দুই জাকার্তায় তিনদিন, ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলছেন সুদর্শন নন্দী

দুই জাকার্তায় তিনদিন, ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলছেন সুদর্শন নন্দী
01 Jan 2023, 03:13 PM

দুই জাকার্তায় তিনদিন, ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলছেন সুদর্শন নন্দী

 

সুদর্শন নন্দী

 

ভারতের সাথে ইন্দোনেশিয়ার যোগাযোগ সেই প্রাচীনকাল থেকেই। খৃষ্টাব্দের শুরুতেই ভারতীয়দের ইন্দোনেশিয়া আগমন শুরু হয়। গড়ে ওঠে বাণিজ্যিক সম্পর্ক। প্রথম থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয়দের প্রবেশ চলতে থাকে এবং স্থায়ীভাবে ভারতীয়রা থেকেও যান। সংস্কৃত ভাষা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর প্রভাব পড়ে এই দ্বীপ দেশটিতে। আর এর ফলে হিন্দুধর্মও ছড়িয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে। পরে সংমিশ্রণ হয় বৌদ্ধ-সংস্কৃতি। আবার তেরো শতকে মুসলমান ব্যবসায়ীরা ইন্দোনেশিয়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে। বাণিজ্যের সাথে শুরু হয় ইসলামধর্মের প্রচার। পরে ইন্দোনেশিয়া উপনিবেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের অধীনে থাকে এবং পরে স্বাধীনতামুক্তি। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যাই হোক আজ ইন্দোনেশিয়ায় আশি শতাংশের বেশি মুসলমান যা বিশ্বের প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। অন্যদিকে বালিতে হিন্দু ধর্মের মানুষ বেশি। কি অদ্ভুত এক ভ্রাতৃত্ত্বে বাঁধা সে দেশের মানুষ। ধর্ম যার যার, দেশ সবার।  

কাছেপিঠে বিদেশ ভ্রমণে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের জুড়ি নেই। সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী চার থেকে চোদ্দ দিন ভ্রমনেও যেন সব দেখা শেষ হয় না। অনেকে যেমন শুধু বালি ঘুরে চলে আসেন তেমনি অনেকে শুধু জাভাদ্বীপের জাকার্তা জোগজাকার্তা দেখেন হাতে সময় কম থাকলে। এডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকরা আবার বেশির ভাগ সময় কাটান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সরীসৃপ ড্রাগন দেখতে কমডো ড্রাগন আইল্যান্ড ঘুরে।   

এই ভ্রমণ ইন্দোনেশিয়ার জাভাদ্বীপে অবস্থিত রাজধানী শহর জাকার্তা এবং জোগজাকার্তা এই দুটি শহর। একটি প্রাণচঞ্চল রাজধানী শহর। অন্যটি মন্দির-মসজিদ ও সাংস্কৃতিক শহর। জোগজাকার্তার ডাক নাম জোগজা। আগেই বলেছি, ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপ বাদ দিলে সর্বত্রই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়া। প্রায় ২৮ কোটি মানুষের দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। সব ধর্মের প্রতি সহনশীলতা এবং সব ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ইন্দোনেশিয়াকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে রেখেছে। পর্যটনের দিক দিয়েও দেশটি বিশ্বের অন্যতম।

আমরা জাকার্তা ও জোগজাকার্তায় ছিলাম তিনদিন। গিয়েছিলাম দমদম থেকে। সরাসরি বিমান না থাকায় গেলাম ব্যাংকক। সেখান থেকে রয়েছে জাকার্তার ডাইরেক্ট ফ্লাইট। তবে আমরা গিয়েছিলাম বালি হয়ে প্রথমে জোগজাকার্তায়। জোগজাকার্তা থেকে জাকার্তা ট্রেনেও যাওয়া যায়। আমরা বালি থেকে সোয়া এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম জোগজাকার্তায়। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গেলাম হোটেলে। হোটেলে উঠেই খবর পেলাম পাশের বিশাল মাঠে বাৎসরিক উৎসব ও মেলা চলছে। জোগজাকার্তা সাংস্কৃতিক শহর। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের বাস। ৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন শহরের। খবর পেয়েই দৌড়লাম সেই বিশাল মেলা প্রাঙ্গনে। উৎসব যেমন জাঁকজমকপূর্ণ ও বিশাল তেমনি নামটিও বেশ বড়। ইংরেজিতেই লিখছি- Selamat datang di manunggal fair . শহরের খুব জনপ্রিয় উৎসব জানা গেল।  প্রাঙ্গণে চলছে বিভিন্ন প্রোগ্রাম। ছোট বড় সবার জন্য। ছোটবড়  অসংখ্য স্টল, লাইটের কাজ দেখে চোখ ধাধিয়ে গেল। ঘণ্টা খানেক মেলায় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। পরের দিন প্রোগ্রাম সুলতান প্যালেস, একটু দুরের পাণ্টাইপারাংট্রাইটিস নামের সমুদ্র বিচ এবং প্রাম্বানান মন্দির। 

হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল সকাল বেরোলাম শহরে। জোগজাকার্তা শহরটি খুব চনমনে। প্রথমে আমরা গেলাম সুলতান প্যালেস। বিশাল চত্বর জুড়ে সেই প্রাসাদ। ধাতুর পিলার, পাতলা টালির ছাউনি, খিলান সব সোনালি  রঙের। কারুকাজ দেখার মতো। রয়েছে মিউজিয়াম। সুলতানের ইতিহাস বর্ণিত রয়েছে মিউজিয়ামে। সুলতানই শহরের প্রধান এবং ইমামও।  নহবতখানার মতো এক জায়গায় সঙ্গীত ও বাজনা নিয়ে ব্যস্ত সুলতানের শিল্পীরা। পুরো প্যালেসটি গাইড আমাদের ঘোরালেন। সেখান থেকে বেরিয়ে রওনা হলাম জোগজাকার্তার প্রধান হিন্দুমন্দির প্রাম্বানান। অষ্টম শতাব্দীতে রাজা শৈলেন্দ্রর রাজত্বকালে নির্মিত এই হিন্দু মন্দির। ঐতিহাসিকদের মতে রাজা শৈলেন্দ্র যে বৃহত্তম বোরোবুদুর বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন তাঁর এলাকায়, তাঁর জবাবেই এই হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেন এলাকার হিন্দু রাজা সঞ্জয়। আগ্নেয়গিরি ভুমিকম্পে  অবশ্য পাশাপাশি অনেক মন্দির নষ্ট হয়ে যায়। প্রাম্বানানের মন্দিরটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ প্রাপ্ত। কেন্দ্রিয় ইমারতটি ১৫৪ ফুট উঁচু। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় হিন্দু মন্দির এটি। বস্তুত শিব মন্দির এটি। মন্দিরের গায়ে রয়েছে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী নির্ভর অসংখ্য শিল্পকলা। আমরা ঘণ্টা দুই সেখানে  কাটিয়ে শহর পরিদর্শন সেরে নিলাম। লাঞ্চ সেরে গেলাম প্রায় পঞ্চাশ কিলমিটার দূরে পাণ্টাই পারাংট্রাইটিস সমুদ্র বিচে। বিচের নামটি উচ্চারণ করতে দাঁত নড়ে যাবার জোগাড় আর কি। কালো বালির বিচটি খুব একটা পরিষ্কার নয়। একদিকে পাহাড়, বাকি শুধু জল আর জল। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। পরের দিন ভোরে যাব  বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির বোরোবুদুরে। দেরি হলে  সকাল এগারোটায় জাকার্তার বিমান ফেল করব।

পরের দিন ভোর সাড়ে তিনটায় রওনা হয়ে সোয়া চারটায় পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত বোরোবুদুর বৌদ্ধ মন্দির। সূর্যোদয় দেখতে আগেই অনেকে মন্দির চত্বরে ঢুকে গেছেন। আমরা শুধু বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করব। শুধু মন্দির চত্বরের আয়তন ২৫২০ বর্গমিটার। চারিদিকে গাছগাছালি, বাগিচায় ভরা অত্যন্ত মনোরম এই জায়গা। অবাক হলেও সত্য অষ্টম- নবম শতাব্দীতে তৈরি এই বিশাল মন্দির কয়েক শতাব্দী মানুষের চোখের আড়ালে ছিল। সাত আট শতকের পর এই বিশাল নির্মাণ সবার চোখ এড়িয়ে যায়। সুনামি, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির দেশ ইন্দোনেশিয়া।  সম্ভবত আগ্নেয়গিরির ছাই বা ঝড়ে বা ভুমিকম্পের বিপর্যয়ে মানুষজন এলাকা পরিত্যাগ করেন। বোরোবোদুরে হিন্দু রাজা শৈলেন্দ্রের শাসন ছিল। শৈলেন্দ্রের  বংশধর পাঁচশ বছর ( পঞ্চম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত) রাজত্ব করেন। পরে তিনি বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন। কথিত যে  সেই সময় তিনি এই বৃহত্তম বৌদ্ধ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই মন্দিরটি সবার গোচরে ছিল । তারপর সেখান থেকে জনপদ সরে এলে অগোচরে থেকে যায় মন্দিরটি। আবার মন্দিরটি  উনবিংশ শতকে  নজরে আসে সবার এবং বিংশ শতাব্দীতে ইউনেস্কো সংস্কার কাজে সহায়তা করে। আজ মন্দিরটি  পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। অসংখ্য বৌদ্ধ স্তূপ মন্দিরে গায়ে রয়েছে। বৃহৎ স্তূপটি রয়েছে  পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরের শীর্ষে।  বিশাল বাগান চত্বরটিও ঘুরতে ভালো লাগে।

মন্দির দেখে হোটেলে ফিরে নটায় বেরিয়ে গেলাম বিমানবন্দরের পথে। এগারোটায় ফ্লাইট আমাদের। ছোট বিমানে যাব জাকার্তা। সোয়া ঘণ্টার জার্নি। প্রায় ছশ কিলোমিটার এই রাস্তায় রয়েছে ট্রেনও। আমাদের হাতে সময় কম। তাই ফ্লাইট ছাড়া নিরুপায়।

বেলা সাড়ে বারোটায় পৌঁছে গেলাম রাজধানী জাকার্তায়। রাজধানী শহর জাকার্তার আয়তন প্রায় ৬৬৫ বর্গ কিলোমিটার। এক কোটি লোকের বাস শহরে। বেশ জাঁকজমকপূর্ণ শহর জাকার্তা। বিশাল বিশাল বিল্ডিং দেখে চোখ ছানাবড়া। আমাদের কার একটি বহুতল বাড়ির দশ তলায় উঠে গেল ঘুরে ঘুরে। জীবনে প্রথম গাড়িতে চেপে দশতলা বিল্ডিং এলাম। রোমাঞ্চের বেশ। হাই ফাই হোটেল। সেদিন সন্ধ্যায় হল শহর দর্শন। পরের দিন সকালে বেরিয়ে গেলাম মনুমেন্ট দেখতে। ১৩২ মিটার উঁচু এই মনুমেন্ট নির্মিত হয় ১৯৬১তে। চারিদিকে গাছগাছালি আর ফুলের সমাহার। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম জাকার্তার অন্যতম ও মূল দ্রষ্টব্য জাতীয় মিনিয়েচার পার্ক। সারা ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠী, ভাষা, এলাকার জনজীবনের সার্বিক নির্মাণ রয়েছে এই বিশাল আয়তন জুড়ে থাকা মিনিয়েচার পার্কে। রয়েছে ট্রেনবাসে চেপে ঘোরার ব্যবস্থা। প্রায় ঘণ্টা চারেক কেটে গেল সে সব দেখে। দেখলাম মিউজিয়াম ও লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান। সত্যি বলতে কি ষোল আনা সফল হয়েছে এই তিন দিন ঘুরে। এবার হোটেলে ফিরে ঘর ফেরার পালা। আমরা জাকার্তা থেকে এলাম  ব্যাংকক। সেখান থেকে দমদম।

      

যাওয়া আসার তথ্যঃ

কলকাতার দমদম থেকে সিঙ্গাপুর, হংকং, ব্যাংকক হয়ে জাকার্তা।  জাকার্তা থেকে ট্রেনে বা বিমানে আসুন জোগজাকার্তায়। আমরা আগে জোগজাকার্তা যাই বালি হয়ে। সেখান থেকে যাই বিমানে জাকার্তা। জাকার্তা থেকে সরাসরি ব্যাংকক হয়ে ফিরি দমদম। অসংখ্য হোটেল শহরে। নামী ট্যুরসংস্থার মাধ্যমে বুক করা যেতে। ভারতীয় চার-পাঁচ  হাজার টাকায় থাকার উপযোগী হোটেল ভালো পাওয়া যায়। খাওয়া দাওয়া বেশির ভাগ হোটেলে পাওয়া যায়। চাল দিয়ে তৈরি মেসি গোরেং জনপ্রিয় খাবার। খাওয়ার খরচ সাধ্যের মধ্যেই। ভিসা বিমান বন্দরে হয়ে যায়। ভারতীয় একটাকা ইন্দোনেশিয়া ১৯০ রুপির সমান। একশ ডলার সমান চোদ্দ লাখ ইন্দোনেশিয়া রুপি।

(ছবিঃ সুদর্শন নন্দী)                          

 ******

 

Mailing List