শ্রমবাজারে নারীর প্রকৃত অবস্হান 'U' আকৃতির! বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ক্লডিয়া গোল্ডিন

শ্রমবাজারে নারীর প্রকৃত অবস্হান 'U' আকৃতির! বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ক্লডিয়া গোল্ডিন
ড. গৌতম সরকার
২০২৩ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয় করলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বরিষ্ঠ অধ্যাপক ক্লডিয়া গোল্ডিন। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, 'কর্মক্ষেত্রে নারীশ্রমের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করে আসছেন অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন। মহিলাদের উপার্জন এবং শ্রমে তাদের অবদান এবং একইসঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রধান উৎসগুলি চিহ্নিত করে শ্রমবাজারে নারীদের সঠিক অবস্থানের হালহকিকত তাঁর দীর্ঘ গবেষণার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। মহিলাদের শ্রম উন্নয়নে বিশেষ দিশা দেখানোর স্বীকৃতি হিসেবেই এই বছরে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সন্মানিত করা হল।'
ক্লডিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ কর্মের বাজারে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি দেখিয়েছেন মহিলারা কিভাবে কর্মজগতে বৈষম্যের শিকার হন। সমশিক্ষিত এবং সমদক্ষতা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও একই কাজে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে কম বেতন পান। তাঁর এই গবেষণার ভিত্তি ছিল গত ২০০ বছরে আমেরিকার শ্রমবাজারে মহিলাদের অবস্হান। সমস্ত সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সমাজ বদলের সাথে অর্থনীতিতে মহিলা শ্রমিকদের অবস্থান বদলে গেছে।
১৪ মে ১৯৪৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহন করেন ক্লডিয়া গোল্ডিন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল - শ্রম অর্থশাস্ত্র ও অর্থনৈতিক ইতিহাস। এই শ্রম অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের 'হেনরি লি' অধ্যাপক। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে ক্লডিয়া ২০১৬ সালে শ্রম অর্থশাস্ত্রে 'ইজা পুরস্কার' এবং ২০২০ সালে 'এরভিন প্লাইন নেমার্স পুরস্কার' লাভ করেন। বর্তমানে তিনি 'গোল্ডিন জাতীয় গবেষণা কার্যালয়'- এর অর্থনীতি বিভাগে লিঙ্গ বিষয়ক গবেষণা টিমের সহ পরিচালক। এর আগে ১৯৮৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকান ইকনোমি প্রোগ্রাম ডেভলপমেন্ট বোর্ড-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নোবেল কমিটির তরফে চেয়ারপার্সন জ্যাকব সভেনসন বলেছেন, "শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের ফলাফল বিষয়ক সাবেক জ্ঞানে উল্লেগখযোগ্য অগ্রগতি সাধনের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।"
সংগৃহীত তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ করে ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রভাবিত করে তাদের বিবাহের সিদ্ধান্ত এবং পরিবারের দায়িত্বপালন। এই দুটি ঘটনাই মেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবন এবং ক্যারিয়ারকে প্রভাবিত করে। ২০০ বছরের তথ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন আমেরিকার সমাজবদলের সাথে সাথে কিভাবে মহিলাদের ভূমিকা সময়ে সময়ে বদলে গেছে। আগে বিশ্বাস ছিল অর্থনৈতিক প্রগতির সাথে সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য কমে আসছে, অর্থাৎ শ্রমবাজারে মহিলাদের যোগদান একাধারে বাড়ছে অন্যদিকে উপার্জন জনিত বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে। ক্লডিয়া গোল্ডিন সর্বপ্রথম তাঁর গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখালেন, আর্থিক প্রগতি এবং শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের মধ্যে কোনও ধ্বন্যাত্মক সম্পর্ক নেই, বরঞ্চ সেই সম্পর্ক ইংরেজি বর্ণমালার 'U' অক্ষরের মত। তিনি বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমবাজারে মহিলাদের যোগদান কমতে থাকে, আবার বিংশ শতাব্দীতে সেবাক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসারকালে মহিলাদের অংশগ্রহণ ঊর্ধ্বমুখী হয়।
যদিও তথ্য জানাচ্ছে ১৯৮০ সালের পর লিঙ্গবৈষম্য কমতে শুরু করেছে, আবার সেই তথ্যই বলছে, যে সমস্ত দেশকে তথাকথিত সাম্যের দেশ বলা হয় সেখানেও এখনও শ্রমবাজারে মেয়েদের যোগদান কম এবং মহিলারা তাঁদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছে। ক্লডিয়া বৈষম্যের একটি তথ্য তুলে ধরেছেন- সমগ্র বিশ্বের ৫০ শতাংশ মহিলা বেতনভুক চাকরিতে যুক্ত আছে, সেখানে পুরুষের যোগদান হল ৮০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজতাত্ত্বিকরা দীর্ঘদিন ধরে এর কারণ এবং স্বল্প এবং দীর্ঘকালে অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। এর কারণ ছিল, বিষয়টি অর্থনীতির মূল সমস্যা সামাজিক সম্পদের সুষ্ঠু এবং কাম্য ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহিলারা যদি সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও সুবিধা না পায় এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগগ্রহণ না করতে পারে তাহলে এক বিপুল পরিমাণ মানবসম্পদের অব্যবহারে অর্থনৈতিক উন্নয়ণই বাধাপ্রাপ্ত হবে। শ্রম, শিক্ষা, দক্ষতা ও পারদর্শিতার অপচয় সমাজকে পিছনের দিকে চালিত করবে। শিক্ষিত এবং কুশলী মহিলারা যদি কর্মজগতে মজুরি থেকে শুরু করে সর্ব ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে তারাও শ্রমবাজারে নিজেদের সক্রিয় যোগদানে আগ্রহ হারাবে। নোবেল পুরস্কার প্রাপক ক্লডিয়া গোল্ডিন সর্বপ্রথম এক উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে অর্থনৈতিক কৌশল ব্যবহার করে এই বৈষম্যেরর কারণ এবং ফলাফল পরিষ্কার ভাবে তাঁর গবেষণায় তুলে ধরেছেন। তাঁর সেই ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সঠিক মূল্যায়ন ঘটেছে নোবেল পুরস্কার জয়ের মধ্যে দিয়ে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত লিঙ্গজনিত মজুরির পার্থক্য নারী-পুরুষের শিক্ষা এবং জীবিকা নির্বাচনের তারতম্যের উপর নির্ভর করত। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে আমেরিকা সমেত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোয়ার এসেছে। এই পরিপ্রক্ষিতে শ্রমের বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং মজুরির শেয়ারে ধ্বন্যাত্মক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণালব্ধ ফল অন্য কথা বলছে।
সংগৃহীত রাশিতথ্যে শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সংশোধন করে গোল্ডিন দেখিয়েছেন, প্রাথমিক কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্প ও প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তর সমাজব্যবস্থায় নারীদের ভূমিকার বিবর্তন ঘটিয়েছে। গত দুই শতকে আমেরিকার মহিলাদের শ্রমশক্তিতে যোগদান নিরবিচ্ছিন্ন ঊর্ধ্বাভিমুখি ছিল না, বরং অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালার U অক্ষরের মত ছিল।
গোল্ডিনের মতে শিল্পবিপ্লবের সময় আয়বৈষম্য উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছিল, এবং যে সময়কালে শ্রমবাজারে (১৮৯০-১৯৩০) আমলা এবং করণিকের চাহিদা বেড়ে যায় তখনও নারী-পুরুষের মধ্যেকার আয় বৈষম্য কমতে দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে (১৯৩০-১৯৮০) অর্থনৈতিক সংস্কার, উন্নয়ন, মহিলাদের শিক্ষার প্রসার এবং কাজের বাজারে মহিলা শ্রমিকদের চাহিদা ও যোগান বাড়া সত্ত্বেও বেতনভূক চাকরিতে যোগদানের অনুপাত এবং সর্বোপরি আয় উপার্জনের বৈষম্যে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চোখে পড়ে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অর্থনীতি কৃষিধর্মী থেকে শিল্পনির্ভর হওয়ার সময় শ্রমবাজারে বিবাহিত মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে আবার বিংশ শতাব্দীতে সেবাক্ষেত্রের উন্নয়নের সাথে সাথে বেড়েছে। এর ফলেই উন্নয়নের সাথে শ্রমবাজারে নারীদের যোগদান ক্লডিয়ার মতে U আকৃতির হয়েছে।
নোবেলজয়ীর মতে উনিশ শতকের শিল্পায়নের প্রাক্কালে অনেক বেশি সংখ্যক মহিলা কর্মজগতে নিয়োজিত ছিল, এবং শিল্পায়নের জোয়ারের পর এই অনুপাত কমতে শুরু করে। ক্লডিয়ার মতে এর অন্যতম প্রধান কারণ হল, শিল্পায়নের পর শ্রমিকের চাহিদার প্রকৃতিগত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে মহিলাদের কাজ আর সংসারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর দশ হাজারের বেশি মহিলার তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, শিল্পোন্নয়ন পর্বে আমেরিকার অনেক অবিবাহিত মহিলাও বিভিন্ন শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে যুক্ত ছিল, কোনও কোনও অঞ্চলে এই অনুপাত ছিল ৪০ শতাংশ, তদুপরি দেশের শ্রমশক্তির অনুপাতের হারে মহিলাদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। এখানে উল্লেখ্য এই 'U আকৃতি' বিশিষ্ট সম্পর্ক কেবলমাত্র আমেরিকার মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, সমসাময়িক বিভিন্ন দেশের তথ্যনির্ভর গবেষণা জানাচ্ছে এই সম্পর্কের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে এই বিভেদের কারণ কী? কেন যথেষ্ট আর্থিক উন্নয়ন সত্ত্বেও সমতার এত ধীর অগ্রগতি? গোল্ডিন জানিয়েছেন, এর প্রধান কারণ হল 'বিবাহ নামক এক সামাজিক প্রতিষ্ঠান '।
উচ্চ-আয় বিশিষ্ট দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্লডিয়া দেখিয়েছেন, সমদক্ষতাপূর্ণ নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরির তফাৎ হল দশ থেকে কুড়ি শতাংশ। পক্ষান্তরে উল্লেখ করা যায়, এই সমস্ত দেশের সংবিধান ও আইনে সম-অধিকার এবং সম-উপার্জনের কথা বলা আছে। গোল্ডিন তাঁর গবেষণায় বৈষম্যের অন্যতম কারণ হিসেবে 'পেরেন্টহুড' বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সময়ের সাপেক্ষে আয়বৈষম্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ক্লডিয়া এবং তাঁর সহলেখিকা মারিয়েন বার্ট্রান্ড দেখিয়েছেন, প্রাথমিক অবস্থায় এই বৈষম্যের মাত্রা অনেক কম ছিল, কিন্তু প্রথম সন্তানের জন্মের পর থেকেই চিত্রটি বদলাতে থাকে এবং মহিলাদের আয় কমতে থাকে বা বৃদ্ধির মাত্রা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম হয়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল পরিলক্ষিত হয়।
আধুনিক শিল্পময় এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা সেই ধরনের শ্রমিক নিয়োগে আগ্রহী যাদের যোগান হবে নিরিবিচ্ছিন্ন এবং নমনীয়। সেই যোগ্যতার মাপকাঠিতে মহিলারা, অবিবাহিত এবং বিবাহিত উভয়ই, পুরুষ সহকর্মীদের যোগ্য পরিবর্ত হতে পারে না। মেয়েদের বিয়ের পর সংসার নামক বেড়াজালে অনেকটা সময় আবদ্ধ থাকতে হয়, আর সন্তান জন্মের পর তার লালনপালন করার দায়িত্ব মেয়েদের উপরই ন্যস্ত থাকে, তা সেই দেশ আমেরিকা, বাংলাদেশ, কিংবা সোমালিয়া যাই হোক না কেন। গোল্ডিনের গবেষণায় বৈষম্যের পরবর্তী কারণ হিসেবে যেটি উঠে এসেছে সেটি হল, মহিলাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রত্যাশা বা আকাঙ্খা। মেয়েদের বিয়ের সিদ্ধান্ত কিভাবে তাঁদের ভবিষ্যত জীবন এবং ক্যারিয়ারকে চালিত করে সেই ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর গবেষণায়। তাঁর মতে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বেশিরভাগ মহিলাই বিয়ের আগে মাত্র কয়েক বছর কাজের কথা ভাবতেন, যেটি তাদের শিক্ষা এবং চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করত। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এসে এই মহিলাদের সন্তানেরা বড় হয়ে যাওয়ার পর যখন তাঁরা পুনর্বার শ্রমবাজারে ফিরে এলেন তখন তাঁদের কাজের সুযোগ এবং প্রকৃতি নির্ভর করেছে পঁচিশ বছর আগে নেওয়া শিক্ষাগত সিদ্ধান্তের উপর। ফলত কর্মজগতে ফিরে এলেও তাঁরা কতজন চাকরি পেলেন বা কি ধরনের চাকরি পেলেন সেটি ক্লডিয়ার আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। ক্লডিয়া এবং তাঁর সহ লেখকদের গবেষণা থেকে জানতে পারা যায় কেবলমাত্র ১৯৭০ সাল থেকে মহিলাদের ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা এবং বাস্তব ফলের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণে আধুনিক মহিলারা নিজেদের শিক্ষায় বিনিয়োগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় পুরুষ প্রতিপক্ষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গোল্ডিন বলেছেন, মহিলাদের আকস্মিক ভাবে বেশ কিছু সময়ের জন্য শ্রমজগত ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণেই বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রচুর মহিলা কর্মজগতে প্রবেশ করা সত্ত্বেও চাকরির গড় হারে মহিলাদের উপস্থিতি কমই রয়ে গেছে। মহিলাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বদল ঘটতে শুরু হয়েছে ১৯৬০ সাল থেকে যখন গর্ভনিরোধক বড়ি আবিষ্কৃত হল। এই আবিষ্কার শ্রমজগতে মহিলাদের ভূমিকার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল। এর ফলে মহিলারা তাঁদের ইচ্ছে ও সুবিধামতন বিয়ে ও সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত নিতে পারার সাথে সাথে শ্রমবাজারে তাঁদের ভূমিকা ও গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়। এই আবিষ্কারের পর মহিলাদের মধ্যে অর্থনীতি, আইন, চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়ার ঝোঁক অনেক বেড়ে গেছে, প্রত্যাশা এবং বাস্তবের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা সহজ হয়েছে। এর ফল আমরা পাই যখন বিংশ শতাব্দীর শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেশে দেশে সেবাক্ষেত্রের গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে কর্মজগতে মহিলাদের যোগদান বাড়তে শুরু করে। যদিও এর ফলে আয়বৈষম্য পুরোপুরি মুছে যায়নি, তবে ধীরে ধীরে এই বৈষম্য কমে আসছে, এটাই আশার কথা।
তৃতীয় মহিলা হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ক্লডিয়া গোল্ডিন, এবং এককভাবে প্রথম। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার কমিটির চেয়ারপার্সন জ্যাকব সভেনসনের ভাষ্যে উঠে এসেছে, "ক্লডিয়া গোল্ডিনের যুগান্তকারী গবেষণা আমাদের শ্রমবাজারে লিঙ্গ বৈষম্যের অন্যতম কারণগুলো চিনতে এবং নিরসনে কোন কোন বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে সর্বাঙ্গীন সাহায্য করেছে।" পুরস্কার পাওয়ার পর ক্লডিয়া জানিয়েছেন, 'আমার বিশ্বাস মানুষ এই কাজ থেকে মানুষ সেই শিক্ষাটুকু নেবে যে, শ্রমবাজারের প্রকৃত স্বরূপ বোঝার জন্য দীর্ঘকালীন পরিবর্তনগুলো সম্যকভাবে বোঝা দরকার।' তিনি এও জানিয়েছেন, 'আমরা কখনই লিঙ্গ সমতায় পৌঁছতে পারবো না যদি না পরিবারের মধ্যে নারী-পুরুষের অধিকারে সাম্য থাকে। তাই সমাজ বদলের প্রাথমিক পাঠ আমাদের পরিবার থেকেই নিতে হবে।' একজন নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ক্লডিয়া গোল্ডিন জানিয়েছেন, "হয়তো দীর্ঘদিনের অচলায়তনের বরফ গলতে শুরু করেছে.... তাঁর মত আরও শতসহস্র অর্থনীতিবিদদের প্রচেষ্টার সুফল হয়ত ফলতে শুরু করেছে।"
লেখক: অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা।


