ধর্মীয় ধারাবাহিক রচনা আমিই সে / চতুর্দশ পর্ব

আমিই সে
(একটি ধর্মীয় ধারাবাহিক রচনা)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
চতুর্দশ পর্ব
আমরা স্বার্থপরের মতো সদাসর্বদা মঙ্গলময় শ্রীহরির কাছে কিছু না কিছু চেয়েই থাকি।
ধর্ম-অর্থ-কাম, সুখ-শান্তি-নিশ্ছিদ্র অনন্ত জীবন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, এই নরদেহ চলে যাবার পর সংসারের কারো যেন কোনো অসুবিধা না হয়----- আমাদের শরীর যাবার পর প্রিয়জনের কেউই যেন কোনোরূপ নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে --- ইত্যাদি, প্রভৃতি ...
কিন্তু, স্বার্থের বাইরে গিয়ে কখনও কি অন্যের উন্নতির জন্য বা ভোগবাদের ঊর্ধ্বে গিয়ে কখনও নিজের অধ্যাত্ম চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য তাঁর কাছে বিগলিত হয়ে প্রার্থনা করেছি?
সংসার-বদ্ধ জীব আমরা, সারাটা দিনই নিজেদের 'আহার-নিদ্রা-মৈথুন'-এর চিন্তা করে থাকি। তবে সংসারে থাকলে এইরকম সংকীর্ণতার জন্ম হয়। মন এই উঁচু, আবার এই নীচু।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল দক্ষিণেশ্বরের পাগলা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের।
--- " বঙ্কিম, তা তুমি সারাদিন কি করো গা ---?"
---" আজ্ঞে ... আহার, নিদ্রা আর মৈথুন ---। অবলীলাক্রমে চটজলদি উত্তর ডেপুটি ম্যজিষ্ট্রেটের ।
--- " আঃ, তুমি বাপু ভারি বাজে কথা বলো।" ঠাকুর স্বক্ষেদে বলে ওঠেন। পরিহাস করে বঙ্কিম তখন উত্তর দেন,
--- " কি করব বলুন, যা খাব, তার-ই ত' ঢেঁকুর তুলব --- । "
--- " ওগো, তারই মধ্যে একটু-আধটু সময় বার করে তাঁকে যে ডাকতে হয়, শরণাগত হতে হয় ।"
বাস্তব জীবনে এই শরণাগত হওয়াটা খুবই জরুরি।
মার্কন্ডেয় তাই শ্রীহরির শরণাগত হতে পেরেছিল বলেই, তাঁর মায়া-জঠর থেকে মুক্তি লাভ করে বাস্তবের জলমগ্ন পৃথিবীতে আবার ফিরে আসতে পেরেছিল ।
এই বর্তমান জগৎ-ও মায়া-প্রপন্চন্ময়, অলীক। তাই 'গুরু কৃপা হি কেবলম্'। গুরুই সার। তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান ভূঃ, ভূবঃ, সঃ, তপঃ --- প্রভৃতি লোকে। এবং ঐ সপ্তলোক ধীরে ধীরে অতিক্রম করে সপ্তলোকেশ্বর, অখিলভূবনের কর্তা --- অনন্ত ব্রহ্মের সন্ধান পায়।
মার্কন্ডেয়র গুরু স্বয়ং তার বাবা-মা, ঋষি মৃকন্ডু, মহর্ষি ভৃগুর বংশোদ্ভূত, আর মহাতপা মরুদবতী, যাঁরা পুত্রকে সবসময় আলোর পথে চালিত করেছিলেন, সত্যের পথে চালিত করেছিলেন, সদ্ ব্রহ্মের নিশানা বলে দিয়েছিলেন।
তারই সেই পথে চলে, আলোকবর্তিকা পথের নিশানা পেতে পেতে হাজির হতে পেরেছিলেন মহাপ্রলয়কালের পর নব-যুগসন্ধিক্ষণের আগে পরম-ব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির সম্মুখে।
তাঁর শরীর থেকে বার হয়ে আবার সেই বালক-রূপী শ্রীকৃষ্ণকে ঐ একই অবস্থায় বটগাছের শাখায় সোনার পালঙ্কে শায়িত থাকতে দেখল। মার্কন্ডেয়কে তিনি সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি আমার উদরে বাস করে বিশ্রাম লাভ করেছ কি? এবং সেখানে বিচরণ করতে করতে আশ্চর্যের বিষয় কিছু দৃশ্য বা বস্তু দেখেছ কি?"
উত্তরে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো যা কিছু ঘটেছিল তাঁর উদরমধ্যে, সব-ই বলল ঐ পরম-পুরুষকে। আবার তিনি স্মিত হেসে বললেন, "তুমি আমার পরম ভক্ত; শ্রান্ত হয়ে আমায় আশ্রয় করেছ। তাই তোমার উপকারের জন্য বলি, তুমি আমাকে এখন অবলোকন কর। "
ভগবান শ্রীকৃষ্ণর কথা শুনে মার্কন্ডেয়র আন্তরিক আনন্দিত হল, এবং সামনের দিকে তাকিয়ে তাঁর শ্রীরূপ দর্শন করে শিহরিত হয়ে উঠল। শ্রীহরির অনুগ্রহে মার্কন্ডেয়র দৃষ্টি-শক্তির প্রখরতা প্রচন্ড বেড়ে যাওয়ায়, রত্নমালা অলঙ্কারে বিবিধ রত্নখচিত কলেবরের অতি বিশালাকৃতির পরমপুরুষকে দর্শন করে তার জন্ম সার্থক করল।
(চলবে..)



