দাবার চাল: তালিবান শাসিত আফগানিস্তান বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব

দাবার চাল: তালিবান শাসিত আফগানিস্তান বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব
14 Sep 2021, 01:27 PM

দাবার চাল: তালিবান শাসিত আফগানিস্তান বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব

 

ড. গৌতম সরকার

 

 

'তালিবানি' শব্দটার মধ্যে কিরকম একটা আতঙ্ক, অত্যাচার আর নৃশংসতা মেশানো আছে। গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম, বহুকাল আগে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্যে মায়েরা 'খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গি এল দেশে' কবিতাটি সুর করে গাইতেন। বর্গীদের ভয়ে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ত। পঁচিশ বছর আগে মায়েরা শিশুদের তালিবানের ভয় দেখিয়ে একইভাবে ঘুম পাড়াতেন কিনা জানিনা, তবে প্রভাব, প্রতিপত্তি, হিংস্রতা এবং হানিকারতায় তালিবানেরা বর্গীদের তুলনায় সহস্র যোজন এগিয়ে থাকবে। বর্গীরা ছিল লুটেরা, তারা দস্যুর মত একেকটা এলাকা আক্রমণ করত আর সবকিছু লুট করে গ্রামকে গ্রাম নিঃস্ব করে চলে যেত। অন্যদিকে তালিবানেরা শাসক হয়ে জাঁকিয়ে বসে একটা দেশের সম্পদ, সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, স্বাধিকার সব কিছু লুট করতে চায়। তাদের সংবিধানের সবচেয়ে পছন্দের শব্দ হল, সন্ত্রাস। তারা বিশ্বাস করে সন্ত্রাস চালিয়ে একটা সময় তারা বিশ্বজয় করবে।

  

 

গত আগস্ট মাসে তালিবান দ্বিতীয়বারের জন্য আফগানিস্তান অধিকার করেছে। তাদের প্রথম ইনিংসের পারফরম্যান্স মানুষের মনে দগদগে স্মৃতি হয়ে আছে। তারপর কুড়ি বছর যেতে না যেতেই আবার তাদের ফিরে আসায় শুধু আফগানরা নয়, গোটা বিশ্ববাসী আতঙ্কিত। সেসব আতঙ্ক যে অমূলক নয় তার যথার্থ প্রমান গত একমাস ধরে আফগানিস্তানে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহে প্রতীতি হচ্ছে। আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশগুলো আস্তে আস্তে সেনা সরিয়েছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে তালিবানি সেনারা একটার পর একটা প্রদেশ দখল করতে করতে কাবুলের দিকে এগিয়ে এসেছে, এবং অবশেষে ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করেছে। তারপর থেকেই তালিবানি নেতৃত্বের চুক্তি, হলফনামা, আলোচনা ও প্রতিশ্রুতির বন্যায় আত্মসন্তুষ্ট আমেরিকা, রাশিয়ার মত দেশগুলি নিজের নিজের আখের গোছানো ছাড়া বৈশ্বিক সংকট নিয়ে ভাবেনি। তাদের বক্তব্য ছিল, তালিবান নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আফগানিস্তানের বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তালিবান সরকার গঠনের প্রক্রিয়া জোরদারভাবে শুরু হয়ে গেছে, আর সেই গঠন প্রক্রিয়ায় যেভাবে ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে তাতেই আমেরিকা, রাশিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক দেশের ঘুম ছুটে গেছে। সব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে ঠান্ডা যুদ্ধের দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ ভারতের সাথে আলোচনা করতে দিল্লিতে এসে উপস্হিত হয়েছেন। আফগানিস্তান তালিবান দখল করে নেওয়ার আগে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মস্কো সফরে গিয়েছিলেন। সেই সফরে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় তালিবানদের ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং সম্ভাব্য সরকার গঠনের পরিণতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময় রাশিয়ার তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, তালিবান নেতৃত্ব তাদের কথা দিয়েছে আফগানিস্তানের বাইরে তাদের পায়ের দাগ পড়বে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দলের পুরোনো নেতারা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, সেটা তালিবান দলের কাঠামো নির্মানেই পরিষ্কার হচ্ছে, আর এতেই প্রমাদ গণছে আমেরিকা থেকে রাশিয়া।

আফগানিস্তানের এই আচমকা রাজনৈতিক পালাবদল এবং প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা আভ্যন্তরীণ পরিস্হিতি মস্কো থেকে বেইজিং, দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন, বার্লিন থেকে ইসলামাবাদ, তেহরান থেকে আবু ধাবি, সমস্ত সরকারকে কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগে দ্বিধার মধ্যে ফেলেছে। এছাড়া গত ২৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী আত্মঘাতী হামলা থেকে এটাও পরিষ্কার ওই দেশে তালিবানবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীরাও নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাই যে সমস্ত দেশের কাছে তালিবান সরকারের কার্যকলাপ আগামী দিনে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে সেই সব দেশ এই মুহূর্তে কী ভাবছে সেটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

পাকিস্তান: পাকিস্তান হল সেই দেশ, যারা তালিবানের উত্থান, শাসন, পতন এবং অন্তরালে থেকে ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন এবং প্রত্যাবর্তন এই সমস্ত সময়টা ধরে পাশে ছিল। সরকারিভাবে যতই অস্বীকার করুক না কেন, শুধু পাশে থাকা নয়, অস্ত্রশস্ত্র, টাকাপয়সা এবং পরিকাঠামো ব্যবহারের সুযোগও দরাজ হাতে তুলে দিয়েছিল। তাই কাবুলে ক্ষমতার পালাবদল এই দেশটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ দুটি দেশের মধ্যে ২৪০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, সরকারি হিসাবে প্রায় চোদ্দ লক্ষ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে বাস করে। সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৯০-র দশকে তালিবানের উত্থান ঘটেছিল পাকিস্তানের উত্তর অঞ্চলে এবং প্রথমদিককার একাধিক তালিবান নেতা উঠে এসেছে পাকিস্তানের মাদ্রাসা থেকে। ১৯৯৬ সালে তালিবান সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এলে বিশ্বের কেবলমাত্র তিনটি দেশ সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেখানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে পাকিস্তানের নাম জুড়ে আছে। এছাড়া পরবর্তীতে ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার বিস্ফোরণের ঘটনায় তালিবানেরা যখন ক্রমশ বিশ্ব রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে তখন পাকিস্তান সর্বশেষে তালিবানদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল।

    

 

গত বিশ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ কিছু টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে, তবে এবারকার তালিবানদের আফগান জয় পাকিস্তান নিজেদের জয় হিসাবেই দেখছে। এর মধ্যেই পাকিস্তান বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তালিবানের ক্ষমতা দখল আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব কমাবে। কিন্তু যেকথাটি বুঝলেও সচেতন ভাবে উহ্য রাখছে সেটি হল, ভারতের প্রভাব কমার সাথে সাথে অনুদান ও বিনিয়োগও কমবে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হবে আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন হ্রাস। গত দুই দশক ধরে ভারত আফগানিস্তানে রাস্তা, ব্রিজ এবং অন্যান্য পরিকাঠামো গঠনে নজর দিয়েছিল। আভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে উন্নয়নের রাস্তা তৈরি করেছিল। পাকিস্তানের অভিযোগ, কাবুল, কান্দাহার ইত্যাদি সীমান্তবর্তী ভারতীয় কনস্যুলেটগুলো পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে মদত দিয়ে আসছে। তালিবান শাসনে ভারতের এই প্রভাব অনেক কমবে ভেবে তারা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল পিটিআই-এর নেতা নিলাম ইরশাস শেখ একটি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়ে বলেছেন, 'তালিবান আমাদের সঙ্গে আছে এবং তারা কাশ্মীরকে ভারতের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করবে।'

  

 

ব্রিটেনের রয়্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষক উমের করিম জানিয়েছেন, আগামী দিনে পারস্পরিক স্বার্থের কারণেই তালিবান সরকার আর পাকিস্তান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পথে হাঁটবে। তাঁর মতে, 'আফগানিস্তানের প্রধান ব্যবসা-বাণিজ্য হয় পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে। চাল, আটা, সব্জি থেকে শুরু করে সিমেন্ট এবং নির্মাণ সামগ্রীও পাকিস্তানের ভিতর দিয়েই আফগানিস্তানে যায়’। মি. করিম মনে করেন, এই অর্থনৈতিক নির্ভরতা আফগানিস্তানকে বাধ্য করবে নিরাপত্তা এবং অন্যান্য ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে। অন্যদিকে পাকিস্তানও ব্যবসায়িক কারণেই আফগান সরকারের সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হবে, কারণ এই মুহূর্তে তাদের মূল লক্ষ্য হল আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে একটা বাণিজ্য করিডোর তৈরি করা। তালিবান এই মুহূর্তে বিশ্বে একঘরে হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাই বিপদের বন্ধু পাকিস্তানের সাথে একটা সুসংহত সম্পর্ক স্থাপন তাদের কাছে একটা বড় প্রায়োরিটি।

 

 

রাশিয়া: আফগানিস্তান নিয়ে রাশিয়ার একটি সর্ববিদিত ক্ষত আছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর যুদ্ধ শেষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাজয় স্বীকার করে। সেই পরাজয়ের গ্লানি বর্তমানের রাশিয়া ভোলেনি। তালিবানের উত্থানে সরাসরিভাবে স্বার্থ সেভাবে ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও উত্তরের প্রতিবেশী দেশগুলোর (উজবেকিস্তান, তাজিকস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইত্যাদি) উপর আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে রাশিয়া চিন্তিত।

     

তবে রাশিয়ার আসল উদ্বেগের জায়গা হল, ককেশাস অঞ্চলের জেহাদি গোষ্ঠীগুলো আফগানিস্তানের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ইসলামিক স্টেটের সাথে সম্পর্কিত জিহাদি সংগঠনগুলো একই সঙ্গে রাশিয়া এবং তালিবান উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। বিশেষজ্ঞদের মতে এই কারণেই দুই দেশের সরকার পরস্পরের মধ্যে একটা বোঝাবুঝির সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। আগামী দিনে রাশিয়া একটা দ্বৈত নীতি অবলম্বন করে চলবে। তারা একদিকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে তালিবানদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হবে, অন্যদিকে ককেশাস অঞ্চলে সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে চেষ্টা করবে যাতে করে উগ্র ইসলামপন্থী জঙ্গিরা আফগানিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকতে না পারে।

 

 

চিন: আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় বিশ্বের যে দেশটি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেটি হল চিন। আমেরিকার প্রভাবহীন আফগানিস্তান চিনের আছে অনেক দিক দিয়েই লাভজনক। একদিকে নতুন আফগানিস্তানে তারা তাদের ব্যবসা- বাণিজ্যের ইচ্ছেমত প্রসার ঘটাতে পারবে, অন্যদিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্যও আফগানিস্তান সরকারের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি। আফগানিস্তান খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধশালী এক দেশ। এতদিন পর চিনা কোম্পানিগুলোর সামনে সেইসব সম্পদের লাভজনক ব্যবহারের সুযোগ এসেছে। বিশেষ করে মাইক্রোচিপ সহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয় এমন কিছু রেয়ার আর্থের মজুত রয়েছে এই দেশে। একটি হিসাব বলছে, আফগানিস্তানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ আছে। বেসরকারি মতে, পরিমানটা এর চেয়ে অনেক বেশি।

 

তবে একটা ধন্দ আছে। চিন এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশ। চিন এই খনিজ সম্পদ আহরণে কতটা আগ্রহ দেখাবে সেটি নিয়ে চিন নিজেই দ্বিধান্বিত। চিনের সরকারি মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত 'গ্লোবাল টাইমস' জানাচ্ছে, আফগানিস্তানের ওপর পশ্চিমী দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা চাপালে সেই দেশগুলির সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিণতি নিয়েও চিনকে ভাবতে হচ্ছে। যদিও চিনের বেসরকারি কোম্পানিগুলি আফগানিস্তানের নয়া বাজার নিয়ে উৎসাহী। তাদের মতে আফগানিস্তানে হাজার রকমের বাণিজ্যের সুযোগ রয়েছে।

  

চিনের বহুদিনের লক্ষ্য 'সিল্ক রুট' নামে অতীতে যে বাণিজ্যপথটি এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে সংযুক্ত করেছিল, সেই পথটির পুনরুদ্ধার করা। সেই রাস্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ গেছে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে। চিন প্রতিবেশী দেশগুলিতে যেমন পাকিস্তান এবং ইরানে বহু অবকাঠামো তৈরি করেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানকেও যে তাদের 'বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর মধ্যে রাখবে এটা না ভাবার কোনো কারণ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে কৌশলগত দিক দিয়ে চিন আগামি দিনগুলোয় আফগানিস্তানের সাথে আরও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে চাইবে।

 

তবে চিনও আফগানিস্তানের আঞ্চলিক ইসলামী উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান নিয়ে চিন্তিত। আফগানিস্তানের সাথে চিনের সীমান্ত ছোট হলেও, চিন আশঙ্কা করছে বেইজিং বিরোধী সন্ত্রাস গোষ্ঠীগুলি আফগানিস্তানকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে চিনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারে। এটাও একটা কারণ যার জন্য চিন তালিবানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশসমূহ: আমেরিকা এবং ন্যাটো সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করা মাত্রই তালিবানরা আস্তে আস্তে আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে এবং কাবুল দখলের মুহূর্ত থেকেই স্বমূর্তি ধারণ করেছে। এর ফলে আফগানবাসী এবং বিদেশী নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য গোটা বিশ্ব দেখছে। সেই সব মানুষের চোখে-মুখে যে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে সেটাই ওই দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। গোটা বিশ্ব আমেরিকার দিকে আঙুল তুলে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছে। দেশের সাবেক প্রেসিডেন্টও সাধারণ মানুষকে এই ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ফেলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপরও পশ্চিমী নেতারা গত কুড়ি বছর ধরে আফগানিস্তানের তাদের সামরিক যোগদানকে একটি সাফল্যের কাহিনী হিসেবে চালাতে চাইছেন। শেষের দিকে আমেরিকা যেভাবে তড়িঘড়ি সমস্ত সৈন্যকে সরিয়ে নিয়ে গেল সেটি সারা বিশ্ব ভালোভাবে নিচ্ছেনা। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ব্রিকসের যে ভার্চুয়াল সম্মেলন হয়ে গেল সেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিবৃতি দিয়েছেন, 'যেভাবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিনী সেনা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার ফলেই আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে'। গোটা বিশ্বের সমালোচনার জবাবে বাইডেনের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। আত্মরক্ষার সমর্থনে তিনি বলেছিলেন, 'আফগান সামরিক বাহিনী যদি নিজেই তার দেশ রক্ষা করতে না পারে, তাহলে আফগানিস্তানে আরও একবছর হোক বা পাঁচবছর, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্হিতি থাকলেও তাতে কোনও লাভ হতো না। অন্য একটি দেশের সীমাহীন গৃহযুদ্ধের মধ্যে মার্কিন উপস্থিতি আমার কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়'। তবে বাইডেন বা পশ্চিমী মিত্রনেতারা যাই বলুক না কেন, একথা খুব সত্যি আফগানিস্তানে তাদের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কিছুটা সময় লাগবে।

   

 

গত ২৪ আগস্ট ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল বলেছেন, ' নতুন আফগান শাসকদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। এই সম্পর্ক নির্ভর করবে নতুন শাসকদের কাজ এবং আচরণের উপর।' বিশ্বের অন্য সব দেশের মতোই এই পশ্চিমী বিশ্বেরও অন্যতম চিন্তা হল সন্ত্রাস। আমেরিকা এবং তালিবানদের চুক্তিতে শান্তির কথা থাকলেও তারা তাদের প্রতিশ্রুতিতে পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছে না। সম্প্রতি কাবুল বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া হামলা প্রমান করছে বহু সন্ত্রাস গোষ্ঠীই এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমান করতে সচেষ্ট হয়ে উঠছে।

 

ইরান: বিগত কয়েক বছর ধরে তালেবানদের পুনরুত্থানে ইরান তাদের পাশে থেকেছে। তারা নিজের দেশে তালিবান নেতাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছে, টাকাপয়সা, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে অপ্রচলিত কৌশলে সিদ্ধহস্ত ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্স তালিবানদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিল। এই যোগাযোগ এবং সাহায্যের পুরস্কার হিসেবে তালিবানরাও আফগানিস্তানের শিয়া সম্প্রদায় বিশেষ করে শিয়া হাজারা সম্প্রদায়ের ব্যাপারে নরম মনোভাব দেখাচ্ছে। এই কারণেই বন্দুকের একটিও গুলি খরচ না করে তালিবান মধ্য আফগানিস্তানে হাজারা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি দখল করতে পেরেছিল। ইরান যদিও একটি স্থিতিশীল তালিবান সরকার দেখতে আগ্রহী কারণ আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা তাদের দেশে আফগান শরণার্থীর চাপ কমাবে। জাতীপুঞ্জের একটি হিসাব বলছে, এই মুহূর্তে ইরানে সাত লক্ষ আশি হাজার আফগান শরণার্থী রয়েছে।

 

 

ভারত: ভারত প্রথম থেকেই তালিবানদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ আসছে৷ আমেরিকা, রাশিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে এ ব্যাপারে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়েও আশানুরূপ ফল পায়নি। আমেরিকা আর রাশিয়া তালিবান নেতৃত্বের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে নিজের নিজের সৈন্য সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল, উপমহাদেশে উদ্ভূত অস্থির পরিস্থিতির ছোঁয়াচ তাদের দেশকে স্পর্শ করবে না। ওয়াশিংটন থেকে মস্কো সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছিল, তালিবানদের কথা মত সন্ত্রাসের গরল আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। এমনকি ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তালিবান যদি ক্ষমতায় আসে তাদের স্বীকৃতি দিতে ব্রিটেনের কোনো সমস্যা নেই। একমাত্র ভারতই কাতার জোটের পক্ষ থেকে জানিয়েছিল, সামরিক শক্তি খাটিয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করা হলে তাকে মান্যতা দেওয়া হবেনা। ভারতের সঙ্গে এই জোটের পক্ষে ছিল জার্মানি, তাজিকস্তান সহ আরও কয়েকটি দেশ।

  

তবে কয়েকদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির বদল ঘটেছে৷ খুব শিগগিরই তালিবান আফগানিস্তানে সরকার গঠন করতে চলেছে। কিন্তু যেভাবে পুরোনো জমানার নেতাদের সামনে রেখে সরকারের কাঠামো সাজানো হয়েছে সেটা দেখেই তাদের ওপর বিশ্বাস টলে গেছে, তাদের প্রতিশ্রুতি বাক্যগুলো আর গীতার বাণী বলে মনে হচ্ছেনা। আর সেই উদ্বেগের কারণেই গত বুধবার আমেরিকা আর রাশিয়ার প্রতিনিধি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করলেন। বলা বাহুল্য, উভয় বৈঠকেরই মূল উপজীব্য ছিল, আফগানিস্তানে তৈরি হওয়া সামরিক সন্ত্রাস যেটা ভবিষ্যৎ সময়কে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। সূত্রের খবর, ভারতের পক্ষ থেকেও আফগানিস্তান নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন দুই দেশই সন্ত্রাস প্রশ্নে ভারতের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আগামী দিনে তালিবান এবং আফগানিস্তান-পাকিস্তানের জল-মাটিতে পুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের যৌথভাবে মোকাবিলা করার পদ্ধতি এবং প্রয়োগ নিয়েই মূলত মত বিনিময় করেছেন ডোভাল-উইলিয়াম বার্নস এবং ডোভাল-নিকোলাই পাক্রশেভ। এছাড়াও আলোচনায় মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলি থেকে মাদক চোরাচালানের দিকটির উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

 

ভারতের দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের ভয় তো আছেই, ভারতের আশঙ্কা পাকিস্তান তালিবান নেতৃত্বের মদতপুষ্ট হয়ে কাশ্মীর সীমান্তে অশান্তি আরও বাড়িয়ে তুলবে। টেলিভিশনে ক্ষমতাসীন নেতা ইরশাস শেখের বক্তব্য তো শুনেছি, অন্যদিকে বিবিসি-র হিন্দি সার্ভিসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তালিবান মুখপাত্র সুহেল শাহিন জানিয়েছেন, 'মুসলিম হিসেবে ভারতের কাশ্মীর বা অন্য যেকোনো দেশের মুসলিমদের পক্ষে কথা বলার অধিকার আমাদের আছে।' ভারত ঠিক এই ভয়টাই করছিল, তালিবানের মদতে পাকিস্তান দ্বিগুন শক্তি নিয়ে ভারত শাসিত কাশ্মীরে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে তুলবে। মুসলমান বিশ্বের সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে আছে, তাই ভারতের নাম উল্লেখ করলেও তালিবানি এই হুমকি বিশ্বের সমস্ত দেশের বিরুদ্ধেই কার্যকর হবে। প্রাথমিক আশ্বাসে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা আমেরিকা আর রাশিয়াও এই ধরণের হুমকিতে নড়েচড়ে বসেছে। তাই শুধু আমেরিকা আর রাশিয়া নয়, বিশ্বের সমস্ত শান্তিকামী দেশকে ভারতের সাথে একজোট হতে হবে যাতে করে সন্ত্রাসের আঁচ কোনো ভাবেই আফগানিস্তানের বাইরে আসতে না পারে৷

 ……..xxx……..

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক      

Mailing List