টান / রম্যরচনা

টান
সৌম্য সরকার
ডাক্তার সুরসময় কর ষষ্ঠীবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই পাশের বাড়ির রতন একটা চিৎকার শুনতে পেল। ষষ্ঠীবাবুরই গলা। মালতিকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বকছেন, "ঘাটে যাবার বয়স হয়ে গেল, এখনো বোধবুদ্ধি হল না? একটা কাজ যদি তোকে দিয়ে হয়। দিলি তো মানসম্মানটা ধুলোয় মিশিয়ে।"
মালতি খুব মৃদুভাবে কিছু একটা বলতেই ষষ্ঠীবাবুর আবার গর্জন, "তোর বরকে ছাড়া হতভাগী।"
আশি পেরোনো ষষ্ঠীবাবু ছয়মাস ধরে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। ঘাড়ে স্পনডাইলোসিস বাড়াবাড়ি হয়ে হাত পায়ের নার্ভ কাজ করছে না। চলা হাঁটার ক্ষমতা অবলুপ্ত। হাত-পাগুলো লিকলিকে হয়ে গেছে। খাইয়ে দিতে হয়। বসিয়ে দিতে হয়। পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়। মশা বসলে তাড়িয়ে দিতে হয়। পায়খানা করলে পরিস্কার করে দিতে হয়। পেচ্ছাপের জন্য ক্যাথেটার করা আছে তাই রক্ষে।
চল্লিশ ছুঁইছুঁই পরিচারিকা মালতিই ভরসা। ষষ্ঠীবাবুর স্ত্রীর যা বয়স ওনার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভব নয়। আর ষষ্ঠীবাবুর মেজাজের জন্য তিনি বিশেষ কাছে ঘেঁষেন না। আগ বাড়িয়ে কে মুখ খেতে যাবে? মালতির আগে অনেক পরিচারিকা ষষ্ঠীবাবুর দেখাশোনা করতে কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু টেকেনি। সকলকেই দুরদুর করে বিদায় ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
মালতিই একমাত্র অনেকদিন ধরে কাজটা করছে। খুব যত্ন নিয়ে কাজ করে ও। কিছুদিন আগেই বাবুর হাত পা ফুলে গিয়েছিল। কোমর, পাছায় বেডসোর হয়ে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ঘরে টেকা যাচ্ছিল না। মালতির সেবা যত্নে পুরো ঠিক হয়ে গেছেন।
ডাক্তারবাবু প্রতিবার বলেন ব্যায়াম করতে। কিন্তু ব্যায়াম করায় ওঁর খুব অনীহা। ব্যায়াম না করে করে উনি আরও দুর্বল হয়ে পড়ছেন। যতবার মালতি চেষ্টা করে ততবার দাবড়ানি খায়। চরম উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করেন। না হলে ঠাণ্ডা গলায় বলেন, "এত মাইনে আমি আর দিতে পারবো না। তুই অন্য কাজ দেখ। রেলে চাকরি করতাম তাই এখনও টানছি। জিনিসপত্রের যা দাম হয়েছে। চালাতে পারবো না। তোকে ছাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।"
শুনেই মালতি গুটিয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে, বাবু বেশ ভালো পয়সাই দেন। এই বাজারে কাজটা চলে গেলে সংসার চালাবে কি করে? আর সাতপাঁচ ভেবে ও যেই ব্যায়ামের ব্যাপারে জোরাজুরি বন্ধ করে দেয়, বাবু আবার খুশি। মাইনে দিতেও আর কোনো অসুবিধা হয় না।
ষষ্ঠীবাবুর চিৎকার শুনে শুনে রতনরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আজকের চিৎকারটা কেমন অপরিচিত ঠেকছে। খানিক বোম পড়ার মতো মনে হল।
চিৎকারের কারণটা জানতে রতন ছুটে গেল পাশের বাড়ি। সেখানে পৌঁছে খানিক তদন্ত করে বুঝতে পারলো, ডাক্তারবাবু চেকআপ করে বেরোনোর সময় ষষ্ঠীবাবুর ঘরের দেওয়াল আলমারির তাকে একটা আধপোড়া সিগারেট আর দেশলাই বাক্স দেখতে পান। এবং জিজ্ঞেস করেন, এটা কার জন্য?
ব্যাস। পর্দা ফাঁই। মালতিকে স্বীকার করতেই হয়, ষষ্ঠীবাবুর নির্দেশ মতো ওকে সিগারেট জ্বালিয়ে বাবুর মুখে মাঝে মাঝেই ধোঁয়া দিতে হয়। না হলে তার রেহাই নেই। কাজটাই চলে যাবে।
তারপর থেকেই বাড়িতে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
............



