সুবর্ণরেখা নদী কতটা বিপন্ন? এখনও কী সোনা মেলে? নতুন তথ্য মিললো গবেষণায়

সুবর্ণরেখা নদী কতটা বিপন্ন? এখনও কী সোনা মেলে? নতুন তথ্য মিললো গবেষণায়
আনফোল্ড বাংলা প্রতিবেদন: সুবর্ণরেখা। যে নদীটি ছোটনাগপুর অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়ের জীবনরেখা হিসাবে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু বর্তমানে সেটাই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তার প্রধান কারণ হল, দূষণ। 474 কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি থেকে প্রায় 15 কিলোমিটার দূরে নাগদি গ্রামের রানি চুয়ান থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি বলেশ্বরে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়ার আগে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
কয়েক বছর আগেও দেখা যেত নদীর চরে কারা যেন বসে রয়েছে। কাছে গেলে বোঝা যেত, নদীর জলের বালি তুলে তা শুকনো করতে দিয়েছে। আর তার মধ্যে থেকে কিছু যেন খুঁজছে। কথা বলে জানা যায়, এক শ্রেণির মানুষ নদীর বালি ফিল্টারিং এবং নদীর তল থেকে সোনা খুঁজছে। যখন নদীতে জল কম থাকে, তখনই এ দৃশ্য মিলতো। তাই এই নদীর নাম সুবর্ণরেখা হিসেবে নামের সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরেছিল অনেক বেশি। কারণ, নামের সঙ্গে কাজের এমন সাজুয্য সব সময় মেলে না যে। গবেষকরা জানিয়েছেন, মাসে 60 থেকে 80টি সোনার কণাও সংগ্রহ করতে পারতেন অনেকে।
তবে বর্তমানে নৃতাত্ত্বিক হুমকির কারণে নদীর সৌন্দর্যের অবনতি ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের পাঁশকুড়া বনমালি কলেজের (স্বায়ত্তশাসিত) পরিবেশবিদ ও অধ্যাপক মৃন্ময় ঘোড়াইয়ের মতে, সুবর্ণরেখা নদীর স্বাস্থ্যের অবস্থা এখন ভীষণ খারাপ। কারণ, যে জামশেদপুর প্রধান জলের উৎস ছিল, তা কমেছে। বেশিরভাগ জল ব্যবহৃত হচ্ছে নানা শিল্পে। আবার উল্টোদিক দিয়ে দুষিক জলও ঢুকছে নদীতে। তাই বর্তমানে নদীতে জলের পরিমাণ গত তিন বছরে গড়ের চেয়ে কম বলে প্রমাণিত হয়েছে গবেষণায়৷
ডক্টর ঘোরাইয়ের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বড় শহর এবং অন্যান্য শহরের কাছে দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা, জলে অজৈব পদার্থ দ্রবীভূত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গালুডি, ঘাটশিলা এবং জামশোলার কাছে তা কাঙ্খিত সীমার নিচে পড়ে। পিএইচ স্তর 7.8 এ রেকর্ড করা হয়েছিল, যা প্রাকৃতিক জলাশয়ের জন্য অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করেছে। সুবর্ণরেখা নদীর নিচের অংশে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে এর গতিপথ ও গঠনগত পরিবর্তনও হয়েছে। যা বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকাকে প্রভাবিত করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা, বিশেষ করে জেলেরা জানিয়েছেন, নদী থেকে তাদের আয় অনেকটাই কমে গেছে।
সুবর্ণরেখা থেকে বেআইনি বালি উত্তোলনের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়া সত্ত্বেও ক্রমাগত অবৈধ বালি উত্তোলন চলছেই। তারই সঙ্গে সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরও বালি তোলার অনুমতি দিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। আর সেই বালি তোলার জন্য সুবর্ণরেখা থেকে 2022-2023 সময়কালে 78 কোটি টাকা রাজস্বও আদায় হয়েছে। এসবের ফলেই মাছের প্রজনন ক্ষেত্রও ধ্বংস হচ্ছে।গবেষক ডক্টর ঘোড়াই জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি মাছের প্রজাতি এখন প্রচন্ড হুমকির সম্মুখীন। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে সেই সব মাছ হারিয়ে যাবে। মোট 58টি মাছের প্রজাতির মূল্যায়নও করা হয়েছে। যার 81% সবচেয়ে কম উদ্বেগজনক। তবে 9% বিপদের কাছাকাছি, এবং 5% ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি 5% ডেটার ঘাটতির কারনে বর্তমান অবস্থা জানা যায়নি।
অ্যাঙ্গুইলা বেঙ্গলেন্সিস, নোটোপ্টেরাস চিটালা, সিলাগিনোপসিস প্যানিজুস, প্যারাম্বাসিস লালা, ওমপোক বিমাকুলাটাস, ওমপোক পাবদা এবং লাবেও পাঙ্গুসিয়া (Anguilla bengalensis, Notopterus chitala, Sillaginopsis panijus, Parambasis lala, Ompok bimaculatus, Ompok pabda, and Labeo pangusia) সহ সাতটি প্রজাতি "হুমকির সম্মুখীন"।সাইপ্রিনাস কার্পিও, ওয়ালাগো আট্টু, ওরিওক্রোমিস মোসাম্বিকাস এবং চন্না ওরিয়েন্টালিস (Cyprinus carpio, Wallago attu, Oreochromis mossambicus, and Channa orientalis) নামে চারটি প্রজাতি "ভালনারেবল" শ্রেণীতে পড়ে। শুধুমাত্র দুটি প্রজাতি, রাস্ট্রেলিগার কানাগুর্তা এবং অ্যানাবাস কোবোজিয়াসকে (Rastrelliger kanagurta and Anabas cobojius) "ডেটা ডেফিসিয়েন্ট" হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই মূল্যায়নে কোনো প্রজাতিই "বিপন্ন" বলা হয়নি। গবেষক তাঁর প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। যাতে সুবর্ণরেখাকে বাঁচানোর জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই এই নদীটি কিন্তু শুধুমাত্র একটি রাজ্য বা একটি এলাকা নয়, তিনটি রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঝাড়খণ্ড থেকে আসার পর তালসারির কাছে বঙ্গোপসাগরে পড়ার আগে বাংলা ও ওড়িশার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। যে পথ দিয়ে এই নদী গিয়েছে, তার দুই অববাহিকা কিন্তু শস্যশ্যামলা হয়েছে এই নদীর জন্যই।


