ধর্ম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশ, ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো…’

ধর্ম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সাম্প্রতিক বাংলাদেশ, ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো…’
ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ম-কে কেন্দ্র করে যে ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তা মানবজাতির ও মানবধর্মের কাছে এক অশনি সংকেত। ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার হয়ে একদল মানুষ সমগ্র মানবজাতিকে এক বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। আসলে, ‘ধর্ম’ শব্দটির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার অনুষঙ্গ আমাদের মনের মধ্যে অবিচ্ছেদ্যভাবে গেঁথে আছে। যদিও, ব্যবহারিক দিক থেকে এই দুটি পৃথক সত্তা। ধর্ম-তে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীভিত্তিক সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন, আবার, আচরণের কঠোর বিধি রয়েছে। আধ্যাত্মিকতায় এইসব বিধি-নিষেধ নেই, রয়েছে মানব ধর্ম গ্রহণ করার ধর্মীয় উদারতা। ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরী করে, আধ্যাত্মিকতা মানবধর্ম-কে অন্তরে গ্রহণ করে সব মানুষকে আপন করে নিতে চায়। ধর্মান্ধ মানুষ ধর্মীয় গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে যা সব করেন তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোন সম্পর্ক নেই। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে পর্যালোচনা করা যাক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘আমাদের পরিবারে যে ধর্মসাধনা ছিল আমার সঙ্গে তাহার কোনো সংস্রব ছিল না। আমি তাহাকে গ্রহণ করি নাই’। তিনি, এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন জেরেমি বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২), জেমস মিল (১৭৭৩-১৮৩৬), ওগ্যুস্ত কোঁত (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতবাদের কথা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে, হিন্দু কলেজের শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র (১৮০৯-১৮৩১) শিক্ষায়, রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) চিন্তায়, ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯), প্রভৃতির রচনা অধ্যয়নে পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠীর চিন্তার ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ প্রবল হয়েছিল। টম পেইনের বই দু’খানি ‘The Age of Reason’ এবং ‘Rights of Man’ সমকালে আলোড়ন তুলেছিল। বলা বাহুল্য, সনাতনী হিন্দু সমাজ ও আলেকজাণ্ডার ডাফ (১৮০৬-১৮৭৮) পরিচালিত খ্ৰীষ্টিয় যাজক সম্প্রদায় এই বই দু’টির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এই ‘ধর্মবিদ্রোহ’ স্বভাবতই সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে স্বীকার করেছেনঃ
‘যদিও এই ধর্মবিদ্রোহ আমাকে পীড়া দিত, তথাপি ইহা যে আমাকে একেবারে অধিকার করে নাই তাহা নহে। যৌবনের প্রারম্ভে বুদ্ধির ঔদ্ধত্যের সঙ্গে এই বিদ্রোহিতা আমার মনেও যোগ দিয়াছিল।’
রবীন্দ্রনাথের ১৯১৪-র পরবর্তী উপন্যাসের যে চরিত্রগুলি আমাদের কাছে বরণীয় তাঁরা হলেন ‘চতুরঙ্গের’ জগমোহন, ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলেশ আর ‘যোগাযোগে’র বিপ্রদাস। এই তিন বরণীয় চরিত্র আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে নতশিরে স্বীকার করেননি। যুক্তিহীন ভাবাবেগ এঁদের বশীভূত করতে পারেনি। ‘চতুরঙ্গ’-এর জগমোহন শচীশকে বলেছিলেনঃ
“দেখ্ বাবা, আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমারা কিছুকে মানিনা বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।”
অন্যদিকে তাঁর ভাই হরিমোহন হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী অথচ দুশ্চরিত্র পুত্রের প্রশ্রয়দাতা। জগমোহন তাঁকে বর্জন করেন। জগমোহন বালবিধবা ননীবালার মতো অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব-লাঞ্ছিতা মেয়েকে মাতৃ সম্বোধন করেন ও শচীশের সঙ্গে বিবাহে উদ্যোগী হন। চামারদের ও মুসলমান ব্যাপারীদের হিতানুষ্ঠানে তৎপর ও হন তিনি।
বস্তির দরিদ্র ও রোগাক্রান্ত মুসলমানের সেবা করতে গিয়ে তিনি প্রাণ বিসর্জন দেন। জগমোহনের ভাই তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ “তোমার ঐ চামার মুসলমান দেবতা? উত্তরে জগমোহন বলেছিলেন—“হাঁ, আমার এই চামার মুসলমান দেবতা...।” সম্প্রদায়গত, বর্ণগত, আচার-সর্বস্ব ধর্মের বহু উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত মানবধর্মের প্রতীক রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট এই চরিত্র আমাদের মধ্যে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত।
‘ঘরেবাইরে’-র নিখিলেশ স্বদেশকে ভালোবাসেন। স্বদেশের উন্নতির জন্য নানান কর্মসূচী গ্রহন করেছেন। দেশের সঙ্গেও মেলে, ধর্মেও মেলে এমনভাবে যখন সিংহবাহিনীর পূজার বিপুল আয়োজন হয় রাজনৈতিক আন্দোলনকে জোরদার করার নামে, নিখিলেশ তার বিরোধী। তিনি দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন।
কর্তব্যের যথার্থ ডাক যখন এল নিখিলেশ তাতে সাড়া দিলেন প্রাণের বিনিময়ে। এ ধর্মই মানবধর্ম। আচার-সর্বস্ব ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই ।
‘যোগাযোগ’-এর বিপ্রদাস ‘বীতরাগভয়ক্রোধঃ’। তাঁর অচঞ্চল ও অকলঙ্ক চরিত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তির ছায়া নেই। তাঁর জীবনের ঘটনাবলী তাঁর উক্তিগুলির মধ্য দিয়ে যে ভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা চিরকালের ধর্ম- ‘ন্যায় ধর্মে’র কথা বলে—যা দেয় ‘দুঃখ নব নব’ আর দুঃখবরণের শক্তি।
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৯০৭ সালে শুরু হয়ে ১৯০৯ সালে শেষ হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯১০-এ। এই সূত্রে মনে রাখতেই হয় ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন প্রভৃতিরা ব্রাহ্মধর্ম ও খ্রীষ্টধর্মের প্রতিরোধস্বরূপ যে ‘হিন্দু-রিভাইভ্যাল’ বা ‘নব্যহিন্দু আন্দোলন’ গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সূচনায় এই আন্দোলনকে স্বাগত জানালেও পরে তিনি এই আন্দোলনের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন। স্বামী বিবেকানন্দ নব্যহিন্দু আন্দোলনের নেতাদের ‘আহাম্মক’ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের ‘আর্যামির আস্ফালনে’র তীব্র নিন্দা করেছেন—’ ক্ষুদে ক্ষুদে আর্যগুলো ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে। যখন টিকি, কুশ-আসনের সংযোগকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া আরম্ভ হলো, যখন চন্দ্রনাথ বসুর মতো একদা বঙ্কিমশিষ্য গুরুবদল করে শশধরের অনুগামী হলেন তখনই লেখা হল ‘হিং টিং ছট’ এর মতো বিদ্রুপাত্মক কবিতা। ‘গোরা’ উপন্যাসের ‘কৃষ্ণদয়াল’ চরিত্র এই ‘হিন্দু-পুনরভ্যুত্থান’-এর প্রতীক। যিনি একদিন কিছুই মানতেন না, খাদ্যাখাদ্য, স্পৃশাস্পৃশ্য বিচার করতেন না, কিন্তু শাসক ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে খানাপিনায় গৌরব বোধ করতেন, তিনি শেষে প্রচণ্ড ‘হিন্দু’ হয়ে উঠলেন এবং এক তান্ত্রিক সাধু যোগাড় করে সাধনভজনে লিপ্ত হলেন। আমরা জানি এই সময়ে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদে ইংরেজ বিচারপতি উড্রফ পণ্ডিত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের অনুগামী হয়ে ‘তন্ত্রে’র পুনরুত্থানে যত্নবান হন। এই নব্য-তান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব ‘গোরা’র কৃষ্ণদয়াল চরিত্রে লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের বিরূপতাও স্মরণ-যোগ্য।
তেমনই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী–পরিচালিত ‘নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন’কেও রবীন্দ্রনাথ স্বীকার বা সমর্থন করেননি। বিজয়কৃষ্ণ একদা উপবীত ছিঁড়ে ফেলে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি প্রাচীন দেবেন্দ্রনাথকে ছেড়ে নবীন কেশবচন্দ্রকে গ্রহণ করেন। পরে কেশবচন্দ্রকেও ছেড়ে ফিরে যান নিজেদের কুলগত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে। তিনি চৈতন্যদেবের ভক্ত অদ্বৈতাচার্যের বংশধর, শেষে ‘জটিয়া বাবা’য় রূপান্তরিত হন। ব্রাহ্মসমাজের একটি বড়ো অংশ বৈষ্ণব ভক্তির দিকে ঝোঁকেন, বিপিনচন্দ্র পাল থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ সবাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে লীলানন্দ স্বামীর রস-সাধনার যে রূপ এঁকেছেন, তার থেকেই এর প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘নৈবেদ্য’-কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন—
‘যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে,
মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে
ভাবোন্মাদমত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা
উদ্ভ্রান্ত উচ্ছলফেন ভক্তিমদধারা
নাহি চাহি, নাথ!’
‘গোরা’ উপন্যাস তাই নানাদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। যে গোরা প্রথম জীবনে ছিল প্রবল হিন্দু কিন্তু ‘Hindu revivalist’ নয় ‘Aggressive Hindu’ সেই গোরা উপন্যাসের শেষে বলেছেনঃ ‘আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রীষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন’।
যে ধর্ম, ধর্মতন্ত্রের দাস হয়ে বিকৃত ধর্মাচারে পরিণত হয়, মানুষ হয় লাঞ্ছিত, তার প্রতি কবির ধিক্কার ১৯১০ সালে ৪ জুলাই তারিখে লেখা একটি পত্রে প্রকাশিতঃ
‘কিন্তু আমাদের দেশে ধর্মই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে। আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেছি, স্ত্রীলোককে হত্যা করেছি, শিশুকে জলে ফেলেছি, বিধবাকে নিতান্তই অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেছি, নিরীহ পশুদের বলিদান করেছি এবং সকল প্রকার বুদ্ধি যুক্তিকে একেবারে লঙ্ঘন করে এমন সকল নিরর্থকতার সৃষ্টি করেছি যাতে মানুষকে মূঢ় করে ফেলে’।
এই মূঢ়তার বিরুদ্ধে ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে সংকলিত শাশ্বত মূল্যবোধের কবিতা, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির...’। রবীন্দ্রনাথ সেই দেশ চেয়েছেন যেখানে—
‘যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা—...’
ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িয়ে নেওয়াকে রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেননি। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজি সমর্থিত ও পরিচালিত ‘খিলাফত’ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি, কারণ, সেখানে তিনি দেখেছেন ‘ধর্মতন্ত্র’ রক্ষার চেষ্টা। তার পরিবর্তে তিনি সমর্থন করেছেন কামাল পাশাকে তুরস্কে প্রগতিশীলতার দূত হিসাবে। গান্ধীজির রাজনৈতিক আন্দোলনে ধর্মের ভূমিকা তিনি সমর্থন করেননি। ‘অস্পৃশ্যতার পাপে ভূমিকম্প হয়েছে বিহারে’, গান্ধীজির এই অবৈজ্ঞানিক অযৌক্তিক ভাষ্যের তিনি নিন্দা করেছেন। ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় ও অন্যত্র যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় রবীন্দ্রনাথ তার জন্য ব্যথিত, লজ্জিত, মর্মাহত হয়েছিলেন। এপ্রিলে একটি পত্রে প্রমথ চৌধুরীকে জানিয়েছেন তাঁর মর্মবেদনা। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখে তিনি লেখেন ‘ধর্মমোহ’ নামে একটি অবিস্মরণীয় কবিতা।
‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।
বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে,
পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে,
আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে,
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা,—
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা।...’
যে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ মানুষকে খুন করছে সেই ধর্মকারার প্রাচীরকে ভেঙ্গে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনিঃ
‘ধর্মকারার প্রচীরে বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’
রবীন্দ্রনাথকে উপনিষদের যে বাণীগুলি উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাঁর চেতনাকে বিশ্বজনীনতার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, সেই বাণীর প্রতিধ্বনি তিনি শুনলেন পদ্মাবিধৌত বাংলাদেশের নানান অঞ্চলের লোক-সাধকদের গানে। লালন ফকির, গগন হরকরা, বিশে ভূঁইখালি, মদন বাউল, হাসন রাজা, প্রভৃতি ফকির বাউলদের গানে। তিনি শুনলেন সে সব গানে ‘মন্দির মসজিদে’র, ‘পুরাণ-কোরাণ-তসবী মালা’র বিরুদ্ধে সাহসিক উচ্চারণ, উপলব্ধি করলেন ‘মনের মানুষ মনের মধ্যে কর অন্বেষণ’—যাকে উপনিষদ বলেছেন ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’। এরই টানে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক ধর্মবাণী, কবীর, নানক, দাদু, রজ্জব, তুকারাম প্রভৃতি মধ্যযুগীয় ‘সন্ত’দের রচনায়। ১৯৩০ সালের মে মাসে তিনি অকসফোর্ডে যে হিবার্ট বক্তৃতা দেন তার শিরোনাম ‘Religion of Man’। এই বক্তৃতার পরই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় যান। এই সময় থেকে তাঁর চিঠিপত্র, ভাষণ, কবিতা প্রভৃতির মধ্যে ‘নরদেবতা’র বন্দনা উচ্চারিত, আনুষ্ঠানিক-প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিন্দিত। তিনি বন্দনা করেন সেই সব মহৎ মানুষকে, বুদ্ধদেব, খ্রীষ্ট, মুহম্মদকে—
‘...তোমার জ্যোতির স্তিমিত কেন্দ্রে মানুষ
আপনার মহৎস্বরূপকে দেখেছে কালে কালে,
কখনো নীল-মহানদীর তীরে,
কখনো পারস্যসাগরের কূলে,
কখনো হিমাদ্রিগিরিতটে–...’
১৯৩০ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণকালে তিনি দেখে অবাক হয়ে যান, যে-সব মুসলিম ‘জাতি’ (nationality) শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোক বঞ্চিত হয়ে বিংশশতকেও যেন মধ্যযুগে পড়ে ছিল মাত্র কয়েক বছরে তাদের কল্পনাতীত বিকাশ ঘটেছে। নন্দলাল বসুকে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
‘আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতুম না যে অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতির জন্যও এদের সমান প্রচেষ্টা। অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষেরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে? দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে? মানুষকে যারা কেবলি ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে?’
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেক্যুলারিজম এর অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। যেভাবে সেক্যুলারিজমকে তখন দেখা হয়েছিল, তাতে করে জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন থাকার কথা ছিল, রাষ্ট্রের এক ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ৫০ বছর পরে, আজ বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ধর্ম ফিরে এসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভেদ তৈরী হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে বিভেদের শক্তি। বাংলাদেশের ভূমিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা তাই প্রমান করে।
আজকের এই সংকটের দিনে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে পাথেয় করে আমাদের চলার পথ ঠিক করে নিতে হবে।
লেখক: রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (২০১৫) ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষারত্ন (২০২১) পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং রবীন্দ্র গবেষক।


