স্বামীজি ও নেতাজি একই ভাবপ্রবাহের দু’টি যুগধর্মী তরঙ্গ

স্বামীজি ও নেতাজি একই ভাবপ্রবাহের দু’টি যুগধর্মী তরঙ্গ
20 Jan 2023, 10:30 AM

স্বামীজি ও নেতাজি একই ভাবপ্রবাহের দু’টি যুগধর্মী তরঙ্গ

 

সত্যব্রত দোলই

 

স্বামীজি ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র ভারতের জাতীয় পুনর্জাগরণের ও পুনঃ-প্রতিষ্ঠার শুধু মহত্তম অগ্রদূত নন, এই দুই কালজয়ী মহাপ্রাণ এ-যুগের নবজাগ্রত ভারতবর্ষের এক যুগধর্মী জীবন দর্শনের জীবন্ত প্রতীক। ভাব, চিন্তা ও কর্মবাদের দর্শনে বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র অবিচ্ছেদ্য। বস্তুত, স্বামীজির জীবন-ইতিহাসের অনুধাবন ছাড়া সুভাষ-জীবনের ঐতিহ্য বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ। একই প্রাণপ্রবাহের, একই জীবন-দর্শনের দুই ঐতিহাসিক পর্ব হলেন এই দুই অগ্নিহোত্রী। স্বামীজি প্রাক-যুগের আর নেতাজি উত্তর-যুগের। নেতাজিকে স্বামীজির মন্ত্রশিষ্য বা মানসপুত্র বলা হয়। কিন্তু এই পরিচয়ও পূর্ণাঙ্গ নয়। স্বামীজি ও নেতাজি একই জীবনধর্মের জয়ী তরঙ্গ, কালের সামান্য ব্যবধানে শুধু যুগ-ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। এক পর্ব আগে জন্মালে নেতাজি হতেন স্বামীজি এবং পরের পর্বে আবির্ভূত হলে বিবেকানন্দ হতেন সুভাষচন্দ্র।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে জাতীয় চেতনা প্রবল হয়ে উঠেছিল। আর ঊনবিংশ শতাব্দীতে যিনি ভারতের এই নবজাগ্রত চেতনার উৎস, অনুভূতি, কল্পনা ও আকারের সত্তা নিরূপণ করে ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মান নতুন মূল্যায়ণে নির্ণীত করে ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়গর্বের নতুন ভিত্তি রচনা করেছিলেন তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ তাই ভারতের জাতীয় পুনর্জাগরণের উদগাতা ফাদার অব ইণ্ডিয়ান রেনেসাঁ'। আর সেই রেনেসাঁ 'র বাস্তব রূপায়ণের বিপ্লবী যুগনায়ক হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র।

 

বিবেকানন্দ যে দৃষ্টি দিয়ে ভারতের ইতিহাসের বিচার করেছেন এবং আগামী দিনের জীবনধর্মের জন্য যে জীবন- বাণীর সন্ধান করেছেন, সেই দর্শন ও জীবন-বাণী নেতাজির স্বপ্ন ও সাধনাকে উদ্দীপ্ত করেছে। বৈদান্তিক বিবেকানন্দ আধুনিকতাবাদী, বিজ্ঞানধর্মী। নেতাজিও তাই। কিন্তু বিবেকানন্দের আধুনিকতা ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীন মূল্যকে বাদ দিয়ে নয়। ভারতীয় প্রমূল্যকে অস্বীকার করে নয়। ভারতীয় ইতিহাসের ধারাকে বর্জন করেও নয়। তিনি এ যুগের পাশ্চাত্য বিজ্ঞানবাদ, বৈষয়িক-বাদকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে চেয়েছেন বাহনরূপে, প্রাণশক্তি রূপে নয়। নেতাজির দৃষ্টিও অবিকল স্বামীজির মতো। বেদের যুগে ফিরে চল'-এ ধ্বণিকে নেতাজি যেমন তিরস্কার করেছেন, তেমনি অগ্রাহ্য করেছেন আধুনিকতার নামে উগ্র পাশ্চাত্য বিলাসবাদ বা সুখবানকে। স্বামীজির মতই নেতাজি বলেছেন যে, পৃথিবীর বহু প্রাচীন জাতির জীবনসভা নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বহু ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে, নানা রুপান্তরের পথে নিজের জীবনধর্মকে অবিকৃত রেখে ভারতবর্ষ আজও বেঁচে আছে। ভারত, ভারতের ইতিহাস, ভারতের মানুষ- নেতাজির কাছে 'জননী জন্মভূমি'। বিবেকানন্দের কাছে 'যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী' এই 'দেবভূমি ভারতবর্ষ"। চিরন্তনের যে ডাকে মানুষ সর্বত্যাগী হয়, তারই উৎসে জন্মলাভ করেছে স্বামীজি ও নেতাজির ভারত- প্রেম। স্বামীজি 'দেবভূমি ভারতবর্ষ - এর পরিব্রাজক, নেতাজি ভারত-বাণীর উদ্‌গাতা- 'ভারত-পথিক।

আত্মজীবনী 'অ্যান ইণ্ডিয়ান পিলগ্রিম'-এ সুভাষচন্দ্র লিখেছেন, বালক বয়সে যখন ফুটবল মাঠে নিজেকে পরিশ্রান্ত করে ফেলার কথা, তখন তাকে এমন সব চিন্তায় পেয়ে বসেছিল, যেগুলি পরিণত বয়সের জন্য রেখে দিলে ভাল হত। নিজেকে তিনি কৌতুক করে বলেছেন 'বালবৃদ্ধ' ও 'অকালপক্ক'। এই অকালপক্ক বালকের মধ্যে তাঁর স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস প্রথম ‘একটা অস্পষ্ট নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। বেণীমাধবের কাছ থেকেই সুভাষ পেয়েছিলেন সৌন্দর্যবোধ ও প্রকৃতি প্রেমের দীক্ষা। কিন্তু সেটা সুভাষের কাছে যথেষ্ট ছিল না। এই সময়ে সুভাবের এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এই দ্বন্দ্ব ছিল দু'ধরণের। প্রথমত, এই পার্থিব জীবন ও তার চিরাচরিত কাজকর্মের প্রতি ছিল স্বাভাবিক একটা আকর্ষণ, যার বিরুদ্ধে তাঁর উন্নততর সত্তা বিদ্রোহ শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত, তার মধ্যে দেখা দিয়েছিল বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক যৌন চেতনা, যাকে তিনি অস্বাভাবিক ও চারিত্রিক দুর্বলতা মনে করে তা দমন করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই মানসিক সংকটের সময়ে তাঁর প্রয়োজন ছিল এবং নিজের অজ্ঞাতেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন একটা মূল নীতি যাকে অবলম্বন করে তাঁর সমগ্র জীবন গড়ে উঠতে পারে, আর সেই সঙ্গে জীবনে আর কোনও কিছুর প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার এক দৃঢ় সংকল্প। এই সময় হঠাৎ একদিন তাঁর হাতে এল স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী। আত্মজীবনীতে সুভাষ লিখেছেন, “কয়েক পাতা উলটেই বুঝতে পারলাম এই জিনিসই আমি এতদিন ধরে চাইছিলাম। বইগুলো বাড়ি নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। পড়তে পড়তে আমার হৃদয় মন আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল।... দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল, আমি তাঁর বই নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলাম।... বিবেকানন্দের প্রভাব আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল। .... তাঁর মধ্যে আমার মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার সহজ সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম।”

স্বামীজি বলেছিলেন, আত্মশক্তির উদ্বোধন করতে হলে চিত্তশুদ্ধি ও ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন। এই আদর্শকে সুভাষ জীবনের 'মূলমন্ত্র' হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কটক, কলকাতা, কেমব্রিজ এবং জীবনের পরবর্তী দিনগুলিতে সুভাষ তাঁর চরিত্রের চারপাশে একটি নৈতিক দীপ্তির দুর্ভেদ্য পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলেন। কামনার চঞ্চল তরঙ্গ সেখানে প্রতিহত হয়ে ফিরে যেত—কোন বিক্ষোভ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারত না তাঁর অন্তরে, আর করলেও তাকে অবদমন করার ক্ষমতাও সুভাষ অর্জন করেছিলেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কল্যাণে। বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সুভাষ কৈশোরেই ধ্যান এবং যোগাভ্যাস শুরু করেছিলেন। সেই সময় সন্ন্যাসী-সঙ্গ কামনা সুভাষের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির কোথাও এসেছেন শুনলেই ছুটে যেতেন। চেষ্টা করতেন তাঁদের অন্তরঙ্গ হতে। সাধু-সন্ন্যাসীরা বাড়িতে এলে তাদের যথাসাধ্য দান করে বালক নরেন্দ্রনাথের মতো সুভাষও মনে এক অপূর্ব আনন্দের আস্বাদ পেতেন। ১৯১৩-র বড়দিনের ছুটিতে সুভাষ কলকাতা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে হুগলী নদীর ধারে শান্তিপুরে কয়েকজন বন্ধুসহ গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে এলেন। তাঁর বন্ধু গোষ্ঠীর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন যারা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেমন- হেমন্তকুমার সরকার, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এবং হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি এঁদের কাছেই। বন্ধুদের মধ্যে সবাই ছিলেন বিবেকানন্দের ভক্ত। আত্মজীবনীতে সুভাষ এই বন্ধুগোষ্ঠীকে 'নিও-বিবেকানন্দ গ্রুপ" বলে উল্লেখ করেছেন। শান্তিপুরে সুভাষ ও তাঁর বন্ধুরা সন্ন্যাসজীবনের সবরকম কুজুতাই অভ্যাস করেছিলেন। যেমন ডিসেম্বরের শেষরাতে গঙ্গার ঠাণ্ডা জলে আকণ্ঠ গা ডুবিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটানো ইত্যাদি। কলকাতায় যখন তারা ফিরে এলেন তখন তাঁদের দেখে মনে হল প্রত্যেকে যেন এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-সন্ন্যাসী হওয়ার জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞা সকলের চোখে-মুখে। স্বামীজির আদর্শে তরুণ সুভাষ এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে সমস্ত বাধা নিষেধ, স্নেহপ্রীতির বন্ধন তুচ্ছ করে একবার এক বন্ধুর সাথে ঘর ছেড়ে হিমালয়ের পথে বেরিয়েও পড়েছিলেন। তখন তিনি দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণির ছাত্র। কিছুদিন পরে অবশ্য তাঁকে ঘরে ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু সন্ন্যাসজীবনের প্রতি তথা আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি তার আজীবন আকর্ষণ ছিল এবং বলা বাহুল্য, এই আকর্ষণের প্রেরণা ছিলেন বিবেকানন্দ। পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি সুভাষচন্দ্রের এই আকর্ষণ বজায় ছিল। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদর কার্যালয় থেকে নেতাজি প্রায়ই গভীর রাতে কাউকে না জানিয়ে স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনে যেতেন এবং পট্টবস্ত্র পরে প্রার্থনা ঘরে জপমালা হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধ্যান করতেন। ১৯৪৪-এর জানুয়ারির প্রথম দিকে নেতাজি তাঁর কর্মক্ষেত্র সিঙ্গাপুর থেকে বেগুনে স্থানান্তরিত করেন। ২৪ এপ্রিল ১৯৪৫- যেদিন রাতে নেতাজিকে প্রায় শত্রুকবলিত রেঙ্গুন ত্যাগ করতে হয় তার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রাতের একটি অনবদ্য মর্মস্পর্শী ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী: “সে দিনটি ছিল সত্যিই এক বিচিত্র ও আশ্চর্য দিন। আত্মনিবেদনের এক অবিস্মরণীয় দিন। রেঙ্গুন ত্যাগের পূর্বাহ্ন। আজীবনের স্বপ্ন ও আদর্শের আলেখ্য নিজের চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে ঝুর ঝুর করে। সম্মুখে শুধু অন্ধকারের পারাবার। সেই চরম সঙ্কট- মুহূর্তে, রেঙ্গুন ত্যাগের পূর্বক্ষণে, নেতাজি সামরিক পরিচ্ছদ স্কুলে পরেছিলেন পট্টবস্ত্র। গুচি-শুভ্র নির্বিকার যোগী একাকী চলে গিয়েছিলেন তার আদর্শ পুরুষের প্রাণদেবতার সেবায়তনে। রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে। বসেছিলেন যুগ ঋষির মূর্তির সম্মুখে সমাহিত হয়ে। তদগত তন্ময়। উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে। মহাপ্রস্থানের পূর্বাহ্নে নিজেকে কি দেখতে চেয়েছিলেন তিনি? চিনেও কি ছিলেন? মৃত্যু যে মরা নয়, এ কথা কি তাঁর মনে জেগেছিল? কে জানে?”

 

বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র-সুজনেই ছিলেন দুর্বার বিপ্লবী। কোন বাধা, কোন স্তব বা নিন্দা এই দুই বিপ্লবীকে তাদের জীবন-ব্রত থেকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “একটু আধটু সংস্কারে কিছু হবে না, ভারতের যা চাই তা হল আমূল রূপান্তর।" সত্যার্থী বিপ্লবী সুভাষচন্দ্রের প্রকৃতির জন্যই গান্ধীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও গান্ধীবাদের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতে রাজী হননি। সারাজীবন গান্ধীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন রেখেও নেতাজি নিজস্ব জীবনবাদের বিদ্রোহকে জয়যুক্ত করেছেন।

 

বিশ্বের মৌল স্বরূপের উপলব্ধিতে স্বামীজি ও নেতাজির সত্য দর্শনও ঘটেছে একই দৃষ্টিভঙ্গীতে। নিত্য সত্য বা অ্যাবসল্যুট টুথের কোনও বাহ্য প্রকাশ সম্ভব নয়। তাই সত্যের যে প্রকাশ তা আপেক্ষিক বা রিলেটিভ। স্বামীজির ভাষায়, “ সকল সত্যই আপেক্ষিক সত্য, রিলেটিভ ট্রুথ, নিত্য সত্য বা অ্যাবসল্যুট ট্রুথ মন-বুদ্ধির অগম্য। সত্য নিত্য কিন্তু বিভিন্ন মন-বুদ্ধির কাছে বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হয়”। একই সত্যানুভূতি প্রতিধ্বনিত হয়েছে নেতাজির আত্মজীবনীতে। নেতাজির ভাষায়: “Truth as known to us is not absolute but relative. It is relative to our common mental constitution-to our distinctive characteristics as individuals-to changes in the same individual during the process of time. ভারতের ইতিহাস, সত্যের আপেক্ষিকতাবাদ ও বিবর্তনবাদে বিশ্বাস—এই তিনের সংযুক্তিতে গড়ে উঠেছে স্বামীজি ও নেতাজির সমন্বয়ী জীবনদর্শন। দুজনেই এই সমন্বয়ের বাণীকে এযুগের ভারত-বাণী বলে ব্যক্ত করেছেন এবং এই যুগধর্মী ভারত-বাণী প্রচার করার জন্যই স্বামীজির মত অবিকল্প ভাষায় নেতাজিও অনুভব করেছেন-“আমার জীবনের একটি উদ্দেশ্য আছে- have a mission of fulfil."

 

আধুনিক ভারতের পুনর্জাগরণের নীতি ও পদ্ধতির দৃষ্টিভঙ্গী সম্বন্ধে বিবেকানন্দের অনুসারী ছিলেন সুভাষচন্দ্র। জৈন ও বৌদ্ধধর্মের অপপ্রয়োগের মধ্যযুগ ও তার পরবর্তীকালে ভারতে যে মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছিল তা শান্তি- অহিংসার উচ্চবুলির আড়ালে এক চরম কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিষ্ক্রিয়বাদ মাত্র বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র দুজনেই ভারত ইতিহাসের পর্যালোচনায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। দুজনেরই তাই মনে হয়েছিল শান্তিবাদ ও অহিংসাতত্ত্বকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ নিষ্ক্রিয়তার অবসাদে ভারতকে পঙ্গু করে দেওয়া এবং উচ্চতত্ত্বের নামে ক্লৈব্যবৃত্তিকে ঢেকে ১৯ রাখার সুযোগ দেওয়া। বিবেকানন্দ তাই অহিংসা বা শান্তিবাদের পরিবর্তে নতুন ভারতের জনমানসে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন শক্তিবাদের অগ্নি-স্পন্দন। এ যুগের ভারতকে শুনাতে চেয়েছিলেন 'অভীমঙ্গ'। তেমনি ভারত ইতিহাস পর্যালোচনায় সুভাষচন্দ্র বলেছেন, “রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে ভারতের পতন হল কেন? ভাগ্য ও অলৌকিকতায় ঘোর বিশ্বাস এবং অহিংসাতত্ত্বে আতিশয্যের পথে যে শান্তিবাদী সন্তোষের মনোভাব সৃষ্টি হয়; তাই ভারতের পতনের কারণ।’’

 

স্বামীজির মতে যথার্থ শিক্ষা হল- যার ফলে মানুষের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় জাগবে, ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনচিন্তা ও আত্মসচেতনতার উন্মেষ হবে, চরিত্রবল ও সিংহসাহসিকতা আসবে, মানুষ নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারবে এবং তার মধ্যে পরিপূর্ণ-মনুষ্যত্বের উদ্বোধন হবে, তা-ই যথার্থ শিক্ষা। সুভাষচন্দ্র তাঁর অসংখ্য চিঠি এবং বক্তৃতায় স্বামীজির এই শিক্ষাচিন্তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় শিক্ষার পরিকল্পনায় এই আদর্শকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র।

স্বামীজি ভারতীয় সমাজে নারীকে এক মহান গৌরবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, গার্গী, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বীরাঙ্গনা লক্ষ্মীবাঈ-এর আবির্ভাবকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন। স্বামীজি বলতেন "(এদেশের মেয়েদের) বীরত্বের ভাবটাও শেখা দরকার। এ সময়ে তাদের মধ্যে self-defence শেখা দরকার হয়ে পড়েছে। দেখ দেখি ঝাঁসির রাণী কেমন ছিল!” নারীশক্তি সম্বন্ধে নেতাজিও সেই একই মনোভাব পোষণ করতেন। তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীতে একটি শক্তিশালী নারী বাহিনীও ছিল- 'ঝাঁসির রাণী' বাহিনী।

 

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন'—গীতার কর্মযোগের এক জ্বলন্ত বিগ্রহ ছিলেন বিবেকানন্দ। তিনি চাইতেন কাজ শুধু কাজ এবং এ-ও জানতেন যে, কোন বড় কাজ করতে গেলে বাধাও অনুরূপভাবে বড় হবে। প্রতিপদে পরাজয়, তবু সংগ্রাম, অবিরত সংগ্রাম- এই ছিল তার আদর্শ। গীতার তথা স্বামীজির এই আদর্শকে জীবনের মস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র ১৯২৭-এ ইনসিন জেল থেকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন: “স্বাধীনতা এবং সত্যই আমাদের আদর্শ, রাত্রির পর যেমন দিন আসে, আমাদের চেষ্টাও ঠিক তেমনি সত্য.... আমাদের চেষ্টার সফল পরিণতি দেখিবার মতো সৌভাগ্য কাহার হইবে একমাত্র ভগবানই তাহার বিধানকর্তা। আমার সম্বন্ধে আমি বলিতে পারি যে, আমি আমার কাজ করিয়া যাইব, তারপর যাহা হয় হইবে।"

 

বিবেকানন্দ সুস্বাস্থ্য রক্ষার উপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেছিলেন: “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে। ... তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে।” বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে সুভাষচন্দ্র একই কথা বারবার বলেছেন, বিশেষ করে বাংলার যুবকদের উদ্দেশে। কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত পর স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রদের দেওয়া সম্বর্ধণার উত্তরে নানা কথার মধ্যে তিনি বলেন, ”এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এই শরীর নিয়ে আমরা জীবনের সংগ্রাম চালাতে পারব না। জীবন সংগ্রাম দিন দিন আরও কঠিন হচ্ছে। সমস্ত নৈতিক ও বৌদ্ধিক শক্তি সত্ত্বেও শারীরিক শক্তি ছাড়া আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারব না। সুতরাং বাংলার ছাত্রছাত্রীদের সামনে শারীরিক শক্তির উন্নতি সাধন একটি বড় কাজ। পাঞ্জাবের ছাত্রদের এই উপদেশের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলার ছাত্রদের ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন রয়েছে এবং ছাত্রীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে।”

 

আর একটি সামাজিক প্রশ্নে বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের চিন্তা একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। বিবেকানন্দ মনে করতেন সমাজে এক এক শ্রেণির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিয়ে হচ্ছে বলে মানুষের রক্ত দূষিত হয়ে পড়ছে, শরীর দুর্বল। হয়ে যাচ্ছে, সব শিশুই রোগ নিয়ে জন্মাচ্ছে। অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন হলে শরীরে নতুন রক্ত এসে পড়বে। শিশুরা রোগ থেকে মুক্তি পাবে এবং অনেক বেশি কর্মঠ হবে। সুভাষচন্দ্রও এই অসবর্ণ বিবাহের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল-ভারতে বহুবার রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটেছে বলে ভারতীয় জাতি পুনর্জীবন লাভ করেছে। যারা বর্ণসন্তরের ভয় করেন, তারা ভারতের ইতিহাস জানেন না এবং তারা মানববিজ্ঞান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। বহুকাল অসবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বলে জাতির রক্তস্রোত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এখন নতুন রক্ত চাই। অসবর্ণ বিবাহ শুরু হলে যথেষ্ট রক্ত সংমিশ্রণ ঘটবে এবং এর ফলে জাতি জীবনী শক্তি ফিরে পাবে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের নীতি-পদ্ধতির দিক থেকেও বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল। বিবেকানন্দ আবেদন-নিবেদন রাজনীতির কড়া সমালোচক ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, স্বাধীনতা ভিক্ষে করে বা আপস করে পাওয়া যায় না, জোর করে ছিনিয়ে নিতে হয়। সুভাষচন্দ্রও এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯২৯ - এ লাহোর কংগ্রেসে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁর সে দাবি অবশ্য গৃহীত হয়নি।

তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার কয়েক বছর আগে সুভাষচন্দ্র একটি চিঠিতে লিখেছেন: “শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋণী, তাহা ভাষায় কি করিয়া প্রকাশ করিব? তাহাদের পুণ্যপ্রভাবে আমার জীবনের উম্মেষ। নিবেদিতার মতো আমিও মনে করি যে, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ একটা অখগু ব্যক্তিত্বের দুই রূপ। আজ যদি স্বামীজি জীবিত থাকিতেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার শুরু হইতেন অর্থাৎ তাহাকে আমি নিশ্চয়ই গুরুপদে বরণ করিতাম যাহা হউক, যতদিন জীবিত থাকিব, ততদিন যে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একান্ত অনুগত ও অনুরক্ত থাকিব- এ কথা বলাই বাহুল্য। " স্বামীজির সম্পর্কে নেতাজি কী অপরিসীম শ্রদ্ধা, কী গভীর ভালবাসা এবং কী প্রগাঢ় অনুরাগ পোষণ করতেন, তার আবেগময় স্বীকারোক্তি এই চিঠিটি। বাস্তবিক, স্বামীজির ভাবতে, বলতে অথবা লিখতে গেলেই সুভাষচন্দ্র ‘আত্মহারা’ হয়ে যেতেন। সুভাষচন্দ্র লিখেছেন— “ত্যাগে বেহিসাবী, কর্মে বিরামহীন, প্রেমে সীমাহীন স্বামীজির জ্ঞান ছিল যেমন গভীর তেমনি বহুমুখী। ...আমাদের জগতে এরূপ ব্যক্তিত্ব বাস্তবিকই বিরল। স্বামীজি ছিলেন পৌরুষসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। ... ঘন্টার পর ঘন্টা বলে গেলেও সেই মহাপুরুষের বিষয় কিছুই বলা হবে না। এমনি ছিলেন তিনি মহৎ, এমনই ছিল তাঁর চরিত্র-যেমন মহান তেমনি জটিল । ...আজ তিনি জীবিত থাকলে আমি তাঁর চরণেই আশ্রয় নিতাম।” “ব্যক্তি” বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ না মিললেও সুভাষচন্দ্র 'আদর্শ' বিবেকানন্দের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বস্তুত, বিবেকানন্দ কোন ব্যক্তি নন, তিনি একটি আদর্শ, একটি প্রেরণা, লক্ষকোটি ভারতবাসীর আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সাধনার মূর্ত প্রতীক। এবং সুভাষচন্দ্র যেখানে নিজেকে উৎসর্গ করেন সেখানে সামগ্রিকভাবেই করেন : “Where surrender, do so with all my heart."

লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর।

Mailing List