতীয়তাবাদ, দেশের জাতীয় ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার ধারায় পুষ্ট বলে নেহরু মনে করতেন। নেহরুর জাতীয়তাবাদী ভাবনা ইতিবাচক রূপ নেয় তাঁর জাতি গঠনের ও আধুনিক ভারত গঠনের বিশাল কর্মযজ্ঞে। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাতি গঠন ও নির্মাণের যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তার আবেদন অসামান্য। ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া' গ্রন্থে নেহরু লিখেছেন, ভারতবর্ষ তার রাজ্যে এর এমন অনেক কিছু আছে যা তাকে সহজাতভাবেই রোমাঞ্চিত করে। তবুও ভারতবর্ষকে তিনি একজন বিদেশী সমালোচকের মত অপছন্দ নিয়ে দেখতে চান। এর দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানকে বদলে ফেলতে চান। এর মধ্যে দিতে চান আধুনিকতার ছোঁয়া। ভারতের রূপান্তর ঘটাবার আগে, ভারতকে আধুনিক করার আগে ভারতকে জানতে হবে, আবিষ্কার করতে হবে ভারতের আত্মাকে নেহরু এটা বুঝেছিলেন।
গণতন্ত্র সম্পর্কে নেহরুর ভাবনা ছিল স্পষ্ট, তবে ভারতের ক্ষেত্রে এই উপলব্ধিকে তিনি সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চাননি বা পারেননি। সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ভাবনার পরিপুরক হিসাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এক ভাবনাকে তিনি পোষণ করেছেন। দমন-পীড়নের যন্ত্র রূপে রাষ্ট্রের চেয়ে জনগণের সম্মতিযুক্ত রাষ্ট্রেই যে তাঁর বেশি আগ্রহ ১৯৩০ সালে এ মত তিনি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক পথ নয়, গণতন্ত্রের পথই তাঁর পছন্দ। কারণ এটিই লক্ষ্যে পৌঁছাবার সঠিক পথ, শান্তিপুর্ণ পদ্ধতি। ভারতবর্ষকে Largest functioning democracy in the world' ভেবে তিনি গর্ব বোধ করতেন এবং এর কোন রকম বিচ্যুতি বা বিকৃতি যে প্রগতির পথকে রুদ্ধ করবে এ ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। ১৯২০ বা ১৯৩০-এর দশকে নেহরু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কঠোর সমালোচক হলেও ১৯৫০ বা তার পরবর্তীকালে সেই কঠোর মনোভাব তাঁর ছিল না। সেই সময় গণতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজি, সম্পত্তি, সামরিক বাহিনী, আমলা বা বুর্জোয়া প্রচারযন্ত্রের বন্ধুত্বের কথা তিনি বলতেন না। সেই সময় গণতন্ত্রের মধ্যে তিনি দেখতেন প্রগতিশীল শক্তি-ভারতের সংসদ, ভারতের সংবিধান, ভারতবাসীর ভোটাধিকার সব কিছুই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ভাবনার অঙ্গ। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের সীমা অতিক্রম করে গণতন্ত্র যে প্রসারিত হবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই আশা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। জনকল্যাণ, সুযোগের সমতা, সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা গণতন্ত্রের প্রসারে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি মনে করতেন দমন-পীড়ন নয়, জনগণের সদিচ্ছা ও সহযোগিতাই গণতন্ত্রের সাফল্যের সূচক। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুর বোঝাপড়াকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধানই গণতান্ত্রিক প্রগতির লক্ষণ বলে তিনি মনে করতেন। গণতন্ত্রের ভাবনাকে প্রসারিত করতে জনশিক্ষা, নাগরিক চেতনা প্রসারের কথা বলেন তিনি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিতকে শক্ত করবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমস্যা নিয়েও নেহরু ভেবেছেন। কাজের জটিলতা ও চাপ, সমন্বয়ের অভাব, দায়িত্বের অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার হল গণতন্ত্রের সমস্যা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সাফল্যের মূল শর্ত হল শান্তি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গ্রহণ করার মানসিকতা। মানবিক অধিকার, জনগণের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকারের সম্প্রসারণ ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরো পরিপূর্ণ ও সুদৃঢ় করা, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে সংগঠিত করা, নাগরিক অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য, রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতির দিকে নজর দেওয়ার কথাও বলেন নেহরু। ভারতীয় সংবিধানের ‘Objective Resolutions'-এর উপর নেহরুর বিশ্বাস, সংবিধানের এই প্রস্তাবকে কার্যকর করার জন্য তাঁর সংকল্প ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি তার গভীর বিশ্বাস ও আস্থাকে প্রকাশ করে।
নেহরুর রাষ্ট্রচিন্তার একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তা। অমৃতসর কংগ্রেসে (১৯১৯) গান্ধীজির আবেদন ছিল কংগ্রেস এমন কর্মসূচি গ্রহণ করুক যার আবেদন হবে জনমুখী। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় আন্দোলন পেল একটি জনমুখী ভিত্তি। আন্দোলনের এই জনমুখী ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে ১৯২৭-এর পরবর্তী সময় থেকে জাতীয় আন্দোলনের ভাবনাকে প্রসারিত করার ঐকান্তিক প্রয়াস লক্ষ্য করা গেল কংগ্রেসের তরুণ নেতা নেহরুর মধ্যে। নেহরু চাইলেন জনসাধারণের আস্থা ও আনুগত্যের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের নতুন দায়িত্বকে সফল করার কাজে এগিয়ে আসুক কংগ্রেস। দারিদ্র্য, দুঃখ, অস্বাস্থ্য, অপুষ্টির সমস্যার দিকে নজর না দিলে পূর্ণ- স্বাধীনতার আন্দোলন সফল হতে পারে না- এই ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েই লাহোর কংগ্রেসে (১৯২৯) নব-নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি নেহরু ডাক দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার। কংগ্রেসের মঞ্চে সর্বপ্রথম তিনি ব্যবহার করলেন সমাজতন্ত্রের ভাবনা। কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে (১৯৩১) অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ধারণা গুরুত্ব পেল। জাতীয় আন্দোলনকে সমাজতন্ত্রের গতিতে অগ্রসর করার কথা বলা হল। লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসের (১৯৩৬) মঞ্চে নেহরু যে ঐতিহাসিক ঘোষণা ও প্রস্তাবের কথা ব্যক্ত করেন তার আবেদন অসাধারণ। নেহরু জানালেন, বিশ্বের সমস্যা ও ভারতের সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি হল সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র ছাড়া দেশের মানুষের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অধঃপতন ও পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি নেই। সমাজতন্ত্র হল সভ্যতা, 'A vital Creed থাকে হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
তবে সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞাননির্ভর ভাবনাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করলেও, ভারতের মাটিতে এই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারাকে নেহরু প্রতিষ্ঠা করতে সফল হননি। তবে সমাজতন্ত্রের পথে ভারতকে সংগঠিত করতে তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কংগ্রেসের মধ্যে প্রাচীন রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিরোধ ভেঙে নেহরুর উদ্যোগে ও উৎসাহে গৃহীত হল পরিকল্পিত পথে উন্নয়ণের ধারণা। প্রচলিত সমাজ বিন্যাসকে বজায় রেখে ব্যাপক রূপান্তর ও নির্মাণের কর্মসূচী নিলেন নেহরু। পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হল। ধার্য করা হল পরিকল্পিত পথে অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্য। ব্যক্ত হল পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার অর্জনের ইচ্ছা। কষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, সেচশক্তি অগ্রাধিকার পেল পরিকল্পনায়। জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদের সভায় (নভেম্বর, ১৯৫৪), লোকসভার বক্তৃতায় (ডিসেম্বর ১৯৫৪) নেহরু সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য পেশ করলেন। আর.সি.পিল্লাই লিখেছেন, “Nehru was quite sincere and earnest in his effort to develop an Indian model of planning and development."
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও নেহরুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে কোনো ছল-চাতুরী বা উদাসীন কোনো মনোভাব ছিল না বলে কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন। নেহরুর জীবনীকার গোপাল বলেছেন, নেহরুর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল “To build a socialist economy within a democratic structure."
নেহরু তাঁর জাতিগঠনের ভাবনা বা স্বপ্নকে সম্পূর্ণভাবে কাজে পরিণত করতে পারেন নি, নিজেই তা শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর যে মূল আদর্শ অর্থাৎ গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রবাদ- এসব বাঁচাতে ও তাদের শক্তিশালী করতে নেহরুর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে হবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি স্কুল, মেদিনীপুর


