জনসংখ্যা নাকি ভয়ঙ্কর ভাবে কমে যাচ্ছে! বাড়ছে চিন্তা, হঠাৎ কেন এ পথে এগোচ্ছে বিশ্ব?

জনসংখ্যা নাকি ভয়ঙ্কর ভাবে কমে যাচ্ছে! বাড়ছে চিন্তা, হঠাৎ কেন এ পথে এগোচ্ছে বিশ্ব?
রাকেশ ঘোষ
বিশ্বজুড়ে দেশগুলি কি জনসংখ্যার (Population) চাপে দিশেহারা? নাকি সংখ্যা তত্ত্বের গভীরে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন। শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে সন্তান সন্ততির সংখ্যা বাড়ালে জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, এমনটা নয়। উল্টে সমঝোতা করতে হচ্ছে জীবনের প্রত্যেক ধাপেই।
অন্তত ভারতবর্ষের (India) বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত প্রকট ছিল। একজন চারটি সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন। একটু লক্ষ্যকরলে দেখা যায়, তিনি আবারও গর্ভবতী। ফলে জীবনের প্রতিটি ধাপেই সমঝোতা। ইচ্ছে হল, সাইকেল চালিয়ে দীর্ঘপথ যেতে যেতে অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাচ্ছি, একটি মোটরবাইকের প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ছেলেটার পরীক্ষার ফিজ দিতে হবে, সামনে মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে। অতএব, নিজের সুখের কথা ভাবলে চলে না। আর সেই শিক্ষা থেকেই ভারতবর্ষের মধ্যে আর এক ভারতবর্ষকে দেখা যাচ্ছে। যেখানে বহু দম্পতি একটির বেশি সন্তান নিতে চাইছেন না। ফলে স্বাভাবিক জনজীবনে কলকাতার অফিস পাড়ায় হাঁটতে গেলে যেমন একজনের সঙ্গে আর এক জনের ধাক্কা লাগবেই, আগামি ভবিষ্যতে কী সেটাই থাকবে? নাকি লকডাউনের সময় বাইরে বেরোলে হাতে গোনা যে দু’চারটি মানুষ দেখা যায়, তেমন হবে?
ভারতবর্ষ যদিও এখন উদাহরণ হয়ে ওঠেনি। আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আমরা যদি বিশ্বের দিকে তাকায়, তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে সংখ্যা তত্ত্বের গভীরতার মধ্যে ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নের বীজ কতটা লুকিয়ে।
ইতিমধ্যেই ইতালিতে মাতৃত্বকালীন বিভাগ বন্ধ হয়ে গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যাপ্ত ছাত্রছাত্রী পাচ্ছে না, জার্মানিতে সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। চিনে জনমানবহীন ভূতের শহর তৈরি হচ্ছে। যদিও আফ্রিকাতে জনসংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। কিছু বিজ্ঞানী মত পোষণ করেন, আগামী শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বজনসংখা স্থায়ী হ্রাসে প্রবেশ করবে।
এই মাসের জনগণনা বলে, চিন (China) ও আমেরিকা যুক্তরাষ্টের (America) জন্মহার কয়েক দশক ধরে কমছে। দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার চাপ ও নিম্নমানের জীবনযাত্রার কথা চিন্তা করে তারা কিছুটা ভীতই। প্রভাব লুকোনো যাচ্ছে না। জন্মহার ধারণা দিচ্ছে-- প্রতিদিনের অনটনের ফাঁস থেকে বেরিয়ে তরুণরা নিশ্চিত এবং স্বচ্ছল অর্থনীতির স্রোতেই গা ভাসাতে চান।
জার্মান জনসংখ্যাবিদ ফ্র্যাঙ্ক সোয়াকজনি (Frank Swakzny) বলছেন, "দেশগুলিকে বাঁচতে শিখতে হবে এবং পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে।’’ ইতিমধ্যেই পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে এই প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বিংশ শতাব্দী ভিন্ন এক চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছিল, দীর্ঘায়ু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা ১৯০৬ সালে ১৬০ কোটি থেকে ২০০৬ সালে ৬০০ কোটিতে পৌঁছয় - যা সর্বাধিক বৃদ্ধি। কিছু কিছু দেশে বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করে, সেই বৃদ্ধির গতি এখনও অবশ্য চলছে।
কিন্তু প্রায় সর্বত্রই পরিবারের ধারণা বদলাতে চলেছে। একান্নবর্তী পরিবারের পুরনো ধারণা প্রায় অবলুপ্তির পথে। এখন অণু-পরমাণু পরিবারের ধারণা। এমনকি, সন্তান ছাড়া লিভ টুগেদার, লিভ ইন।
আলোচনা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টির গভীরতা অনেকখানি। সময়ের সঙ্গে সভ্যতার বিকাশ ও চেতনার প্রকাশ। পুরনো ধ্যানধারণা নেই বললেই চলে, আবার কোথাও কোথাও তা থাকলেও তা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। বিয়ের বছর ঘুরলেই এখন প্রতিবেশী বা আত্মীয়রা বলেন না যে, কি গো বৌমার পেটে যে এখনও বাচ্চা এলো না। বা বললেও তা গুরুত্ব দিতে রাজি নন দম্পতি। কারণ, মহিলারা আরও বেশি করে শিক্ষায় এবং কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। ফলে সন্তানধারণের বিষয়টি তাঁদের কাছে একমাত্র মুখ্য বিষয় নয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, এটি নির্দিষ্ট সময়ে নিলে সমস্যা নেই। ফলে কমসংখ্যক শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলেও ছড়িয়ে পড়ছে। হয়তো আরও কয়েক দশক লাগতে পারে, কিন্তু একবার শুরু হলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তখনই আমরা জন সংকোচনের পথে প্রবেশ করবো। যার শুরুটা কিন্তু হয়ে গিয়েছে।
এশিয়ান জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ স্টুয়ার্ট গিয়েটেল বাসটেন (Stuart Gietel Basten) বলছেন, "এটি একটি আবর্তিত প্রক্রিয়া, জনতাত্বিক গতি"।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট, অস্ট্রেলিয়া, (Australia) কানাডার (Canada) মতো দেশে, যেখানে জন্মহার বৃদ্ধি দুই শতাংশের মধ্যে থাকে, ২০১৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মহার ০.৯২ এ নেমেছে (যা সর্বনিম্ন রেকর্ড)। যা থেকে পরিষ্কার, একজন মহিলার প্রতি একজন সন্তানও নেই!
ক্রমহ্রাসমান এই জন্মহার সিওলের মতো বড়ো শহর বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। পরিকাঠামো রয়েছে। তবু বহু স্কুল বন্ধ। খেলার মাঠ আগাছায় ভরেছে। কারণ, পর্যাপ্ত শিশু নেই। কে স্কুলে ভর্তি হবে, কে খেলতে যাবে।
বাড়িতে নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব করাতে হবে। ভারত-সহ অনেক দেশেই এমন স্লোগানে জোর দেওয়া হয়, শুধুমাত্র সদ্যোজাতদের (New born baby) মৃত্যুহার কমাতে। এভাবে চলতে থাকলে সেই সব ইউনিটও হয়তো ধীরে ধীরে উঠে যাবে। ১৯৯২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৮ বছর বয়সী যুবকের সংখ্যা যেখানে ৯ লক্ষ ছিল, বর্তমানে তা পাঁচ লক্ষে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে, শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের জন্য কিছু স্কুল আইফোন পর্যন্ত দিচ্ছে। সরকার শিশুর জন্ম হলে বোনাস দিচ্ছে, গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসাতে ভর্তুকি বৃদ্ধি করেছে, বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া লাগছে না, উল্টে সন্তানের জন্ম দিলেই মিলছে টাকাও। সিওলে (Seoul) প্রতিটি বাস ও পাতাল রেল গর্ভবতী মহিলাদের (Pregnant lady) জন্য আসন সংরক্ষিত করেছে। তাতেও সুফল মিলছে না।
সম্প্রতি দক্ষিন কোরিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী হংক-নাম-কি বলেছেন, সরকার গত পনেরো বছরে ১৭৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে মহিলাদের সন্তান ধারণে উৎসাহিত করতে, তবু পর্যাপ্ত অগ্রগতি ঘটেনি।
৩৮ বছর বয়সি কিম-মি-কিয়ং বলেন, আমার দাদা-দাদির ছয়টি বাচ্চা ছিল এবং মায়েরাও পাঁচজন ছিল। কারণ তাঁদের প্রজন্ম একাধিক সন্তানধারণে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু আমার একটাই সন্তান। আমার এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে সমস্ত বিষয় বিবেচনার মতোই সন্তানের বিষয়টিও অগ্রাধিকার পায়।
ইতালির ৯৩ বছর বয়সি কনসেটা ডি আন্দ্রেয়া এক ছোট্ট স্কুলের গল্প শোনালেন। বললেন, এখানে অনেক পরিবার ছিল। অনেক শিশুও ছিল। স্কুলটিতে একজন ছাত্র ছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি ওই স্কুলের শিক্ষকও হন। কিন্তু এখন আর স্কুলে কেউ নেই।
কেপরাকোটায় জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে। পাঁচ হাজার থেকে এখন জনসংখ্যা পৌঁছেছে মাত্র ৮০০ তে! এমনকি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজকদের দল গঠনের জন্যও জোর লড়াই চালাতে হয়।
প্রায় দেড় ঘন্টা দূরে অগ্নোন শহরে এক দশক আগে প্রসূতি ওয়ার্ডটি বন্ধ হয়েছে। কারণ এটিতে অত্যন্ত কম গর্ভবতী মায়েরা আসছেন। বাচ্চা জন্মগ্রহণের হারও অত্যন্ত কম। এই বছরে আগ্নোন শহরে মাত্র ছটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেছে।
ইতালির জন্মগত সংকট নিয়ে পোপ ফ্রান্সিস এই মাসে এক সম্মেলনে বলেন যে, "জনসংখ্যার শীত" এখন "ঠান্ডা ও অন্ধকার"। জাপানের পর ইতালি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃদ্ধ দেশ। জনসংখ্যার গড় বয়সের নিরিখে। সেখানে ভারতের গড় বয়স ২৯, চিনাদের ৩৭ এবং জাপানীদের ৪৮।
তবে গতবছর দ্য ল্যানসেট-এ (The Lancet) আন্তর্জাতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন, ১৯৫ টি দেশের মধ্যে ১৮৩ দেশ ও অঞ্চলের জন্মহার ২১০০ সালে খুব নিচে নেমে আসবে। তাদের মডেল চিনের জন্য তীব্র হ্রাস দেখিয়েছিল। যেখানে চিনের জনসংখ্যা এখন ১.৪২ বিলিয়ন, সেখান থেকে থেকে কমে ২১০০ সালে প্রায় ৭৩০ মিলিয়ন হয়ে যাবে। সদ্য প্রকাশিত জনগণনার সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, চিনের উত্তর পূর্ব অবস্থিত রাস্ট বেল্ট এর জনসংখ্যা ১.২ শতাংশ কমেছে।
অনেক দেশ এই বিষয়টিকে মেনে নিয়েই এগোতে চাইছে। এখন থেকে সেই প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েচে বলা যায়। দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একীভূত করার জন্য চাপ দিচ্ছে। জার্মানি অবসরকালীন বয়স বাড়িয়েছে। ৬৭ থেকে ৬৯ তে নিয়ে গিয়েছে।
জার্মানির ফেডারেল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন রিসার্চের (Federal Institute for Population Research in Germany) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো Swaczny বলেন-"হ্রাসের সাথে বৃদ্ধিও একটি চ্যালেঞ্জ"
জনসংখ্যাবিদরা জনসংখ্যা হ্রাস বিষয়ে সতর্কও করেছিলেন। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন, অনেক মহিলার সন্তান কম। তাঁরা এটাই চান। কারণ, পরিবারে সদস্য সংখ্যা কম থাকলে কম বেতনেও উচ্চ মানের জীবনযাত্রা সম্ভব।
ক্যাসানোভর উদ্ধৃতি দিয়ে জিয়েটেল বাসটেন বলেন, "নিয়তির মতো কিছুই নেই, আমরা নিজেরাই আমাদের জীবনকে রূপ দান করি।’’
৩৭ বছর বয়সি আনা পারোলিনী বলেন, তিনি আমেরিকার ছোট শহর ছেড়ে মিলানে প্রেমিকার সাথে থাকেন ও সন্তান ধারণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর বেতন ২ হাজার ইউরো এর কম। এবং তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মা থাকায় সে বাচ্চা নিতে পিছু হঠেছে।
পৃথিবী ব্যাপী কোনো নিয়ম লাগু করা যাবে না। সংকটের মাত্রার বিভিন্নতা আছে। সমাধানের রাস্তাও তাই বিভিন্ন। বিবর্তনে মানুষ কোন পথে হাঁটবে সেটা কি সবটাই মানুষের হাতে আছে?


