রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট: রিয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটি তাত্বিক প্রতিবেদন, লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর রাজকুমার কোঠারী

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট: রিয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটি তাত্বিক প্রতিবেদন, লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর রাজকুমার কোঠারী
01 Mar 2022, 01:53 PM

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট: রিয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একটি তাত্বিক প্রতিবেদন, লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর রাজকুমার কোঠারী

 

রাজকুমার কোঠারী

 

 

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখের সকালে পূর্ণ সামরিক শক্তিতে ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ শুরু করল রাশিয়া। কিয়েভ, খারকীভ, ওডেসার মত গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ ধেয়ে এল রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড সহ বেলারুশ, ক্রিমিয়া এবং কৃষ্ণ সাগর থেকে। বেশ কয়েকমাস ধরেই এই যুদ্ধের জের চলছিল। দুপক্ষের সেনা সমাবেশ এবং কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনাও শোনা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক এবং ডনেটশক নামের দুটি অঞ্চলকে রাশিয়া ইউক্রেন থেকে স্বাধীনঅঞ্চল বলে ঘোষণা করেছে, যার পেছনে সমর্থনরয়েছেঐ অঞ্চলের রাশিয়ার অনুগামী মানুসদের মোধ্যে। ইউক্রেনের সার্বভৌমিকতায় সরাসরি হাত পড়ায় সমস্যার মেঘ গভীরতম হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইউক্রেনকেও জবাব দিতেই হয়, যার থেকে আবির্ভাব বর্তমান পরিস্থিতির।

 

ইতিপূর্বে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো সহ ইউরোপের নেতৃবৃন্দের বিবিধ আলোচনা হওয়া সত্বেও কোন ইতিবাচক সমাধানের পথ পাওয়া যায়নি, তখনই কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল যে পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ দিকে যাচ্ছে।  মার্কিন সরকার সহ পশ্চিমের দেশগুলি কখনোই চায়নি ইউরোপ মহাদেশে আবার নতুন করে  যুদ্ধের সূচনা হোক৷  কিন্তু হটাতকরে রাশিয়াইউক্রেনের  অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে এবং সামরিক যুদধ ঘোষনা করে দেয়।

 

সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া এবং পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলি উভয়েই নিজেদের মধ্যে ইউক্রেনকে একটি বাফার রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছিল। যদিও ইতিহাসের পথ ধরে একটু পিছিয়ে গেলেই আমরা দেখতে পাব যে একটা সময় রাশিয়া ইউক্রেনকে নিজের প্রভাবের বৃত্তের অংশ বলেই মনে করত। এবং তার যথার্থ ঐতিহাসিক কারণও ছিল। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া এবং তার আগের জারের সাম্রাজ্যে ইউক্রেন রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশই ছিল। এই দীর্ঘ সময়ের সন্নিধ্যের ফলে আজও ইউক্রেনের অসংখ্য মানুষ রাশিয়ান ভাষায় কথা বলেন এবং দুই জাতির মধ্যে যথেষ্ট নৃকুল গত নৈকট্যও বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট পূতিন এর বিরক্তির কারণ সোভিয়েত আমলের সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত। আজকে ইউক্রেন-রাশিয়ার সম্পর্কের টানাপোড়েনের বীজ নিহিত স্বয়ং লেনিন এবং নিকিতা খ্রূশ্ছেভের সিদ্ধান্তের মধ্যে।

পূতিন মনে করেন বলশেভিক বিপ্লবের পরে লেনিন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্টালিন বিভিন্ন কারণ দরশিয়ে অনেকগুলি অঞ্চলকে জুড়ে দেন ইউক্রেনের সাথে, এর ফলে আজকের ইউক্রেন অপেক্ষাকৃত একটি বড় সোভিয়েত অঞ্চলে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালে নিকিতা খ্রূশ্ছেভের বদান্যতায় ক্রিমিয়াও ইউক্রেনের অংশে পরিণত হয়। নিকিতা খ্রূশ্ছেভ ‘ক্রিমিয়া অবলাস্ট’ কে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে সোভিয়েত ইউক্রেনের অংশ করে দেন। ফলে পূতিনের বক্তব্য হল, ইউক্রেন আদপে এত বড় জায়গা নয়, সেটা রাশিয়ার যেসব অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে কিছু ভুল রাজনৈতিক কারণে পেয়েছিল সেগুলি আজকের রাশিয়া ফেরত পেতে চায়। বস্তুত উনি দাবি করেন ঐ অঞ্চলের মানুষজন ও নাকি তাই চান। তাই যদি ইউক্রেন ঐ অঞ্চল গুলি কে ছেড়ে না দেয়, রাশিয়া যে কোন মূল্যে তা কেড়ে নেবে। তার কথায় ইউক্রেনকে যদি থাকতেই হয় সে তার পুরোন উনবিংশ শতকের চেহারায় থাকবে, যা  অপেক্ষাকৃত অনেক ক্ষুদ্র।

 

২০১৪ সালের নির্বাচনে ইউক্রেনের জনগণ ভূতপূর্ব  রাশিয়া-বান্ধব রাষ্ট্রপতিকে ভোটে হারিয়ে যখন ইউরোপমুখী সরকার গঠন করে সেটা মস্কোর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের ছন্দ কেটে যায়। এর কারণ পশ্চিমের ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলি তথা সামগ্রিকভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেনকে বিভিন্নভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ঐ অঞ্চলের পূর্বের সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলির অনেকগুলিই ইতিমধ্যে রাশিয়ার প্রভাবের বাইরে গিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমনকি ন্যাটোরও সদস্যপদ নিয়েছে। একমাত্র ইউক্রেনই এর বাইরে ছিল। আর ন্যাটোর সদস্য না হওয়ার দরুন বর্তমান সামরিক সংকটে ইউক্রেনের মাটিতে নেমে সক্রিয় এবং সরাসরি সামরিক সাহাজ্য করার ক্ষেত্রে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির আইনগত সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে সামরিক রসদ সামগ্রী এবং অন্যান্য মানবিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা করা ছাড়া ইউক্রেনকে এই যুদ্ধ একাই লড়তে হবে।

 

যুদ্ধের ফলাফল:

     

এই সামরিক পরিস্থিতির ফলে অচিরেই জ্বালানির সংকট আসতে পারে। সে কথা অনুমান করেই গত সপ্তাহে পৃথিবী জোড়া উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।  পতন হয়েছে একের পর এক শেয়ার বাজারের। ইউরোপের অনেক দেশ গ্যাস এর জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের ফলে সেই পরিষেবা ব্যাহত হতে বাধ্য। ইতিমধ্যেই অপরিশোধিত তেলের মূল্য বিশ্ব বাজারে ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে, যেটা ২০১৪ সালের পরে এই প্রথম। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। এই সংকট তীব্রতর হওয়ার ইঙ্গিত যথেষ্ট। গত দুই বছরের বিশ্বব্যাপী মহামারী থেকে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির জেরে এখনো বাজার নড়বড়ে, এই অবস্থায় যদি জ্বালানির পরিষেবা ব্যাহত হয় তাহলে বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

      আরেকটি বিষয় এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব রাজনৈতিক দিক থেকে পৃথিবী জুড়ে এক বৈধ  একমেরু প্রবনতা স্থাপন করেছিল।  সেটা বিগত কয়েক দশকে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইউক্রেনে এই সামরিক সংকটে মার্কিনী প্রভাব আরও কমে যাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

 

ভারতের অবস্থান:

     

ইউক্রেন কান্ডে রাশিয়াকে একটু কড়া দাওয়াই দেওয়ার লক্ষ্যে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যে ভোটাভুটি হয় তাতে ভারত সরকার ভোট দান থেকে বিরত থাকে। পনের জন সদস্যের মধ্যে এগারো জনই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ভারত ছাড়া চীন এবং আরব অমিরশাহী ভোটদানে অংশ নেয়নি। রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের ভারতের অবস্থানের প্রশংসা করা থেকে বোঝা যায় যে ভারতের এই ভূমিকায় মস্কো খুশি হয়েছে। ভারত ও রাশিয়ার সুসম্পর্ক অনেকদিনের। বস্তুত ভারত কূটনৈতিক কারণেই রাশিয়া এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সখ্যতা বজায় রাখতে চায়। তাই নিরাপত্তা পরিষদে এই দুই যুযুধান গোষ্ঠীর ঝামেলায় কারোর পক্ষ অবলম্বন না করাই সঠিক নীতি বলে মনে করে। এই সিদ্ধান্ত সঠিক কূটনৈতিক ভাবনচিন্তার ফসল।

অনেকবছর পরে ইউরোপে এই যুদ্ধ মহাদেশটির মানচিত্র আবার পাল্টে দিতে পারে। ইউরোপ তথা পশ্চিমের শক্তিধর দেশগুলির সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক বন্ধুত্তপূর্ণ না হলেও স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ এবং এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়ছে, একধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং যৌথবদ্ধতার নীতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে। রাশিয়ার বর্তমানের এই অবস্থান শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের সংস্কৃতির পথ থেকে অনেকটা সরে এল, যা  সামগ্রিক ভাবে বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। এই আগ্রাসী আচরণের ফলে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার স্থিতি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, এই যুদ্ধ আগামি দিনে বিশ্ব ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনতে চলেছে।

 

লেখক: ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ

Mailing List