বিজ্ঞানসম্মত মাছ চাষ পদ্ধতিই পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের শীর্ষে

বিজ্ঞানসম্মত মাছ চাষ পদ্ধতিই পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের শীর্ষে
ডঃ অমিত কুমার দে ও অভিষেক গিরি
অভিষেক গিরি ( লেকচারার, অ্যাকোয়াকালচার বিভাগ, প্রভাত কুমার কলেজ, কাঁথি এবং প্রশিক্ষক ও পরীক্ষক, গ্রামীন স্বরোজগার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, RSETI’’s)
ডঃ অমিত কুমার দে (প্রিন্সিপাল, প্রভাত কুমার কলেজ, কাঁথি)
চাষ করে লাভবান হতে গেলে আপনাকে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে, যেমন পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত। উন্নত উপায়ে মাছ চাষ করলে চাষীদের আর্থিক লাভও ভালো হয়ে থাকে| মাছ চাষ শুরু করার আগে দরকার সঠিক পরিকল্পনার। যেমন, কোন জাতের মাছ চাষ করবেন, কতদিন মেয়াদে মাছ চাষকরবেন, মোট কত টাকা ব্যয় হতে পারে ইত্যাদি| এই নিবন্ধে মাছ চাষ (Fish cultivation) সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করা হলো;
পুকুর নির্বাচন(Pond selection):
১. পুকুরটি খোলামেলা যায়গায় হতে হবে।
২. সারাদিনে যাতে ৮ ঘণ্টা রোদ লাগে তা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং পুকুরটি বাড়ির আসে পাশে হলে ভালো হয়, এর ফলে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়।
৩. পুকুরের গভীরতা ৫ থেকে ৬ ফুট রাখতে হবে।
৪. পুকুরের পাশে কোন বড় গাছ রাখা যাবে না, বিশেষ করে পাতা ঝরা গাছ।
পুকুর খননঃ
যখন চাষ শুরু করবেন তার আগে অবশ্যই সঠিক নিয়মে পুকুর প্রস্তুত করে নেবেন। প্রথমেই বিজ্ঞান ও পরিবেশ সম্মত ভাবে পুকুর তৈরি করা হলে মাছ চাষের প্রস্তুতির এক তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়ে যাবে সেগুলো হলো-
১) ভালোভাবে পুকুর শুকিয়ে নেওয়া
২) জলজ আগাছার নিধন।
৩) রাক্ষুসে মাছ নিধন করা
৪) নিরাপদ জল সরবরাহ করা
৫) পুকুরে চুন/জিওলাইট প্রয়োগ করা ( প্রতি ডেসিম্যালে ১ কেজি)
৬) জলে প্রকৃতিক খাবার জম্মানোর ব্যবস্থা নেওয়া
৭) পুকুরে জলের জোগান ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা
এসব ক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে পরবর্তীতে নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হতে হয়।
সতর্কতাঃ
রোগ প্রতিরোধী মাছের চাষ করতে হবে, পুকুরে যাতে রোদ লাগে সেটা দেখতে হবে। চারা ছাড়ার আগে তার পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে ছাড়তে হবে এবং মজুত ঘনত্ব ঠিক রাখতে হবে। ৩ থেকে ৪ বছর পরপর পুকুর শুকিয়ে আবার নতুন করে তৈরী করতে হবে। মাসে অন্তত একবার হলেও জাল টানতে হবে, এতে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যাবে। পুকুরের তলদেশের জমা হওয়া গ্যাস বের করে দিতে হবে।
পোনা পরিবহন:
মানসম্পন্ন পোনা সংগ্রহ ও সঠিক নিয়মে পরিবহন করার পর যথাযথভাবে পুকুরে পোনা ছাড়তে হবে। কেননা অনেক সময়ই পরিবহন জনিত ত্রুটির কারণে ও পরিবহনের আগে অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ হ্যাচারি টেকনিশিয়ানরা সঠিক নিয়মে টেকসই করে না বলে পোনা ব্যপক হারে মারা যায়। তাৎক্ষনিক ভাবে অনেক সময় মারা নাগেলেও পোনা এতই দুর্বল থাকে যে দু-এক দিনের মধ্যে অনেক পোনা মারা যায়। এবিষয়টি অনেক সময় চাষী বুঝতে পারেনা আর সেজন্য অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। আর এ কারনেই পোনা পরিবহন ও পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এ ব্যাপারে একজন অভিজ্ঞ মৎস্য চাষী/কর্মকর্তার পরামর্শ নিতে হবে। তাছাড়া অভিজ্ঞ মাছ চাষীদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
খাদ্য(Food):
সঠিকভাবে খাবার প্রদান করা লাভজনক মাছ চাষের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত। খাদ্য সরবরাহে ৭০% এর বেশি খরচ হয়ে থাকে মাছ চাষে। অভিজ্ঞ মাছ চাষীরা নিজেরা খাবার তৈরি করে মাছকে দিয়ে থাকেন অন্য দিকে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির খাবার পাওয়া যায়। মাছকে খাবার যে উৎস থেকে সরবরাহ করেন না কেন তা অবশ্যই গুনগত মানসম্পন্ন হতে হবে। খাবার সঠিক পুষ্টিমান সম্পন্ন এবং মাছের বয়স ও আকার অনুযায়ী সরবরাহ করতে হবে তা নাহলে একজন মৎস চাষী ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন।
মাছ যাতে তার প্রাকৃতিক খাবার পায় তার খেয়াল রাখতে হবে। এর জন্য পরিমান মত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও মাছের খাবারের জন্য আমরা শুকনো মাছের গুঁড়ো, রাইস ব্রান, হুইট ব্রান, সয়াবিনের গুঁড়ো, সরিষা খৈল, ভুট্টা, আটা বা ময়দা, চিটা গুড়, ভিটামিন মিনারেল এই সমস্ত উপকরন গুলোকে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে খাবার বানিয়ে মাছকে খাওয়াতে পারি।
মিশ্রচাষ পদ্ধতি(Mixed farming process):
মিশ্রচাষ বলতে একই সাথে অনেক জাতের মাছ চাষ করাকে বুঝানো হয়ে থাকে। মিশ্রচাষের ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। পুকুরে জলের স্তরকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে । সব স্তরে একই রকমের মাছ থাকে না। আর এ কারনেই মিশ্রচাষে প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে উপরের স্তর, মধ্যস্তর ও নিম্নস্তরের বিষয়টি বিবেচনা করেই প্রতেকটি স্তর সঠিক ভাবে ব্যবহারের জন্য মাছের প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় চাষীরা কোন একটি স্তরের মাছ অধিক ছাড়ে অথচ অন্য স্তরের উপযোগী মাছ ছাড়েন না, যার ফলে চাষী ভাল ফলাফল পান না । তাই প্রতিটি স্তরের ব্যবহার করার জন্য আনুপাতিক হারে মাছ ছাড়তে হবে।
যেমন নিচের স্তরের বিশেষ করে মৃগেল, মিররকার্প, কার্পিও এই ধরনের মাছ। পোনা ছাড়ার সময় পুকুরে আনুপাতিক হারেই পোনা ছাড়তে হবে। একই সাথে মৃগেল ও গলদা চিংড়ি ছাড়া যাবেনা মৃগেল ও গলদা চিংড়ি ছাড়া হলে গলদা চিংড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আবার মিশ্রচাষে রাক্ষুসে সভাবের মাছ ছাড়া যাবেনা, রাক্ষুসে মাছ ছাড়া হলে অন্য মাছ খেয়ে সাবাড় করে ফেলবে। তাই রাক্ষুসে মাছ না ছাড়াই ভালো।
মাছের সংরক্ষণঃ
মাছের আহরনের সময় মাছকে বেশী নাড়াচাড়া করা যাবে না। মাছের সাইজ হিসেবে আলাদা করতে হবে এবং বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে।
****************


