বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার - কত কুসংস্কার এখনও বেঁচে, যার জন্য প্রাণও দিতে হয়!

বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার - কত কুসংস্কার এখনও বেঁচে, যার জন্য প্রাণও দিতে হয়!
ড. বাবুলাল শাসমল
"বিজ্ঞান" হল "বিশেষ জ্ঞান" - শুধু ব্যুৎপত্তিগত অর্থে নয়, তার কর্মই তার বিশেষত্বের পরিচায়ক। বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তার মধ্যে "বিশেষ" কথাটা প্রায় অলংকারী হয়ে উঠেছে এবং জ্ঞানের বিশাল সাম্রাজ্য প্রায় পুরোটাই "বিজ্ঞান" নামে অভিহিত হতে চলেছে। তাই জ্ঞানের বিশেষণরূপে পরিচিত হওয়া অপেক্ষা বিজ্ঞান এখন পদ্ধতিরূপে বেশি পরিচিত। সভ্যতার গোড়ার দিকে বিজ্ঞানের আদি চেহারাটা আলাদা করে স্পষ্ট ছিল না – "মন্ত্র তন্ত্র" তুক-তাক, ম্যাজিক, ঝাড়ফুকের মিশ্রিত বিশ্বাসের পাল্লাভারী এক মানসিক ও কর্মপ্রচেষ্টার অংশ ছিল তা, দীর্ঘকালের যুক্তিবাদী পরিশ্রম অনুসন্ধানের পরে বিজ্ঞান নিজেকে ম্যাজিক থেকে আলাদা করে নিজস্ব পরিচয়ে তুলে ধরেছে – "অ্যালকেমি" থেকে "কেমিস্ট্রি" নামের বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ।
বিজ্ঞানের পদ্ধতি কী? কাকে আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলি, আর কাকেই বা বলি অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যুক্তিনিষ্ট অর্জিত জ্ঞানকে আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে "বিজ্ঞান" বলতে অসুবিধা নেই। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা পরিস্কার নয়, এমনকি অনেক বিজ্ঞানীরা অজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, শুধুমাত্র প্রশিক্ষণের সহায়তায়।
"বিজ্ঞান" যেমন যুগে যুগে তার রূপ পাল্টিয়েছে তেমনি মানব সভ্যতার প্রয়োজনের তাগিদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিবর্তন হয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সর্বদা উদ্দেশ্যমুখীন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ সবদিক দেখে-শুনে বুঝে সত্যটা সঠিক বিচার বিবেচনা করে বস্তুনিষ্ট চিন্তা করে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সূত্রবদ্ধ করাও সঠিক ব্যবহারের মধ্যে বাস্তবায়িত করা হয়। প্রথমে- জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা, তারপর রসায়ণ ও জীবনবিজ্ঞান, বর্তমানে সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলি এই পদ্ধতিতে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। লক্ষ্য করা গেছে, যে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য যত কম আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে ভ্রান্তির অবকাশ তত বেশি। সমাজ বিজ্ঞানে বহু ভ্রান্তি আছে। তার কারণ একটাই এটি প্রকৃতি বিজ্ঞান নয়। সমাজ বিজ্ঞানের সমস্ত উপাদানগুলি সমানভাবে বিশ্লেষিত নয়। মানবমনস্তত্ত্ব এখনও ধোঁয়াটে, ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য কীভাবে সমাজে স্থান করে নেয় - তাও বিশেষ জানা নেই। প্রকৃতি বিজ্ঞান যত সহজে "আবিষ্কৃত" হয়েছে তত সহজে জীবন বিজ্ঞান বা সমাজ বিজ্ঞান হয়নি। দেখা গেছে যেখানে প্রাণী তথা মানুষ সংযুক্ত সেখানে অনাবিষ্কৃতের সংখ্যা বেশি।
গ্যালিলিও যখন গীর্জার ঝোলানো বাতির দোলন দেখে দোলন-সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন সেটা ছিল বিশ্বের সমস্ত রকম দোলনের সূত্র – স্থান, কাল, পাত্রের বাধা সে সূত্র মানেনি। পপার অপ্রমাণত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেখিয়েছেন যে কিভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটে। পজিটিভিস্ট দার্শনিকদের সঙ্গে পপার এর এই খানে মিল যে পপার মনে করেন – বাস্তবতার কোনও বর্ণনা নির্দিষ্ট নয়, বিজ্ঞান যে পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে সে পর্যন্তই বাস্তবতা। বিজ্ঞানের ইতিহাস হল অপ্রমাণত্ত্বের ইতিহাস।
বিজ্ঞানের কাছে জগতের সত্য কখনই নির্দিষ্ট নয়, ধ্রুব নয়। বাস্তবতাবোধ নির্দিষ্ট নয়, জ্ঞানের পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে বাস্তবতার রূপরেখা পরিবর্তনশীল। বস্তুজগৎ মস্তিষ্কে অভিঘাত সৃষ্টি করে বস্তু সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলে, আর এই ধারণা ঠিক কেমন চেহারা নেবে তা নির্ভর করে দ্রষ্টার জ্ঞান বুদ্ধি, বিচার এর ক্ষমতার উপর।
দেকার্ত বলতেন, দ্রষ্টার মানসলোকে সত্যের প্রতিচ্ছবি প্রতিভাত হয়। তাঁরই বিখ্যাত উক্তি – ‘আমি চিন্তা করি । তাই আমি' – এভাবেই উৎপত্তি হয়। আধার বিনা যেমন তরল স্থিত হয় না, তেমনি মনন বিনা সত্য প্রকাশিত হয়না।
যতদিন যাচ্ছে বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞানতা, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা দূর হচ্ছে। তার জ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি পরিষ্কার হচ্ছে। অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞান রূপ পাচ্ছে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী জ্ঞানে। বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী জ্ঞানের উন্নয়ন হচ্ছে, প্রসার হচ্ছে, পরিশীলন ও পরিমার্জন হচ্ছে। জগৎ সংসার সম্পর্কে মানব জাতির দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। দশ হাজার বছর আগেকার মানুষের চিন্তাভাবনা আর আজকের মানুষের চিন্তা ভাবনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
কুসংস্কার প্রসঙ্গেঃ-
উত্তরসূরীর কাছ থেকে সব মানুষই জগৎ সংসার সম্পের্কে কিছু ধারণা নিয়ে থাকে। এটা আসে শিক্ষা থেকে, পরিবার পরিজন থেকে, বন্ধু-বান্ধব-কর্মস্থল বা এক কথায় বৃহৎ সমাজ থেকে এবং সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে, নীতি নৈতিকতা, ভালো মন্দ, সৎ-অসৎ ইত্যাদি বোধগুলি ও একটা বিশেষ কালের ফসল – সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ যেমন বদলায়, তেমনি বদলায় মূল্যবোধগুলিও।
একটু খেয়াল করলে সমাজে দেখা যাবে যে ওই ধারণা ও মূল্যবোধ গুলির একাংশ মানুষের সমাজে অনেকদিন ধরে রয়ে গেছে। যদিও যুক্তি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে তবু তা একেবারে লুপ্ত হয়নি। জ্যোতিষ, তন্ত্র-মন্ত্র, তিথি-বার মেনে খাদ্যগ্রহণ, কিছু কিছু শাস্ত্রীয় বিধান, কতগুলি লোকাচার ও মঙ্গল-অমঙ্গল ধারণা, ভূতে ধরা, ডাইনী ধরা, গণেশের দুধ খাওয়া, পিঁয়াজ ভূত, আলগালাগা এসবের মধ্যে পড়ে, এহেন অসার অভ্যাসকে আমরা সাধারণত ভাবে কুসংস্কার বলি।
কুসংস্কারের পাশাপাশি আর একটি শব্দ প্রচলিত আছে- তা হল সংস্কার, অনেকে বলেন – যে আচার মানুষের ক্ষতি করে তা কুসংস্কার, আর যা নেহাতই নির্দোষ তা হল সংস্কার। এটা একেবারেই আপেক্ষিক। কোন্ আচার কার কতটা ক্ষতি করবে, কার করবে না তা বোঝা শক্ত, এভাবে আচার-বিচারকে ভাগ করা সম্ভব নয়। তাই কুসংস্কার ও সংস্কার আলাদা কিছুই নয়, তারা চরিত্রে একই। প্রশ্ন হল – কুসংস্কার কোথা থেকে আসে, কেনই বা যুক্তিহীন অসার হলেও তা মানুষের মন থেকে সহজে চলে যায়না, মানুষ কেন অর্থহীন আচার-আচরণ করে। কুসংস্কারের অনেকটাই এসেছে সুদূর অতীত থেকে। বর্বর অবস্থায় মানুষের বিশ্বাসের পিছনে যুক্তি ছিল অল্পই । ছিল শুধু বেঁচে থাকার আকাঙ্খা। বেঁচে থাকার আকাঙ্খা বহিঃ প্রকাশ হত নানা ভাবে, নানা ভঙ্গিতে, নানা তন্ত্র মন্ত্র আচার-আচরণে।
বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি বিভিন্ন কুসংস্কার বহন করত বলে পরবর্ত্তীকালে সভ্য সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারে পার্থক্য দেখা যায়। কুসংস্কারের (যাকে ম্যাজিকও বলা যায়) মধ্যে বিজ্ঞান লুকিয়ে থাকে।
আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক কিছু ওই ম্যাজিকের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল এবং সেগুলিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে "আবিষ্কার" করা হয়েছে। এভাবে বিকশিত হয়েছে ‘অ্যালকেমি’ থেকে ‘রসায়ণ’ বা‘কেমিস্ট্রি’। ‘অ্যালকেমি’ থেকে ‘কেমিস্ট্রি’ যদি কুসংস্কার থেকে বিজ্ঞানের যাত্রা হয়, তবে বৈদিক যুগের জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে বেদোত্তর যুগের জ্যোতিষ হল বিজ্ঞান থেকে কুসংস্কারের দিকে যাত্রা।
কুসংস্কার বলতে আমরা সাধারণত জ্যোতিষ, রত্নধারণ, তন্ত্র-মন্ত্র, জড়িবুটি বুঝি। কিন্তু এসবের বাইরেও অনেক কুসংস্কার আছে যারা তত প্রাচীন নয়, বরং অর্বাচীন। বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস হল, এরকম একটি আধুনিক কুসংস্কার। বিজ্ঞাপন এখন আমাদের সব সেখায়। আমরা প্রতিনিয়ত যা যা ব্যবহার করি- জামা, কাপড়, টুথপেস্ট, সাবান, ছাতা, জুতো শুরু করে কোন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছেলে মেয়েদের পক্ষে ভালো, কোন প্রাইভেট হাসপাতাল ভারত শ্রেষ্ট, কোন কবি - সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ- শেক্সপীয়ারের সমতুল্য, কোন রাজনীতিবিদ কত ভালো – সবই আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্পী বর্নাঢ্য ঢঙে, বর্ণে কথায় আমাদের শেখাচ্ছে। আর আশ্চর্যের কথা যে আমরা অনেকেই তা বিশ্বাস করছি। বলা হয় বিজ্ঞাপন বর্তমান পৃথিবীকে চালাচ্ছে যা বর্তমানে সমাজের চালিকা শক্তি। আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন ছাড়া কিছু হয় না। অবাক লাগে যে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দিনের চব্বিশ ঘন্টা ধরে জ্যোতিষীদের যে উৎপাত প্রচারিত হয় তা শিশু থেকে সকল বয়সের মানুষের মনে খুবই প্রভাব বিস্তার করে সর্বাধিক কুসংস্কারের প্রচার। ইদানিং জ্যোতিষকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেছে। জ্যোতিষীরা রীতিমতো চেম্বার খুলে মক্কেলদের হাত দেখছেন । কোষ্ঠী বিচার করছেন। তারপর রোগ ধরে ধরে তাঁরা প্রেসক্রিপশন করছেন । কোন রোগের কোন পাথর, কত রতি ধারন করতে হবে ইত্যাদি। দূরদর্শনের কোন কোন চ্যানেলে একেবারে ডাক্তার বাবুদের মতো পেশাদারি গলায় তাঁরা পরামর্শ দিচ্ছেন। হয়তো ইউ.জি.সি'র জ্যোতিষ পাঠ নিয়ে যে উদ্যোগ তাতে তাঁরা উৎসাহিত হয়েছেন। এম.ডি,এম.আর.সিপি'র মতো তাঁরাও পেশাদার হচ্ছেন একথা বলা হচ্ছে, ঔষুধ যেমন কখনও কাজ করে, কখনও করে না, তেমনি রত্নকখনও কাজ করবে, কখনও করবেনা। চিকিৎসা যদি বিজ্ঞান হয় তবে জ্যোতিষনয় কেন?
সুতরাং "বিজ্ঞান" হল "বস্তুবাদ" আর কুসংস্কার হল "ভাববাদ" । এমন কি সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিবাহ, শ্রাদ্ধ, উপনয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের আচার আচরণের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু একটু চিন্তা করুন তো –
১ । বিয়ের আগে পাত্র- পাত্রীর— জাতপাত, ঠিকুজি কোষ্ঠী, পাঁজি, গ্রহ-নক্ষত্র, অগ্নি সাক্ষী বৈদিক মন্ত্র ও সাতপাকে ঘোরানো, এই সব করবেন,– না – রক্তের বিভাগও থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করাবেন ?
২। মৃত্যুর পরে - শ্রাদ্ধ, ব্রাহ্মনদেরকে অনেক রকমের দান ও কব্জি ডুবিয়ে অনেককে খাওয়াবেন, – না – হাসপাতালে দেহদান করেডাক্তারী পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের জন্য সহযোগিতা করবেন ?
৩। উপনয়নের মধ্য দিয়ে জাতপাত কুপ্রথাকে তরান্বিত ও মদত দিয়ে - মানবতা বিরোধী অসাম্য ও বিভেদমূলক ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রচারনাকরে – আমরা সকলেই একটাই জাতি তা হল মানব জাতি বলে প্রচার করবেন ?
তা আপনাদের সুবিবেচনার অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মত ও কুসংস্কার বিরোধী সিদ্ধান্তের আশায় থাকলাম ।
" একটি পরমানু ভাঙ্গার চেয়ে
একটি কু-সংস্কার ভাঙ্গা কঠিন"
- আইনস্টাইন


