রেলকাহন / রম্যরচনা

রেলকাহন / রম্যরচনা
সুদর্শন নন্দী
লাইনের উপর দিয়ে ট্রেন ছোটার রোমাঞ্চকর কু-উ-উ ঝিক-ঝিক আওয়াজের স্মৃতিতে আবেশিত হই আমরা সবাই| এই বিশাল গণ-যাতায়াতের মাধ্যম ছাড়া আজকের জীবন যে স্তব্ধ তা বলাই বাহুল্য| সেই হিসেবে মা-মাটি-মানুষের মতো, রেললাইন-ট্রেন-মানুষ প্রায় একই গোত্রের বলা যেতে পারে| মানুষের জীবনে রেলকে ঘিরে রয়েছে আলাদা নস্টালজিকতা| অত্যন্ত আনন্দের কথা যে অন্তত ভারতবর্ষে ট্রেনের দুয়ার আমির থেকে গরিব, পাগল থেকে ছাগল, ভবঘুরে থেকে ভাবুক, ডাক্তার থেকে মোক্তার, ছিঁচকে থেকে ডাকাত সবার জন্য খোলা।
আর এই রেলের উপরই নির্ভরশীল কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা| চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, কুলি-মজুর থেকে ওয়াগেন ব্রেকার বা চোর পকেটমার সব শ্রেণি বেঁচে রয়েছে রেলের উপর দাঁড়িয়ে | বেঁচে রয়েছে হকার থেকে লুলা-ল্যাংড়া–অন্ধ কানাই-ভিখারী সব্বাই | আবার রেলের প্লাটফর্ম যে কত ভবঘুরের আশ্রয় তার হিসেব কে রাখে ! মাথার উপর শেড, শেডে ঝুলছে লাইট -পাখা, হাত বাড়ালেই জল- সবই নাগালের মধ্যে | রেল পুলিশ তেড়ে না এলে বা তাদের সন্তুষ্টি ফি দিয়ে ম্যানেজ করতে পারলে প্লাটফর্ম বিনি পয়সায় থাকা-শোওয়ার এবং শেয়ার করার উত্তম জায়গা|
রেল শুধু যাতায়ত নয়| প্রতিবাদ ফলানোরও এক বিশাল ক্ষেত্র| ঘরের বউ-চুরি থেকে ছাগল-চুরি হোক বা হরতাল থেকে তিল-তাল পাকানো ঝগড়া মারামারি হোক অথবা বন্ধের নোটিস লটকানো কারখানা খোলার জন্য হোক- সব কিছুর প্রতিবাদের ও বিবাদের রাস্তা যেন রেললাইন| দাও বন্ধ করে রেল চলাচল| প্রয়োজনে দাও কলাপাতা ফেলে ওভারহেড তারে |
চুরি রেলের এক ক্ল্যাসিক সংস্কৃতি| কথায় বলে রেলে চুরি বন্ধ হলে রেল লাইন সোনায় মুড়ে দেওয়া যেত| চুরি বন্ধ হয় নি| চুরি চামারির মধ্যেও যেনতেনপ্রকারেণ ট্রেন চলছে তবু লাইনের উপর দিয়ে| কথার কথা ফলে গিয়ে চুরি যদি সত্যি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে লাইন সোনায় মোড়া হলে পুরো লাইনই তো চুরি হয়ে যাবে! ট্রেন চলবে তখন কার উপর দিয়ে?
থ্যাংকস টু রেলের চুরি-চামারি।
রেলে চুরি প্রায় সবার হাতেই| টপ্ ফ্লোর টু গ্রাউন্ড ফ্লোর। কোথাও পরোক্ষ ভাবে আবার কোথাও হাতেনাতে- তা সে টিটিই-র বিনা টিকিটের যাত্রী থেকে প্রাপ্তি হোক বা পার্সেলবাবুর কমিশন, অথবা নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হোক বা বিনিয়োগ নিয়ে কাটমানি| দুনম্বরী আয়ের রাস্তার এক বিশাল নেটওয়ার্ক এই রেল| নেটওয়ার্কের নিরিখে বিশ্বে চতুর্থ হলেও চুরির নিরিখে ভারতীয় রেল একনম্বরে তা হলফ করে বলা যায়| আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ছেলেবেলায় রেলের কয়লা চুরি দেখতাম| একটা লম্বা বেড়ার ডালের বা লাঠির ডগায় দশ পয়সা বা সিকি আধুলি গুঁজে দিয়ে লোক ঝুড়ি নিয়ে রেল লাইনের পাশে দাড়িয়ে থাকত| ট্রেন এলে ড্রাইভার গতি কমিয়ে ইঞ্জিন থেকে সেই পয়সা নিতেন আর বেলচা করে হিসেব মত কয়লা ফেলে দিতেন রেল লাইনে। এরপর ফ্যান চুরি, আসনের ফোম চুরির হাত ধরে পুকুর চুরি সবই দেখেছি বা শুনেছি | রেলের বগিতে আগে লেখা থাকত “রেলের সম্পত্তি আপনার| এর রক্ষা করার দায়িত্বও আপনার|” এদেখে রসিক চোরদের আবার ফ্যান চুরি করে পাশে “আমার সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়া লইলাম” লিখে যেতেও দেখেছি শিয়ালদা লাইনে| সাধারণ ঘর-গৃহস্থের বিয়েতে রেলের চাকুরেদের ডিমান্ড হেব্বি| টিটিই হলে তো কথাই নেই। পুলিশের ঠিক পরেই| তবে কেরানি, মাস্টারদের ডিমান্ডের অনেক উপরে| স্রেফ একটাই কারণ| লং রুটের ট্রেনে গড়ে দশটি বার্থ বিক্রি করলেই মাসে আশি থেকে একলাখ বাড়তি ইনকাম টিটিইদের| আবার এই টিটিই-দের অদ্ভূত এক সেন্স কাজ করে| ছিপের ফাতনায় চোখ রাখার মতো প্লাটফর্মের যাত্রী আনাগোনায় চোখ রেখে হাজার হাজার যাত্রীর মধ্যে যার হাত ধরে টান মারবে পাক্কা তার কাছে টিকিট থাকে না| টিকিট না থাকলে টিটিইর অপারেশন সাকসেসফুল, টাকাটা অবশ্যই যেন যাত্রীর পকেটে থাকে| আবার ডেঁপো যাত্রিও কম থাকে না| তাদের আজব সব কায়দা দেখা যায় ফাঁকি মেরে প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যাবার|
বিদেশী সাহিত্য থেকে দেশীয় সাহিত্যে রেল নিয়ে গল্প, কবিতার ছড়াছড়ি | সিনেমাতেও রেল বক্স অফিস হিট করে | তা সে বার্নিং ট্রেন হোক বা বিদেশী ঘোস্ট ট্রেন, টেরর ট্রেন হোক | তেমনি বাংলায় ট্রেনের নস্টালজিয়ার কথা বলতে হলে পথের পাঁচালির কথাই যথেষ্ট |
মজার মজার কাহিনী রয়েছে এই রেল যাত্রা নিয়ে| আমরা সবাই পরিচিত চলন্ত ট্রেনের ভেতর বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গম্ভীর মেজাজটি নিয়ে| প্রথম শ্রেনিতে যাত্রা করছিলেন তিনি| তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন| এক নেটিভের প্রথম শ্রেণীতে ট্রেনে চড়া এক বৃটিশের সহ্য না হওয়ায় রাগে সে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জুতোজোড়া ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেন| ব্যাপারটা খেয়াল হতে তিনিও ঐ বৃটিশের কোর্ট দিলেন ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে| ব্রিটিশ ঘুম থেকে কোর্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বাংলার দোর্দণ্ড প্রতাপ বাঘ বললেন- আপনার কোর্ট আমার জুতা আনতে গেছে| মনিষীদের নিয়ে এরকম অসংখ্য কাহিনী রয়েছে ট্রেনকে ঘিরে| কবিগুরুর ছেলেবেলার এক ঘটনা| ঘটনার জায়গায় দুঃস্মৃতি বলাই ভালো| পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি বোম্বাই যাচ্ছিলেন ট্রেনে| বয়স তার এগারো| পিতা একটি ফুল ও একটি হাফ টিকিট কিনেছেন| রবীন্দ্রনাথ বেশ লম্বা ঐ এগারো বছর বয়সে| এক চেকার এসে টিকিট দেখে সন্দিহান চোখে চলে গেলেন| খানিকপর আরেক চেকার টিকিট নিয়ে একই রকম সন্দিহান হলেন| এক স্টেশনে এবার তারা নিয়ে এলেন স্টেশন মাস্টারকে| তার কেউ দেবেন্দ্রনাথের মতো মনীষী কে চিনতে পারেন নি| দেবেন্দ্রনাথ বিতর্কে না গিয়ে দিয়ে দিলেন পুরো ভাড়া| চেকার ব্যালান্স পয়সা ফেরত দিলে তিনি তা ছুড়ে ফেলে দিলেন কামরায়| চেকার, স্টেশন মাস্টার বিস্ফোরিত চোখে বিদায় নিলেন| এছাড়া মজার মজার হাসির গল্প রয়েছে ট্রেন যাত্রা ঘিরে| তা সে শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন হোক বা সিনেমার চেন্নাই এক্সপ্রেস হোক| রয়েছে লোকমুখে জোকস| এরকম একটি জোকস উল্লেখ করি ইতি টানব| এক স্টেশনে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে| তিন বন্ধু দৌড়ে এসে পড়ি মরি চেষ্টা করে একজন উঠলেন ট্রেনে| প্লাটফর্মেই রয়ে গেলেন বাকি দুজন | রয়ে তো গেলেন কিন্তু হেসেই তারা অস্থির| এক চেকার তা দেখে বললেন- দাদা ট্রেন মিস করে এত হাসছেন, কি ব্যাপার? ঐ দুই বন্ধু উত্তর দিলেন- ট্রেন চড়তে এসেছিলাম আমরা| যে চেপে গেছে সে আমাদের ছাড়তে এসেছিল| কেমন উলটপুরান বলুন দেখি| মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
লেখক পরিচিতি - সুদর্শন নন্দী বিশিষ্ট গল্পকার, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক। সমাজ সচেতনতা নিয়ে পত্র পত্রিকায় চিঠিও লেখেন নিয়মিত।


