মনে তৃপ্তি পান - তাই লাভ লোকসানের প্রত্যাশা না করে তিরিশ বছর ধরে দুর্গা মায়ের জন্য পদ্ম ফুল চাষ করে চলেছেন বাবর

মনে তৃপ্তি পান - তাই লাভ লোকসানের প্রত্যাশা না করে তিরিশ বছর ধরে দুর্গা মায়ের জন্য পদ্ম ফুল চাষ করে চলেছেন বাবর
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান
হিন্দুরা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্র কে দেবতা হিসাবেই মেনে থাকেন। রাবণকে বধ করার জন্য সেই রামচন্দ্র অকালে ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে দেবী দুর্গার পুজো করে ছিলেন। সেই থেকে আজও দুর্গা পুজোয় দেবীর চরণে ১০৮ টি পদ্ম নিবেদন করার রীতি চালু আছে। এই সম্প্রীতির বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন মানুষ যেমন চান না সেই রীতিতে ছেদ পড়ুক, তেমনটাই হয়তো চান না মুসলিম মানুষজনও। সেই জন্যেই বোধহয় লাভ লোকসানের প্রত্যাশা না করে দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর ধরে পদ্ম ফুল চাষ করে যাচ্ছেন শেখ বাবর। পূর্বেকার বছর গুলির মত এবছরও বাবরের চাষ করা পদ্মফুলে পূজিত হবেন দেবী দূর্গা।আর বাবরও তাতেই তৃপ্ত।
পেশায় চাষী শেখ বাবর পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ ব্লকের বৈয়াইচণ্ডী এলাকার বাসিন্দা। তাঁর দাদা পদ্মফুল চাষ করা শুরু করেন। দাদা মারা যাবার পর শেখ বাবর পদ্ম চাষ বন্ধ করে দেন নি। উল্টে তিনি তাঁর দাদার দেখানো পথেই পদ্ম চাষের হাল ধরেন। সেই থেকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনি অবিচল রয়েছেন পদ্ম চাষ করে যাওয়ার ব্যাপারে।
সেখ বাবর জানান, পদ্ম ফুল চাষের উপযোগী জলাশয়ের অভাব নেই খণ্ডঘোষ ব্লকে। তাই তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে চৈত্র মাস থেকে জলাশয় পরিষ্কার করে পদ্ম চাষে লেগে পড়েন।সার সহ বিভিন্ন ওষুধপাতি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করে তিনি জলাশয়কে পদ্ম চাষের উপযোগী করে তোলেন।
সরকারী কোন সুবিধা না পেলেও নিখুঁত পরিচর্যা চালিয়েই তিনি পদ্ম ফুল উৎপাদন করেন। নিজের চাষ করা জলাশয় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত পদ্ম ফুল পেয়ে থাকেন বলে বাবর জানান। পাশাপাশি তিনি এও বলেন, বছরের অন্য সময়ে পদ্ম ফুলের চাহিদা ও দাম কোনটাই তেমন একটা থাকে না । দুর্গা পুজোর সময়েই পদ্ম ফুলের দাম একটু বেশী পাওয়া যায় । তবে তার থেকেও বড় কথা হিন্দু ধর্মের মানুষজন দুর্গা পুজোর পদ্ম ফুল তাঁর কাছ থেকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। পুজোর পদ্ম ফুল না পেলে তারা ব্যাথিত হন। এটা তাঁরও খারার লাগে ।তাই লাভ লোসানের প্রত্যাশা না করেই পদ্ম চাষ টাকে ধরে রেখেছেন বলে সেখ বাবর জানিয়েছেন।
হিন্দুদের সবথেকে বড় পার্বণ দুর্গা পুজো। দেবী দুর্গার পুজোয় হিন্দুদের ভক্তি ভাবের কোন অন্ত থাকে না। সেই দেবী দুর্গা এবছরও সেখ বাবরের চাষ করা পদ্মফুলে পূজিত হবেন। দেবীর চরণে পড়বে বাবরের নিজের চাষ করা পদ্ম ফুল। এই বিষটা কেমন লাগে তা বাবরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বাবর বলেন, ’আমার চাষ করা পদ্ম ফুল দেবী দুর্গার চরণে দিয়ে পুজোপাঠ হবে, এতে অসুবিধার কি আছে! আমার তো ভালোই লাগে । আমি মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার চাষ করা পদ্ম ফুলে দুর্গা ঠাকুরর পুজো হয়, এটাই বড় কথা। এর জন্য অনেকেই আমাকে ভক্তি করে, ভালোও বাসেন।
বাবর
হিন্দু পুজারী স্বপন চট্টোপাধ্যায় বলেন, দেবী দুর্গা মায়ের পুজো হয় সবার মঙ্গল কামনায়। সেই মঙ্গল কামনায় জাত ধর্মের কোন ভেদাবেদ থাকে না। কারণ দেবীর কাছে সকল মানুষই সমান। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী ’নর-ই নারায়ন’। পদ্মফুল চাষী সেখ বাবরও একজন ’নর’ অর্থাৎ মানুষ। এটাই তাঁর বড় পরিচয়। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম কন্যাকে কুমারী জ্ঞানে পুজো করেছিলেন। কাজেই বাবরের চাষকরা পদ্ম ফুলও দেবীর পুজোয় সমান মূল্যবান। এটাই দেবী দুর্গা মায়ের পুজোর বড় সার্থকতা।


