Taboo: হ্যাপি টু ব্লিড নাকি ট্যাবু

Taboo: হ্যাপি টু ব্লিড নাকি ট্যাবু
05 Jul 2023, 03:45 PM

হ্যাপি টু ব্লিড নাকি ট্যাবু

বৈশাখী নার্গিস

মাঝে মাঝে ঋতুমতী হয়ে উঠি। হ্যাঁ আমিও গলা তুলে বলতে পারি- হ্যাপি টু ব্লিড। কিন্তু ওই যে চোরাচোখ মেপে যাচ্ছে আমাকে। কখনও ভুরু কুঁচকে, কখনও চোখ লাল করে। মাসের সেই কয়েকদিনের যন্ত্রণা। সেই অমোঘ চার/পাঁচটে দিন। যেদিন গুলো তথাকথিত সমাজের চোখে অচ্ছুৎ, অপবিত্র। যে কারণে পুজো কিম্বা এবাদতে বসা যায় না। ঢুকতে পারা যায় না হেঁশেলেও। হ্যাঁ সেই দিনগুলোয় আমি নিজেকে বড্ড অসহায় মনে করি। মনে হয় কি এমন খারাপ কাজ করেছি, যে এভাবে তাকাতে হবে, বা লুকিয়ে চলতে হবে আমাকে। এটা যে শুধুমাত্র আমার একার তা নয়, সারা পৃথিবীর মেয়েদের সমস্যা। সেটা কোথাও প্রবল, কোথাও বা কম।

‘প্রচন্ড শীতের মারন কামড় রুখতে- নেই কোনো শক্ত দেয়াল। অথচ এরকমই একটি নড়বড়ে ঝুপড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন পবিত্রা গিরি। ঠান্ডা থেকে নিজেকে বাঁচাতে যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল সেটা নিভে গিয়ে ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে ওঠছে। ধোঁয়ার জ্বালায় চোখে জল আসে, কিন্তু এর মধ্যেই কোনোমতে গুটিশুটি মেরে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে শুয়ে থাকেন পবিত্রা’।

নেপালের শতাব্দী প্রাচীন হিন্দু রীতির কারনে এমন অবস্থায় দিন কাটাতে হয় পবিত্রার মতো আরো অনেক মেয়েদের। নির্মম সেই রীতির নাম 'ছৌপাড়ি'। নেপালের মেয়েদের ছোটো থেকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়, 'ছৌপাড়ি' প্রথা পালন না করলে তাদের উপর দূর্ভোগ নেমে আসবে। আর যদি সেটা মেনে চলে, তাহলে ভগবান তাদের আশীর্বাদ করবেন।

এই রীতি মতে, রজঃস্বলা মহিলারা অপবিত্র। তাই প্রতিমাসে মহিলাদের মাসিক বা পিরিয়ড হলে তাদের ঘরে থাকার নিয়ম নেই। প্রতিমাসে পিরিয়ডের দিনগুলিতে তাদের নির্বাসিত হয়ে কাটাতে হয় ঘর থেকে অনেক দূরে এরকমই ছোটো ঝুপড়িতে। ওইসময় তাদের খাবার, গবাদি পশু এবং পুরুষদের সংস্পর্শে আসা নিষিদ্ধ। ওই সময় তাদের ঘর থেকে অনেক দূরে তৈরী ঝুপড়িতে থাকাই নিয়ম। রীতি অনুযায়ী, এসময় মেয়েরা যদি নিষিদ্ধ কিছু স্পর্শ করে, তবে তা পরিবারের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে, অথবা রোগবালাই দেখা দিবে সেই পরিবারে। মেয়েদের এসময় মাংস, দুধ, ফলমূল এবং শাকসব্জি খেতে দেয়া হয় না এই ভয়ে যে, মাসিকের সময় এগুলো খেলে এসব পণ্য উৎপাদন নষ্ট হবে। শুধুমাত্র ভাত, লবণ আর শুকনো ফলমূল খেতে বাধ্য করা হয়। এসময় আয়নায় মুখ দেখা বা চুল আঁচড়ানোও বারণ। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও মহিলাদের এভাবে প্রতি মাসে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। নির্মম এই প্রথা পালন করতে গিয়ে অনেক মহিলার মৃত্যুও হয়। ২০০৫ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট এই ‘ছৌপাড়ি’ প্রথাকে বেআইনী ঘোষণা করলেও এখনও প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে এই প্রথা।

শুধু কি হিন্দু রীতি, ইসলাম ধর্মেও এই মাসিক বা পিরিয়ড হওয়াকে অপবিত্র, অশুচি রূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোরআন শরীফের একটি আয়াত এ পড়েছিলাম "লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, তুমি বলো তা অশুচি। রজঃস্রাবকালে স্ত্রীলোক বর্জন করবে, আর যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয় তাদের কাছে সহবাস এর জন্য যেও না"।

জেনে নিই এরকম আরো কিছু দেশের নিয়ম-

১) ইউরোপের বহু দেশে মনে করা হয়‚ রজঃস্বলা মেয়েরা সমুদ্রে স্নান করলে বা কোনও ওয়াটার স্পোর্টসে অংশ নিলে বিপদ হতে পারে। কারণ রক্তের গন্ধে চলে আসবে হাঙরের দল !

২) ঋতুমতীদের স্পর্শে নাকি মরে যায় গাছ।  নষ্ট হয়ে যায় খাবার।  তাই ভারতের অনেক জায়গায় ঋতুচক্র চলাকালীন মেয়েদের রান্নাঘরে ঢোকা নিষিদ্ধ।  এমনকী বাগানের কোনও কাজও করা যাবে না | গাছ পোঁতা বা গাছে জল দেওয়া তো নৈব নৈব চ।

৩) আফগানিস্তানে পাশ্তো ভাষায় গজগ মানে বন্ধ্যা।  প্রচলিত বিশ্বাস হল‚ ঋতুমতী মেয়েরা স্নান করলে তারা বন্ধ্যা হয়ে যাবে।  তাই‚ মাসের ওই কটা দিন গায়ে জল ঢালা যাবে না !

৪) জাপানে আবার বিশ্বাস করা হয় ঋতুমতী হলে মেয়েদের মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। তাই মেয়েরা সুশি শ্যেফ হতে পারবেন না।  চেখে দেখে কী করে বুঝবেন সুশির স্বাদ কেমন হয়েছে !

কিছু প্রাচীন পন্থা

উর্বরতার উৎসব অম্বুবাচীর কেন্দ্রে থাকে রক্ত। যা দেবীর হলে পবিত্র। কিন্তু রক্তমাংসের রজঃস্বলা নারীর দেহ থেকে নিঃসৃত হলে অতি ঘেন্নার! লজ্জার! সঙ্কোচের! জেনে নিন কীভাবে দেখা হয়েছে এই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে| কয়েক যুগ ধরে|

১) প্রাচীন রোমান প্রকৃতিবিদ প্লিনি মনে করতেন এই রক্তে আছে জাদুশক্তি| যা নষ্ট করে দেয় খাবার ও সুরা| পচিয়ে দেয় ফল| শুকিয়ে দেয় ফল| ভোঁতা করে ইস্পাতের ধার| কমায় হাতির দাঁতের উজ্জ্বলতা| মরচে ধরায় ব্রোঞ্জ আর লোহায়|

২) মধ্যযুগে ইওরোপে মনে করা হতো এটা ইভকে দেওয়া ঈশ্বরের অভিশাপ| তবে রক্তের এতই শক্তি‚ সারায় কুষ্ঠর মতো রোগ!

৩) মধ্যযুগে গোঁড়া ধর্মান্ধ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা প্রচার করত ইহুদি পুরুষরাও নাকি রজঃস্বলা হন প্রতি মাসে| বিদ্বান উইলিস জোন্সও এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন| আধুনিক যুগের সূচনা অবধি বজায় ছিল এই ধারণা|

৪) ফরাসিরা বিশ্বাস করত রজঃস্বলা অবস্থায় যৌন সঙ্গম করলে রাক্ষসের জন্ম হয়| প্রাচীন মিশরীয়‚ গ্রীকরা ব্যবহার করত প্যাপিরাস ও রোমানরা তুলো| স্যানিটরি ন্যাপকিন হিসেবে |

৫) পিরিয়ডসের রক্তপাত কমাতে পাউচে ছাই ভরে ধারণ করতে হবে যৌনাঙ্গের পাশে| সেই ছাই হবে ব্যাঙের শরীর পোড়া| মানত মধ্যযুগীয় ইওরোপ|

৬) রজঃস্বলা নারীর রক্ত গোপনে কোনও পুরুষকে খাওয়াতে পারলে সে বশ হয়ে যাবে ওই নারীর| বিশ্বাস প্রাচীন| এখনও মানে আফ্রিকান উপজাতিরা|

৭) লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট‚ রজঃস্বলা নারীকে দূরে থাকতে হবে ঈশ্বরের কাছ থেকে| স্থান-কাল ভেদে এটাই সবথেকে বেশি পালিত রীতি| ভাবের ঘরে চুরি আর কাকে বলে! স্রষ্টার দান| অথচ যাওয়া যাবে না তাঁর কাছেই!

একুশ শতক নাকি অন্য যুগ?

এখন সে যুগ আর নেই, মানছি। আপনাকে, আমাকে আমাদের মা-কাকিমারা যদি বলতেন ওই নির্দিষ্ট কটা দিনে বাড়ির একটা ঘরে আটকে থাকতে, আপনি ‘বিদ্রোহ’ করতেন, নিশ্চিত! কিন্তু ভেবে দেখুন, পিরিয়ডকে ঘিরে ট্যাবু কি আজও নেই? আজও কি আপনি, হ্যাঁ, আপনিই, একুশ শতকের আধুনিক, জিন্স-টপ পড়া, ফটাফট ইংরিজি বলা কেতাদুরস্ত আধুনিকা হয়েও, পিরিয়ড কি, কেন হয় ইত্যাদির বিজ্ঞানসম্মত কারণ জেনেও সেই গুচ্ছ ট্যাবুগুলোকে মেনে চলেন। কি? অবাক হলেন তাই তো? প্রতিবাদ করে লাভ নেই। লিস্ট দিতে পারি। আপনি মিলিয়ে নিন। তারপর নাহয় যুক্তি সাজাতে আসুন।

গার্হস্হ্য অর্থনীতিতে পিরিয়ড নিয়ে যে অধ্যায় আছে তা নারী শিক্ষিকারাই দেখে না দেখার ভান করে বলেন বাড়িতে পড়ে নিও। কম্বাইন্ড স্কুল কলেজগুলোতে কোনো মেয়ে যদি বলে পেটে ব্যথা তো তাকে হাজারো কথা শুনতে হয়। স্কার্টে দাগ লাগলে তো কথাই নেই! এমনকি অফিসেও কোনো নারী যদি এখনো ব্যথায় কাতরে অফিস করেন তো পুরুষ সহকর্মীদের হাসির পাত্র হওয়া বন্ধ হয় না। ফার্মেসীতে একজন নারী যখন প্যাড কিনতে যান তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখন ভীড় কমবে, কখন শুধুমাত্র দোকানদারের সামনে হড়বড় করে গিয়ে তিনি বলবেন, স্টেফ্রি, হুইসপার, ওভারনাইট, এক্সট্রালার্জ! দোকানদারও তা শুনে প্যাকেটটিকে ইচ্ছামতো খবরের কাগজে মুড়ে ক্রেতার হাতে তা চালান করেন, ক্ষেত্রবিশেষে এখনো ফরমাশের লিস্টে স্বামী কিংবা বাবারাই স্ত্রী, কন্যার প্যাড কিনতে যান; কারণ কি এতো লুকোছাপার? কারণ আমরা সবাই জানি! পিরিয়ড এখনো লজ্জা! এখনো খোলা প্যাকেট নিয়ে রাস্তায় হাঁটলে পুরুষের টিটকারি শুনতে হবে! কিছু নারী নিজেও বলবেন, লজ্জার মাথা খাওয়া বেহায়া মেয়ে! মাসিকের প্যাড নিজে কিনে দেখাতে দেখাতে যায়! পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারী সংখ্যায় কম নন এ দেশে।

আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, প্রাইভেট টিউশন ক্লাসের ছেলেরা কিভাবে আমরা মেয়েদের টিজ করতো এই বিষয়টি নিয়ে! কোনো মেয়ের পিরিয়ড চলছে কিংবা কারো ড্রেসে রক্তের দাগ পড়েছে, সেগুলো নিয়ে ছেলেদের জল্পনা কল্পনার ঠিক নেই। অনেকে আবার এগুলো কল্পনা করে বিকৃত মজাও পায়। এমনো দেখেছি, যে ছেলেটি রক্ত দেখলেই ভয় পায়, সে ছেলেটি পর্যন্ত পিরিয়ড নিয়ে মজা করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু একেকটি পিরিয়ড মানে যে কতটা কষ্ট কিংবা অস্বস্তিকর অবস্থা, সেটা যার হয় এবং যারা নিয়মিত সেই অবস্থা দেখে, তারাই শুধু বোঝে। হয়তো ছেলেরাও বুঝতো, যদি তাদের যৌনাঙ্গ দিয়ে মাসে মাসে এরকম রক্তপাত হত। বায়োলজিক্যাল বিষয় প্রস্রাব পায়খানা স্বাভাবিক হলে, আরেক বায়োলজিক্যাল বিষয় পিরিয়ড হওয়া স্বাভাবিক হবে না কেন?

স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম বিজ্ঞান বইয়ের যে অধ্যায়ে ঋতুস্রাব/ছেলেমেয়ের শরীরগঠন সম্পর্কে তথ্য ছিল, সে অধ্যায়টি স্যার ইচ্ছে করে এড়িয়ে যেতেন। তাই এই বিষয়ে শিক্ষাটা ছেলেরা তো দূ্রে থাক, মেয়েরাও ঠিকমতো পায়নি। প্রথমবার পিরিয়ড হওয়ার পর মা/ঠাম্মারা বলতেন, “এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। ছেলেদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দিতে হবে!" ব্যস এতটুকুই! কখনই তারা আমাদের খোলসা করে বলেন নি, এই পিরিয়ড হওয়াটা মেয়েদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় ঘটনা, যার সাথে সন্তান ধারণ ক্ষমতার বিশাল যোগসূত্র আছে। শুধু দেখতাম, নিয়মিত না হলে তাদের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠতো। কারণ অনিয়মিত পিরিয়ড হলে অনেকসময় সন্তান ধারণের সম্ভাবনা কমে যায়। এবং পিরিয়ড ঠিকমত না হওয়াটা যে আরও অনেক জটিল এবং মারাত্মক রোগের উপসর্গ হতে পারে, সেটা এখন, এই বয়সে এসে বুঝতে এবং জানতে পেরেছি! মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথায় প্রায় মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে অনেক মেয়ে৷ তাদের ডাক্তার দেখানো হয় না৷ কেন তার ব্যথাটা ব্যতিক্রম এ নিয়ে পরিবারের কোনো মাথা ব্যথা নেই৷ কদিন আগে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর জানতে পারলাম কী কী কারণে এটা হতে পারে৷ শরীরে হরমোনের মাত্রা এক একজনের এক এক রকম৷ তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে শারীরিক অস্বস্তিটাও ভিন্ন হতে পারে৷

পিরিয়ডের সবচেয়ে কষ্টদায়ক জিনিস হল প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম(পিএমএস)। শুরু হওয়ার আগে তীব্র পেট ব্যাথা, পিঠ ব্যাথা, বমি বমি ভাব, বিষণ্ণতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, টেনশন করা এগুলো অনেকেরই খুব কমন। অনেকে আছে বিছানা থেকেই উঠতে পারে না। অনেকের আবার পিরিয়ডকালীন সময়েও প্রচন্ড ব্যাথা হয় কিংবা অনেক বেশি রক্তপাত হয়। কারো কারো আবার এত বেশি রক্ত বের হয়, কাহিল হয়ে যায়। কিন্তু এ সবকিছুই ঘটে লোকচক্ষুর আড়ালে। বেশিরভাগ মেয়েরাই প্রথম পিরিয়ড হওয়ার সময় ভয় পেয়ে যায়, তারা বুঝতে পারে না কেন তাদের সঙ্গে এরকম হচ্ছে। আর এই অজ্ঞতার ধরুন তাকে যেতে হয় লজ্জাজনক এবং অস্বস্থিকর পরিস্থিতির মধ্যে। আর পুরুষদের কাছে ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়ায় 'ট্যাবু'। যার ফলে পিরিয়ড শব্দটি শুনলেই অনেকের যৌন সুড়সুড়ি শুরু হয়ে যায়।

আমাদের দেশে, একটা মেয়ে সাধারণ স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গেলেও শিকার হতে হয় অস্বস্তিকর পরিবেশের কিংবা মন্তব্যের। জাতীয় সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ভারতে ৬৮ শতাংশ মহিলা এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে দেশের ৩৫.৫ কোটি ঋতুকালীন বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৮৮% কোনও স্যানিটারি ন্যাপকিন (প্যাড) ব্যবহার করেন না৷ তারা অপরিষ্কার কাপড়, ছাই, তুষ, বালি এইসব ব্যবহার করেন৷ চিকিত্সকরা বলেন এর ফলেই বহু মেয়ে প্রজননের দ্বারে এবং প্রস্রাবের দ্বারের সংক্রমণে ভোগেন, যার ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে চিরতরে বন্ধ্যা হয়ে যাওয়া৷ অধিকাংশ গ্রামের স্কুলে তো বটেই, শহরের স্কুলেও শৌচাগারের হাল খুবই খারাপ। অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধে ভরা শৌচাগার এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একেবারে ছোট্ট বয়স থেকেই মেয়েরা জল কম খাওয়া শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে নানান জটিলতা। তৈরি হয় কিডনির সমস্যাও। ‘সরকার বলছে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও!’ বেটি বাঁচবে কী করে যদি এই বয়সেই তাদের সংক্রমণ হয়?

এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক ও অসত্য ধারণার ফলে অন্যান্য অবমূল্যায়নের পাশাপাশি, একটি মেয়ে বঞ্চিত হয় মানবাধিকার থেকে। প্রতিমাসের এই ‘শরীর খারাপ’ আর ‘অপবিত্রতা’র অনুভবে ধীরে ধীরে সে হীনমন্যতায় ভুগে। তার নিজের শরীরই তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এসময় মেয়েরা বাইরে যেতে স্বস্তি বোধ করে না, এমনকি নিজের ঘরেও আড়ষ্ট থাকে। তাকে অশুচি, অপয়া ভাবা হয়, এমনকি তাকে নিজেকে অশুচি ভাবতে বাধ্য করা হয়, সে বঞ্চিত হয় তার মানব-মর্যাদার অধিকার(Right to Dignity) থেকে। তাকে আবদ্ধ রাখা হয় ঘরে, এ সময়ের নিরাপত্তাহীনতা আর ‘লজ্জা’র কারণে অনেক মেয়েশিশুরা স্কুলে যেতে চায় না, লঙ্ঘিত হয় তার শিক্ষার অধিকার(Right to Education)। মাসিককে একটা শারীরিক বৈকল্য বিবেচনা করে তাকে বঞ্চিত রাখা হয় বিশেষ কিছু কর্মের অধিকার (Right to Work)থেকে। উপযুক্ত টয়লেট সুবিধা না থাকায় ক্ষুন্ন হয় তার উপযুক্ত কর্ম-পরিবেশের অধিকার (Right to Work in Favourable Environment)। নীরবে সব সহ্য করায় বা সহ্য করতে শেখানোর মাধ্যমে হরণ করা হয় তার মতপ্রকাশের অধিকারকে(Freedom of Expression)।

ফলত, এই ক্রনিক বা সিস্টেমেটিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে সমাজে ছড়ানো হয় জেন্ডার বৈষম্য!

মেয়েদের জীবনে এই পিরিয়ডস/ঋতুস্রাব নামক প্রক্রিয়াটি যে যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা নিশ্চই খুব কঠিন নয়। আর যদি এটি গুরুত্বপূর্ণই হয়েই থাকে, তাহলে কেন এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা হবে না? এই বিষয়ে শিক্ষা শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও পাওয়া উচিত। স্বামী এবং স্ত্রী, ভাই, বোনের, বাবা এবং মেয়ের মধ্যেও এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত!!

যে শারীরিক প্রক্রিয়াকে মানুষ নোংরা ভাবে, যাকে অসুস্থতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়, সেটি না ঘটলে তো এই পৃথিবীতে বংশ বিস্তারের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতো! একবার ভেবে দেখুন তো, পিরিয়ড হওয়াটা অসুখ বা শরীর খারাপ, নাকি না হওয়াটা? আমরা রক্তাক্ত হই বলেই কি না এই পৃথিবী চলছে, এখনও মানুষ জন্মাচ্ছে৷

আমরা কি এসব খবর রাখি? নিশ্চয়ই রাখি না! রাখলে অবশ্যই আর যাই হোক না কেন, পিরিয়ডকে হাসি ঠাট্টার ছলে নিয়ে রসালো কথা ছড়াতাম না, কোনো মেয়ের চোখে ব্যথা দেখে বলতাম না, আজকেই ফাইল রেডি করো, এক্ষনই পাঁচতলায় ওঠো…. অফিসে চলে এসো, জরুরী কাজ আছে। কিংবা পিরিয়ডসের প্রথম দু’দিন ছুটির সুপারিশ করলে হেসে উঠতাম না মুখ বেকিয়ে কিংবা গলা উচিয়ে। কলেজে কোনো মেয়ে ব্যথায় কুকড়ে উঠলে বলতাম না, কি? রেড সিগনাল? ফিসফিস নয়, গুঞ্জন নয়, পিরিয়ডের হাইজিন নিশ্চিত করি। পিরিয়ড কোনও ট্যাবু নয়, এটা বারবার খাঁচার ময়নার মতো না বলে নিজের মনকে বোঝাই। আসুন মানবিক হই, স্বাভাবিক হই, খোলা চোখে নারীর সাতটা দিন দেখি, তার কষ্ট দেখি, নারীত্বকে অভিবাদন জানাই।

Mailing List