শরিয়তি আইন, তালিবান ও আফগান মহিলা

শরিয়তি আইন, তালিবান ও আফগান মহিলা
21 Sep 2021, 08:45 PM

শরিয়তি আইন, তালিবান ও আফগান মহিলা

 

রোশেনারা খান

 

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ পয়গম্বর হয়ে ওঠার পূর্বে আরবে মেয়েদের অবস্থা ছিল বাড়িতে পোষা উট ভেড়ার মতোই। পুরুষের খিদমৎ করা, তাদের সমস্ত রকম চাহিদা মেটানোর পরেও বার বার তাকে ত্যাগ করা হত। আবার ইচ্ছে গেলে গ্রহণ করাও হত। মেয়ে জন্মালে পুরুষ(বাবা) তাকে সবসময় গ্রহণ করত না। বালির গর্তে  জ্যান্ত কবর দিয়ে মেরে ফেলা হত। আরবে সেইসময় যে সমস্ত জনগোষ্ঠী বাস করত তাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় সব দিক দিয়ে নারী  দুর্বল হওয়াতে কোন বিষয়েই তাদের ইচ্ছে বা মত প্রকাশের অধিকার ছিল না। প্রায় সব গোষ্ঠীতেই মেয়েদের নিজের বলে কিছু থাকত না। না থাকত সম্পত্তির অধিকার,না সন্তানের অধিকার। বাহুবলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। এছাড়াও ধর্ম প্রচারক, নারী ও শিশুর রক্ষক, এবং ভরণপোষণকারী হিসেবে পুরুষকে নারীর ওপরে স্থান দেওয়া হয়ে ছিল।

 

কোরান (ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ) ও হাদিসের (হজরত  মহম্মদের বিধান) ওপর ভিত্তি করে শরিয়তি আইন নির্মিত হয়েছিল। আইনের বেশিরভাগটাই হাদিস নির্ভর। মহম্মদের বিধান বা বাণীগুলি মানুষ শুনে মনে রেখেছিলেন। বহু বছর ধরে বিভিন্ন জায়গার,বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করা হয়েছিল। হজরত মহম্মদের মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে, তারপরে হাদিস সংগ্রহ করা শুরু হয় এবং চলতে থাকে ৯১৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। বিভিন্ন পণ্ডিতেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হাদিসের ব্যখ্যা করেন। ফলে হাদিসের সচ্ছতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন থেকে গেছে। এছাড়াও একাধিক পণ্ডিত আইন রচনা করার ফলে শরিয়তি আইনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। সুন্নিরা মূলত ইমাম আবু হানিফা নির্মিত আইন মেনে চলেন। আর একটি আইনি প্রতিষ্ঠানের নাম মালিকি।

এই দুটি ছাড়াও আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে।  শরিয়তি  আইনে সেইসময় নারীর  শিক্ষালাভ  স্বনির্ভরতা, বিবাহে মতপ্রকাশ, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছিলনা। পরে সম্পত্তির অধিকারও পেয়েছিল।মেয়েরা বোরখা নামক যে পোশাকটি পরেন,লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আরবের মত দেশে উষ্ণতা থেকে বাঁচতে নারী ও পুরুষ উভয়েই আপাদমস্তক এই রকম কালো পোশাকে শরীর ঢেকে রাখেন। মানুষ তার খাদ্য, পোশাক নির্ধারণ করেন সেই দেশের জলবায়ু প্রকৃতি ইত্যাদির ওপর অনুযায়ী। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষ শালীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সেখানে বিশ্বের সমস্ত দেশের শুধু মহিলাদেরই কেন কালো বোরখায় শরীর ঢেকে রাখতে হবে?

 

যাইহোক, এ তো গেল নারীর কথা। এখন সমস্যা হল নারীকে কিছু স্বাধীনতা বা অধিকার দেওয়া হলেও পুরুষের আইনি অধিকার এতটাই বেশি যে নারীর অধিকারগুলি সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেছে। পুরুষ পেয়েছিল একাধিক বিবাহের (একসঙ্গে চারজন স্ত্রী) অধিকার, তালাকের অধিকার, সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে পৈতৃক সম্পত্তি ছেলেরা যা পায়,মেয়েরা তার অর্ধেক পায়, তালাকের পর মা একা লালনপালন করে থাকলেও সন্তানের অভিভাবকত্ব পায় বাবা। বাবার অবর্তমানে সেই পরিবারের অন্য কোনও পুরুষ। এছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের শোষণ-পীড়নের শিকার হতে হত এবং এখনো হয়।  বাবার জীবিতাবস্থায় ছেলে মারা গেলে সেই  ছেলের স্ত্রী ও সন্তানেরা সম্পত্তির  অংশ আইনত পাবে না। অন্যের সন্তান দত্তক নেওয়া যাবে না। স্ত্রী বিয়ের পর গর্ভধারণ না করতে পারলে তাকে ‘বন্ধ্যা’ আখ্যা দিয়ে সেই পুরুষ আবার বিবাহ করে। এদের বক্তব্য পুরুষ কখনো সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে পারেনা। মেয়েরা সবসময় পর্দার মধ্যে থাকবে। স্বামীর দায়িত্ব স্ত্রীর ভরণপোষণ করা, তাই স্ত্রীর বাইরে বেরিয়ে উপার্জন করার প্রয়োজন নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে পুরুষের পিতৃ পরিচয় যেহেতু স্ত্রীর সততার অপর নির্ভর করে, মায়ের মত পুরুষ বিশ্বাসের সঙ্গে কোনদিনই সন্তানের পিতৃত্ব দাবি করতে পারেনা, তাই  হীনমন্যতায় ভোগে, আর সেই জায়গা থেকেই নারীকে সব দিক দিয়ে দমিয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা। 
 

আর এই পুরুষ প্রণীত শরিয়তি বা ধর্মীয় আইনের কারণে মুসলিম মহিলারা যুগ যুগ ধরে শোষণ পীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছে। তারা প্রগতিশীল দেশের ভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলাদের থেকে পিছিয়ে থাকছে। অথচ তাঁদের মধ্যে মেধা বা প্রতিভার অভাব নেই। অভাব শুধু সুযোগের। যারা সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তাহমিনা মিলানি একজন সফল সিনেমা পরিচালক। জন্ম ইরানে। তাঁর ‘দ্যা  ওয়ান্টেড উইমেন ছবিটি এশিয়া  পেসিফিক ফিল্ম উৎসবে, লস এঞ্জেলসে ও জেনিভায় পুরস্কৃত হয়েছিল। তাঁর আরও অন্যান্য সিনেমা বিভিন্ন জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছে। আবার  ‘হিডন হাফ’ সিনেমাটির জন্য তাঁকে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল। জাহা হাদিদের জন্ম ইরাকের বাগদাদ শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করে নিজেকে শুধু সফল ও অনুকরণ যোগ্য স্থপতি হিসেবেই নয়, তিনি স্থাপত্যের রীতি-নিয়ম-স্থাপত্যের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছিলেন। তাঁকে মেয়ে বলে,এবং মুসলিম মেয়ে বলে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি তাঁর অভিনব নির্মাণ কৌশলের জন্য বা শুধু প্রথম মেয়ে স্থপতি  হিসেবেই নয়, প্রথম মুসলিম হিসেবেও নোবেলের সমতুল্য প্রিতজারকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।  তাঁকে  স্থ্যাপত্যের রাণী বলা হত।

 

জাহা ৪৪টি দেশে ৯৫০টি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছেন।  ফারহানাজ নাজিরের জন্ম  আফগানিস্থানে।ওর পরিবার ইউরোপ চলে গিয়েছিল।সেখানে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ফারহানাজ নিজের দেশে ফিরে আসেন এবং প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নিজের গ্রামে  গিয়ে মেয়েদের শিক্ষালাভের মাধ্যমে সচেতন করার কাজ শুরু  করেছিলেন।  তালিবানদের শাসনে থেকেও তিনি বলেছিলেন, আমি বোরখা পরলে কানে শুনতে পাইনা, চোখে দেখতে পাইনা। ১৯৯৬ এ তালিবানরা আবগানিস্থান দখল নেওয়ার পর,প্রথম কাজই ছিল ওদের মহিলাদের একেবারে গৃহবন্দি করে ফেলা। এবারেও অ-তালিবানরা মুখে বলছে মহিলাদের সব রকম সুযোগ দেবার কথা,কিন্তু কাজে আগের মতই মেয়েদের খোলা পায়ে গুলি করেছে। বাইরে বেরিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার অপরাধে তাদের খুন করছে। বাড়ির ভিতরেও তাদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে, পাছে তালিবানদের চোখে পড়ে যায়।  আমেরিকা আবগানিস্থানকে তালিবানদের থেকে দখলমুক্ত করার পর আবগান মহিলারা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলেন।  পোশাকে কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। শিক্ষা, স্বনির্ভরতা, রাজনীতি, খেলাধুলা, গানবাজনা সবখানেই ছিল অবারিত দ্বার।
   

 

 কিন্তু হঠাৎ করে সব কেমন বদলে গেল। দোহাতে তালিবানদের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সান্তি বৈঠক।আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের সৈন প্রত্যাহার করে নেওয়া, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন তালিবানদের আবগানিস্থান দখল শুরু।শুরু মহিলাদের বাক্সবন্দি করার প্রক্রিয়া। সেইসঙ্গে নানান ফতোয়া জারি।পুরুষদের দাড়ি-টুপি থাকতে হবে। মেয়েদের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত যাওয়া চলবেনা, সর্বাঙ্গ ঢেকে বাইরে বেরতে হবে,সঙ্গে স্বামী বা রক্তের সম্পর্কের কোনও পুরুষ থাকতে হবে। তালিবানরা মুখে বলছে তারা শরিয়তি আইন মেনে মেয়েদের কাজ করতে দেবে,কেবিনেটে মহিলাদেরও নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। পথে-প্রান্তরে চলছে নারী পুরুষ শিশুহত্যা, আগেই বাড়ি বাড়ি ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কিশোরী ও বিধবাদের তালিকা চে্যেছিল। এখন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও খুন করছে। এমন কী এই নরখাদকদের হাত থেকে মৃত মহিলারাও রেহাই পাচ্ছেনা।রেহাই পাচ্ছেনা শিশুকন্যারা। ঘরে খাবার নেই, মানুষ খাবারের সন্ধানে বাইরে বেরিয়ে আর ফিরছেনা। মানুষ বাঁচার জন্য দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।  বিমানবন্দর হয়ে উঠেছে রণক্ষেত্র।এ কোন ধর্মীয় আইন? দুঃখের বিষয় অনেকে এই সংবাদ সত্য বলে মানতে চাইছেন না। আসলে সবই তো হয় রাজার ইচ্ছাতে। শোনা যায় ইমাম আবু হানিফ শরিয়তের ব্যখ্যা করেছিলেন আব্বাসীয় শাসনকর্তাদের নির্দেশ মত। বর্তমানে সংবাদ পরিবেশনেও পার্থক্য দেখা যাচ্ছে এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের।কিন্তু সত্যিটা তো ছবিতে দেখা যাচ্ছে। তালিবানরা যদি এতই দয়ালু, তবে মানুষ কেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে? এর উত্তর হয়ত সময়ের কাছে রয়েছে।


   

 আশার কথা আফগানিস্তানের মহিলারা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে ওঁরা যে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চয় করেছে, এরজন্য কোনও প্রশংসা যথেষ্ট নয়। মহিলারাই পারবে অর্ধেক আকাশকে অন্ধকার মুক্ত করতে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।

Mailing List