‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হক: একটি শতাব্দী, একটি ইতিহাস

‘শেরে বাংলা’ ফজলুল হক: একটি শতাব্দী, একটি ইতিহাস
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
মৃত্যুর কিছুদিন আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নিজের জীবনী লিখতে শুরু করলেও মাত্র দু প্যারা লিখেছিলেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন:
"আমার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ ও সীমাবদ্ধ জীবনে সুযোগ যতটা আসা উচিত ছিল - এসেছে তার চাইতেও অনেক বেশি। কিন্তু আমি তার এতটাই গ্রহণ করতে পারিনি এবং সেজন্য সব দোষই আমার নিজের। আমি কখনোই নিজের পরিপূর্ণ ভাগ্য নিয়ন্তা হতে পারিনি। প্রায় সকল কাজেই আমি সময়ের চরম ভাবাবেগে পরিচালিত হয়েছি। সুযোগ যখন আসার জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে, আমি সংকুচিত হাতে তার দান গ্রহণ করেছি। আর সে যখন আমার প্রতি বিমুখ হয়ে বয়ে এনেছিল দুঃসহ বার্তা আমি তা কোন নালিশ না জানিয়েই হ্রূষ্টচিত্তে চিত্তে তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করিনি ।"
কিন্তু বাঙালি জাতির জন্য তিনি রাজনীতি, সমাজসেবায় অনেক করেছিলেন। তার মহতী কর্ম ও অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। পেয়েছেন খেতাব 'শেরে বাংলা'। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে শেরে বাংলা ফজলুল হক বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন
“আই অ্যাম দি লিভিং হিস্ট্রি অব বেঙ্গল ফর দি লাস্ট এইটি ইয়ার্স', 'এটি তার কল্পিত উক্তি নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা লব্ধ মূল্যবান বাণী।
তিনি ছিলেন এদেশের কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মুক্তিদাতা। শিক্ষার আলো জ্বেলে এবং প্রজাস্বত্ত্ব আইন পাশ করে সাধারণ মানুষের মুখে তিনি হাসি ফুটিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের দরদী বন্ধু। এ দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বাংলার মুসলমান সমাজ যখন অশিক্ষা, দারিদ্র্য আর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত, তখন এই অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধার করেন শেরে বাংলা ফজলুল হক।
ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ও পথিকৃৎ হিসেবে। কিন্তু কেন- এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র এর মূল্যায়ন থেকে।
একে ফজলুল হক সম্পর্কে স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছেন, ‘বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর। আমি কংগ্রেসিদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না। আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা। এই জাতীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফজলুল হক। ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানিত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতীয়তা। ফজলুল হক ওই সমন্বয়ের প্রতীক।’
স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র জানতেন শিক্ষার মাধ্যমে অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করা একমাত্র এ কে ফজলুল হকের পক্ষেই সম্ভব। তার এই প্রচেষ্টার ফলেই বাংলায় একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছিল। মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতাবোধ, বঞ্চনাবোধ ও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের অভাববোধকে দূর করে খাঁটি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারায় উচ্চ বর্ণের হিন্দু প্রাধান্য ছিল ক্রিয়াশীল এবং মুসলমানেরা ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার।
বিশ শতকের গোড়ায় মুসলমানেরা কৃষক সমাজ থেকে উঠে আসে। একে ফজলুল হক এদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার বাঙালি প্রীতি জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ভৌগলিক ও ভাষাগত চেতনাকে শক্তিশালী করে। তিনি সারা ভারতের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করলেও তার দৃষ্টি ছিল বাংলার দিকে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- ‘আমি সর্বপ্রথম বাঙালি, তারপর আমার অন্য পরিচয়।’ তিনি মুসলমানের উন্নতির জন্য চেষ্টা করলেও তিনি কোনোদিন সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে তিনি বলতেন, আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করি না। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকলেই আমার কাছে সমান। জীবনের সকল কাজে আমি এই আদর্শে পরিচালিত হয়েছি যে, ‘সর্বাগ্রে আমি বাঙালি, তারপর আমি মুসলমান। সাম্প্রদায়িকতাই বর্তমান ভারতীয় সমাজের গোলযোগের কারণ। সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে জাতীয়তার পথ ধরলে মানবসমাজের কল্যাণ ও মুক্তি আসবে।’
বাঙালি জাতির আদর্শ, তাদের বৈশিষ্ট্য ও চিন্তাধারা, আশা- আকাঙ্ক্ষা ও জীবনধারা বাস্তব রূপ নিয়েছিল ফজলুল হকের মাঝে।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এ কে ফজলুল হক বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ এমন একটা কিছু যা সাম্প্রদায়িকতার অনেক ঊর্ধ্বে। জাতীয়তাবাদ হচ্ছে অন্য যে কোনো চিন্তাধারার চাইতে বেশি মূল্যবান। কাজেই জাতি হচ্ছে একটি প্রশ্ন বা ইউনিটের সমন্বয়ে গঠিত বিরাট শক্তি। এই শক্তির বিভিন্ন অংশ মিলে একটি বিশেষ ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে ছোট-বড়, শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একত্রে বসবাসে স্বীকৃত। তারা একে অপরের সুখ-দুঃখ সহায়-সম্পদ সমঅংশীদার হবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে মানবতার সাধারণ স্বার্থে।’ ফজলুল হক বিশ্বাস করতেন, জাতীয়তাবাদ উন্মেষের জন্য বাঙালিদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন। অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ জমিদার হিন্দু। তাই মুসলিমগণ সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছে। বাংলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ফজলুল হক রাজনীতিতে যে কয়েকটি ধারা প্রবর্তন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখ করতে হলে প্রথমেই বলতে হয় যে, বাংলার রাজনীতিকে জনগণের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেটা তার আগে কেউ করেননি। তিনি প্রথমবারের মতো কৃষক সমাজকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসেন। তিনি বাংলার রাজনীতিকে নবাবদের বৈঠকখানা থেকে বাংলার গ্রামেগঞ্জে নিয়ে আসেন।
এ কে ফজলুল হক বাঙালিদের কেবল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করেই তার সংগ্রাম শেষ করেননি। তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করে বারংবার বললেন, ‘বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমার যে স্বপ্ন, তা হলো একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা, যেখানে বাঙালিরা হবে সর্বকর্তৃত্বের অধিকারী, যেখানে বৈদেশিক আইনানুসারে নিয়োজিত মন্ত্রীদের দ্বারা দেশ শাসিত হবে না, বরং সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হবে, যারা জনসাধারণ ও জনমতের কাছে বাধিত থাকবেন, যারা জনগণের প্রভু হিসেবে নয়, বরং সেবক হিসেবে পরিচিত হবেন। আমার বিশ্বাস, ন্যায় ও গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে গঠিত একমাত্র সমবায়তান্ত্রিক রাষ্ট্রই এ দেশের সাম্প্রদায়িক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করবে এবং সেদিন খুব দূরে নয়।’
স্বাধীন বাংলা গড়ার পেছনে রয়েছে এ কে ফজলুল হকের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ও পথিকৃৎ। তিনি স্বাধীন বাংলার স্বাপ্নিক। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তার উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের পথ ধরে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বিজয় এনে দেয়। প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব আদর্শ থাকে, পথ চলার ভিন্ন পন্থা থাকে। একে ফজলুল হকের রাজনীতিতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না একে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের সংগ্রাম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে ১৯৭১ সালে। এ কে ফজলুল হক বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেননি। সে দায়িত্ব অর্পিত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর। বস্তুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হকের মহান উত্তরসূরি ও তার যোগ্য মানসপুত্র। এ কে ফজলুল হক যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশের প্রবাহমান রাজনৈতিক ঘটনা থেকে ফজলুল হক উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া মুসলমান তথা বঞ্চিত মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকারবোধ ও স্বাধীনচেতনা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
শিক্ষা বিস্তারে ফজলুল হকের ভূমিকা সত্যই তুলনাহীন। বরিশালে তিনি একটি কলেজ স্থাপন করেন এবং তিনি সেই কলেজের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে ফজলুল হক কলকাতায় কেন্দ্রীয় মুসলিম শিক্ষা সমিতি (Central Muslim Educational Association) গঠন করেন। এই শিক্ষা সমিতির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের শিক্ষাকে স্তরে স্তরে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালে কলকাতায় 'বেকার হোস্টেল' ও 'কারমাইকেল হোস্টেল' প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই একক প্রচেষ্টায় উক্ত দু'টি ছাত্রাবাস থেকে লেখা-পড়া শিখেছেন এপার ও ওপার বাংলার বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। এ ছাড়া তারই প্রচেষ্টায় ইলিয়ট হোস্টেল, টেইলর হোস্টেল, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মুসলিম হোস্টেল এবং মুসলিম ইনস্টিটিউটের বিরাট ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯২৪ সালের ১লা জানুয়ারি এ কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এই মন্ত্রীত্বের কাল ছয়মাস হলেও উক্ত সময়ের মধ্যে তিনি কলকাতায় একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজই পরে ইসলামিয়া কলেজ নামে অভিহিত হয়। বর্তমানে এই কলেজটির নাম মৌলানা আজাদ কলেজ। ইতিপূর্বে মুসলমানদের শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হতো না। ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার পর সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমান শিক্ষকদের এনে এই কলেজে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন। এই সময় তিনি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আলাদা ডাইরেক্টরেট স্থাপন করেন এবং একটি স্বতন্ত্র মুসলিম তহবিল গঠন করেন। তখন স্কুলসমূহে সংখ্যালঘু হিন্দুদেরই একাধিপত্য ছিল। মুসলমান ছাত্রদের স্কুলে ভর্তীর ব্যাপারটাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। তা ছাড়া মুসলমান ছাত্রদের সংস্কৃত পড়তে হতো। কারণ, সরকারী স্কুল ছাড়া অন্য কোন স্কুলে আরবি, ফার্সী পড়ানো হতো না। তিনি উপলব্ধি করলেন মফস্বল স্কুলে আরবি ও ফার্সী পড়ানোর ব্যবস্থা না করলে মুসলমানদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে না। তাই তিনি আদেশ জারী করলেন কোন স্কুল সরকারী সাহায্য পেতে চাইলে একজন মুসলমান শিক্ষক ও একজন মৌলভী রাখতে হবে। তাই শিক্ষা দরদী ফজলুল হক মুসলমান ছাত্রদের জন্য সকল স্কুল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজে রিজার্ভ সিটের ব্যবস্থা করলেন। এমন ব্যবস্থা করলেন যে মুসলমান ছাত্র পাওয়া না গেলেও রিজার্ভ সিট শূন্য থাকবে। এই ব্যবস্থার ফলে মুসলমানের শিক্ষা বিশেষভাবে অগ্রসর হতে পেরেছিল। তাই বলে তিনি হিন্দু বিদ্বেষ পরায়ন ছিলেন না।
মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে আর একটি বাঁধা ছিল, পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার নিয়ম। যার ফলে হিন্দু শিক্ষকগণ মুসলমান নাম দেখলেই পরীক্ষার খাতায় ভাল লিখলেও অকৃতকার্য করিয়ে দিত। এতে মুসলমানদের পরীক্ষা পাসের হার ছিল অতি নগন্য, যার ফলে উপযুক্ত স্থান দখল করা তাদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের সমান বিচারের জন্য ফজলুল হক প্রবল প্রতিকূলতা ও বিরুদ্ধতা ব্যর্থ করে পরীক্ষার খাতায় নাম লেখার পরিবর্তে ক্রমিক নম্বর লিখার নিয়ম প্রবর্তন করেন। ফলে মুসলমান ছাত্রদের পাসের হার বাড়তে লাগলো।
ছয় মাস শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মহামান্য আগা খান ও নবাব মোহসীন-উল-মুলক প্রমুখ 'আলীগড় এ্যাঙ্গলো ওরিয়েন্টাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে একজন নেতৃস্থানীয় উদ্যোক্তা ছিলেন। উল্লেখ্য যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৭ সালে মুসলমানদের উন্নতমানের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রথমে আলীগড় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ফজলুল হক নব প্রতিষ্ঠিত আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্টের ( সিনেটের) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের মত দেশরক্ষা বিভাগ নেওয়ার পরিবর্তে নিলেন শিক্ষা বিভাগ। এ দেশের সাধারণ মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য তিনি এ কাজ হাতে নিলেন। তিনি ছিলেন গণশিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান যাতে সমান অধিকার পায়, তার সঠিক নিয়ম প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে বঞ্চিত মুসলমানগণ যাতে শিক্ষার আলো দেখতে পায়, তার সুব্যবস্থা করা।
ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কলকাতায় লেডী ব্রাবোর্ণ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম শামসুন্নাহার মাহামুদকেও এই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধানরূপে তিনিই নিযুক্ত করেন। যদিও বেগম শামসুন্নাহার তখনও এম, এ ডিগ্রি প্রাপ্তা নন। কলকাতার বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলটি প্রাদেশিক সরকারের পরিচালনাধীনে আনয়ণ করে তিনি স্কুলটির অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলার প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছর তারই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ। এই সময় তার নিজ গ্রাম চাখারে তিনি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি সেখানে একটি মাদ্রাসা ও একটি হাইস্কুল তারই সৃষ্টি। রাজশাহীর আদিনা ফজলুল হক কলেজ, শর্ষিনা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য শেরে বাংলার দান অপরিসীম। তপশিলী সম্প্রদায়ের শিক্ষার জন্য তিনিই প্রথম বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন।
একে ফজলুল হক একজন অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংকট মিমাংসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা ভারতের শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যে প্রজ্ঞা প্রদীপ্ত সুপারিশ করেছিলেন তার মধ্যে বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ফজলুল হকের অসাধারণ নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে স্বাধীকারের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
শেরে বাংলা ফজলুল হকের কর্মজীবনে দুইজন কীর্তিমান পুরুষের প্রভাব ছিল অপরিসীম। একজন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, অপরজন আশুতোষ মুখার্জি। যার অধীনে তিনি কলকাতায় আইনের হাতে খড়ি লাভ করেন। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি নিজেও শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন, সেটা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বারবার উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মাজারে গিয়ে ফাতেহা শরীফ পাঠ করেছেন, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন। যেখানে তিনি শেরেবাংলা একে ফজলুল হক কে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবাদ পুরুষ বলে উল্লেখ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকীতে যথার্থই বলেছেন "শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।"
বহুমুখী এবং বিরল প্রতিভার অধিকারী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালের চাখারে জন্মগ্রহণ করেন। মহান এই সিংহ পুরুষের জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক বাংলাদেশের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপ-উপাচার্য।


