রবীন্দ্রনাথ কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেননি, তাই বলে স্বাধীনতার সলতেতে আগুন দেননি নাকি? স্বাধীনতা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেননি, তাই বলে স্বাধীনতার সলতেতে আগুন দেননি নাকি? স্বাধীনতা আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ
ড. বিবেকানন্দ চক্রবর্তী
উনিশ শতকে ‘নব্য বাঙালী’ জাতির উত্থান আধুনিক জগতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। বহু শতকের পরাধীনতায় পীড়িত জাতির ভেতর থেকে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘জাতীয় সমুন্নতি’র একটা অনমনীয় ইচ্ছা যে এই যুগে জেগে উঠেছে এবং সেটাই যে জাতিকে তার লক্ষ্য পথে অজেয় আকর্ষণে পরিচালিত করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বহু মনীষী ও শক্তিশালী ব্যক্তিরউনিশশতকে আগমণ হয়েছিল এবং তাঁদেরই সুদীর্ঘ তপস্যার ফলে বাঙলায় ‘জাতীয় আন্দোলন’-এর সৃষ্টি হয়েছিল এবং সমগ্র ভারতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সেই সব শক্তিশালী মনীষীদেরই একজন এবং জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তাঁর তপস্যার দানও অসামান্য।
রবীন্দ্রনাথ যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, তাকে আধুনিক বাংলার ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। উনিশ শতককে দেশে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল। তার মধ্যে যে সময় রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন, তখন সমস্ত দিক দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটা মহৎ সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছিল। উনিশ শতকের ষষ্ঠ দশকে ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও কাভুরের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ইতালি বহুদিন পর অস্ট্রিয়ারদাসত্বথেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। এই সময়ে আমেরিকার ক্রীতদাসেরা মানবকল্যাণকামীদের আন্দোলনের ফলে মুক্তি লাভ করেছিল এবং ক্রীতদাস প্রথা চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়েছিল। এই সব আন্দোলনের তরঙ্গ বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের উপর পড়েছিল। দেশের মধ্যে ছিল সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব। তার ফলে সাহিত্যের বিকাশ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সমাজ সংস্কার ও ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন—জাতীয় জীবনে তখন সমস্ত দিক থেকে জাগরণের সাড়া পড়েগেছিল। বাংলাদেশ সমগ্র ভারতবর্ষে শীর্ষ স্থান অধিকার করেছিল এবং সবদিক থেকেই অগ্রগামী ও পথপ্রদর্শক হয়েউঠেছিল।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাতীয় আন্দোলনের ভাবধারা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাংলা সাহিত্যকে প্লাবিত করেছিল। তখনকার অনেক কবি, মনীষী ও সাহিত্যিক বাংলার জাতীয় জীবনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর দেশের যে একটা নতুন ভাবের সঞ্চার হয়েছিল, বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের মনে তা সর্বপ্রথম প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য কেবল মিত্রাক্ষর ছন্দের শৃঙ্খল ভেঙে বিদ্রোহের পরিচয় দেয়নি,ঐ কাব্যের আগাগোড়া স্বাধীনতার একটি দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত বয়ে চলেছে। এই সময়েই কবি রঙ্গলাল তাঁর ‘পদ্মিনী’ কাবিতায় লিখলেন—
‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।।
...
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ সুখ তায় হে,
স্বর্গ-সুখ তায়।’
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক এই সময়েই বিদেশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্রকন্ঠে বিদ্রোহধ্বনী তুলেছিল। এইরকম সময় ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে বলেছেনঃ তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, সে পরিবারে আগে থেকেই ‘স্বদেশী’ ও‘জাতীয়ভাব’প্রবল ছিল। তাঁরপিতা ও সহোদরগণ—মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ,দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ,জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখ খ্যাতিসম্পন্নপুরুষদেরদানে জাতীয় জীবনের নানাদিকপরিপূর্ণ হয়েছে। বিশেষত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’যে স্বদেশীভাবপ্রচারেযথেষ্ট সাহায্য করেছিল তাতে কোন সন্দেহনেই।
রবীন্দ্রনাথের শৈশবে ‘হিন্দুমেলা’র সূচনা হয়। কংগ্রেসের জন্মের ১৮ বছর আগে ১৮৬৭ সালে ‘হিন্দুমেলা’র সূচনা। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এই মেলা হতো। দেশের যত জ্ঞানী, গুণী, চিন্তানায়ক, কবি, সাহিত্যিক ছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই ‘হিন্দুমেলা’য় যোগ দিতেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি মনোমোহন বসু, শিশিরকুমার ঘোষ ওনবগোপাল মিত্র প্রভৃতি।
জাতীয় ভাবের বক্তৃতা, জাতীয় সংগীত প্রভৃতির দ্বারা এই ‘হিন্দুমেলা’য় দেশবাসীর মনে স্বদেশ-প্রেমের অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করা হতো। স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধারের আয়োজনও এই মেলাতে সর্বপ্রথম হয়েছিল। ‘হিন্দুমেলা’য় যে জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তার মধ্যে আমরা কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। ‘হিন্দুমেলা’র উদ্যোক্তারা অখণ্ড ভারত ও এক ভারতীয় মহাজাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কেবল বাংলা বা বাঙালির কথা ভাবেননি।
‘হিন্দুমেলা’তেই সর্বপ্রথম ‘জাতীয় সংগীত’রচিত ও গীত হয়েছিল। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লজ্জায় ভারত-যশ গাহিব কি করে’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মিলে সব ভারত সন্তান’, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির ‘না জাগিলে সব ভারত-ললনা এ ভারত আর জাগে না, জাগে না’, কবি মনোমোহন বসুর ‘দিনের দিন সবে দীন’ প্রভৃতি বিখ্যাত জাতীয় সংগীত এই ‘হিন্দুমেলা’তেই গাওয়া হয়েছিল।
‘হিন্দুমেলা’র উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্র। রাজনারায়ণ বসুর কল্পনা আর নবগোপাল মিত্রের উৎসাহ ও কার্যকরী শক্তি এই ‘হিন্দুমেলা’র সাফল্যের প্রধান কারণ। নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে ও গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আনুকূল্যে ও উৎসাহে ‘হিন্দুমেলা’ প্রতিষ্ঠিত হলো। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক এঁরা ছিলেন মেলার পৃষ্ঠপোষক। শিশিরকুমার ঘোষ ও মনমোহন বসুও এই মেলায় খুব উৎসাহী ছিলেন। এই ‘হিন্দুমেলা’তেই সর্বপ্রথম জাতীয় শিল্প প্রদর্শনীর পত্তন হয়। ঐ মেলায় তখন কৃষি, চিত্র, শিল্প, ভাস্কর্য, স্ত্রীলোকদের সূচি ও কারুকার্য, দেশীয় ক্রীড়াকৌতুক, ব্যায়াম প্রভৃতি জাতীয় সমস্ত বিষয়ই প্রদর্শিত হতো। এই মেলা উপলক্ষ্যে কবিতা প্রবন্ধাদিও পাঠ হতো।
কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ অগ্রজদের সঙ্গে ‘হিন্দুমেলা’য় যেতে শুরু করেন। ১৮৭৫ সালে (রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৪ বছর),‘হিন্দুমেলা’য় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘হিন্দুমেলা’র উপহার’ পাঠিত হয়। এই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজনারায়ণ বসু-রসভাপতিত্বে একটি ‘স্বাদেশিক সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোর রবীন্দ্রনাথ এই সভার একজন সভ্য ছিলেন। ‘হিন্দুমেলা’র মতো এই ‘স্বাদেশিক সভা’ও রবীন্দ্রনাথের মনের উপর প্রভুত প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সভা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেনঃ “দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক্মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি…। আমার মত অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। এই সভায় আমাদের প্রধান কাজ ছিলো উত্তেজনার আগুন পোহানো”। এইরূপ অনুকূল পরিবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কিশোর জীবন অতিবাহিত হয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রজাতীয়ভাবের সংস্পর্শে আসার সুযোগ তিনি লাভ করেছিলেন। বাংলার আকাশে-বাতাসে তখন যে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়ভাবেরআগমনবার্তারবীন্দ্রনাথ সেই বার্তা অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন যুবক তখন বাংলাদেশে ‘বঙ্কিমচন্দ্রের যুগ’। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু সাহিত্য স্রষ্টা ছিলেন না, তৎকালীন বাংলার চিন্তাওভাব জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একটা নবযুগের স্রষ্টা—নবীন বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে তিনি যে প্রবলভাবে জাতীয় ভাবের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন, তার ঢেউ রাষ্ট্রে সমাজে, যে অভিঘাত তৈরি করল তাতে জাতির সামনে নতুন দরজা খুলে গেলো। বাংলার জাতীয় আন্দোলন ও স্বাদেশীকতার উপর এই বঙ্কিম-প্রতিভার প্রভাব অপরিসীম। তাঁর জাতীয় আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল ‘আত্মশক্তির সাধনা’ ও ‘ভিক্ষা-নীতি ত্যাগ’। ব্রিটিশদের কাছে আবেদন নিবেদন করে যে কোনও দেশ স্বাধীন হবে না, রাজনীতিতে ভিক্ষুকের যে কোন স্থান নেই, নিজের শক্তির ওপর ভর করে কঠোর সাধনার পথে যে জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, বঙ্কিমচন্দ্র নানাভাবে নানা দিক দিয়ে এই নিষ্ঠুর সত্য দেশবাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছিলেন। একদিকে অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠা উদ্ঘাটন করে তিনি জাতির ত্রুটি ও দৌর্বল্য তুলে ধরতে যেমন দ্বিধাবোধ করেন নি, অন্যদিকে স্বজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে আশারবানীও শুনিয়েছিলেন।
‘বঙ্গদর্শন’-এর মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে স্বদেশ-যজ্ঞের হোমানল প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। এই মহাযজ্ঞে তাঁকে সাহায্য করবার জন্য যাঁরা সহকর্মী রূপে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা হলেনঃ দীনবন্ধু মিত্র, কবি হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, রজনীকান্ত গুপ্ত, রামদাস সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি বিখ্যাত মানুষজন এই সৌরমন্ডলের বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সূর্য আর অন্য সকলে জ্যোতিষ্মান গ্রহ। বাংলার স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তার উদ্বোধনে এঁদের অবদানের তুলনা নেই।
কবি রবীন্দ্রনাথ পূর্বগামী বাংলা সাহিত্যিকদের কাছ থেকে আত্মশক্তি সাধনার এই ধারা লাভ করেছিলেন—এ বিষয়ে তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের যোগ্য শিষ্য। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁরসাহিত্য-শিষ্য হিসাবেতরুণ রবীন্দ্রনাথেরগলায় নিজের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেবল তাতেই বঙ্কিমচন্দ্র সন্তুষ্ট হননি। রবীন্দ্রনাথকে আত্মশক্তির সাধনাতেও তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন। তরুণ রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রিয় পাত্র ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর কাছে যেতেন। এই বিরাট ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথের মনেস্বদেশ প্রেম ও জাতীয় ভাবের বিকাশে যথেষ্ট সহায়তা হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
১৮৯২ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং রবীন্দ্রনাথ এর সম্পাদনার ভারগ্রহণ করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। এই ‘সাধনা’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রবন্ধ, জাতীয়ভাবপূর্ণ কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’ এই ‘সাধনা’তেই প্রকাশিত হয়। ১৮৯৩ সালে তিনি কলকাতার এক জনসভায় (চৈতন্য লাইব্রেরীতে) তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ পাঠ করেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এই সভার সভাপতি।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেস ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের কয়েকটি অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু সব জায়গাতেই তিনি ‘আবেদন নিবেদন নীতি’র প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেন এবং আত্মশক্তির সাধনার উপরেই জোর দিতেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ যোগদান করেন এবং নিজের রচিত “আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে” এই গানটি করেন। তারপর ১৮৯৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়, তাতেও তিনি যোগ দেন। লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনেই রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত জাতীয় সংগীত “বন্দেমাতরম” নিজে সুর সংযোগ করে গান করেন। সেই থেকে “বন্দেমাতরম” গান রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত সুরেই প্রতিবছর কংগ্রেসে গীত হয়ে আসছে। জনসাধারণের মধ্যেও এই সুর প্রচলিত হয়েছে। সুতরাং জাতীয় আন্দোলনেএটি রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ দান বলা যেতে পারে। ১৮৯৭ সালে নাটোরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্স বা রাষ্ট্রসম্মিলনীর যে অধিবেশন হয়, তাতে রবীন্দ্রনাথ যোগ দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঐ অধিবেশনের সভাপতি।১৮৯৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসম্মিলনের ঢাকা অধিবেশনেও রবীন্দ্রনাথ যোগ দেন। সম্মিলনে দেশীয় ভাষা, দেশীয় ভাব, জাতীয় পোশাক-পরিচ্ছদের সমর্থন করে তিনি বক্তৃতা দেন। এই সময়েই বিজাতীয় অনুকরণ ও সাহেবিয়ানা প্রতি ঘৃণা প্রকাশ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কষাঘাত করে তিনি বহু প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, ব্যঙ্গ নাট্য প্রভৃতি রচনা করেন।
১৮৯৮ সালে রাজদ্রোহের অভিযোগে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক গ্রেপ্তার হন। রবীন্দ্রনাথ গভর্ণমেন্টের এই কাজের তীব্র সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখেন এবং তিলকের মোকদ্দমার খরচ চালাবার জন্য অর্থ সংগ্রহেও সাহায্য করেন। রাজদ্রোহ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার জন্য কলকাতার টাউন হলে যে বিরাট সভা হয় রবীন্দ্রনাথ সেই সভায় “কণ্ঠরোধ” নামক তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশের পর স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু এই আন্দোলন সহসা আবির্ভূত হয়েছিল কোনও ঐতিহাসিকই এমন কথা বলবেন না। কোনও জাতির জীবনেই কোনও বৃহৎ ঘটনা, কোনও প্রচন্ড যুগান্তকারী আন্দোলন হঠাৎ হয় না, তার পিছনে দীর্ঘকালের একটা সাধনা ইতিহাস নিশ্চয়ই থাকে। বাংলাদেশেও ১৯০০-১৯০৫ সালে এমনি একটা উদ্যোগ পর্বের যুগ। এই যুগে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজন শক্তিমান পুরুষ।
১৯০১ সালে শ্রীশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেশচন্দ্র মজুমদার ভাতৃদ্বয়ের উদ্যোগে ‘বঙ্গদর্শন’ পুনঃপ্রকাশিত হয়। এই নবপর্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’-এর সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় একদিন ‘বঙ্গদর্শন’ যেমন নবযুগ এনেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় নব পর্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’ও তেমনি স্বদেশী যুগের ডাকে অশেষ কাজ করেছিলেন। এই পত্রে রবীন্দ্রনাথ পূর্ণোদ্যমে তাঁর ‘আত্মশক্তি’র মূলমন্ত্র প্রচার করতে লাগলেন। জাতির অন্তর্নিহিত শক্তি যে পল্লী থেকে গড়ে তুলতে হবে, এটা তিনি পাশ্চাত্য রাজনীতির মোহগ্রস্ত শিক্ষিত দেশবাসীকে শোনাতে লাগলেন। ভারতের অতীত গৌরব, তার সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা এই ‘বঙ্গদর্শনে’র মধ্য দিয়েই প্রবন্ধের প্রবন্ধ তিনি বর্ণনা করতে লাগলেন।এই সময়ে আর যে কয়জন শক্তিমান পুরুষ রবীন্দ্রনাথের সহকর্মীরূপে যুবকগণের মনে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করছিলেন, তাদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও বিপিনচন্দ্র পালের নাম সর্বপ্রথম উল্লেখ করা যেতে পারে।
স্বদেশী যুগের এই ঊষায় আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘ডন সোসাইটি’-র নাম বাংলার জাতীয় জীবনে অমর হয়ে থাকবে। এই ‘ডন সোসাইটি’ ছিল স্বদেশ সেবার পাঠশালা। দেশকে কি করে সেবা করতে হয়, স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধার কোন পথে হতে পারে, আচার্য সতীশ চন্দ্রের নেতৃত্বে ‘ডন সোসাইটি’র সদস্যরা সেই সব কথা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করতেন এবং হাতে কলমে কাজ করতেন।১৯০২-০৩ সাল,তখনো স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হয়নি, কিন্তু ‘ডন সোসাইটি’র সদস্যরা নিজেরা মোটা স্বদেশী কাপড় পরতেন এবং তা বিক্রি করে বেড়াতেন। ‘ডন সোসাইটি’ ‘দ্য ডন’ নামে একটি মুখপত্র প্রকাশিত হতো এবং সদস্যরাই তা পরিচালনা করতেন। ঐ পত্রে স্বদেশী শিল্প গঠন, পল্লী সংগঠন প্রভৃতি সম্বন্ধে বহু তথ্যপূর্ণ মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো।‘ডন সোসাইটি’র সঙ্গে আর্যা নিবেদিতা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির যোগ ছিল এবং তাঁরা সোসাইটির সভায় এসে বক্তৃতা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ, সতীশ চন্দ্রের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ‘ডন সোসাইটি’র হিতৈষী ও পরামর্শদাতা ছিলেন। অনেক সময় সোসাইটির গৃহে এসে রবীন্দ্রনাথ সতীশ চন্দ্রের সঙ্গে স্বদেশসেবার নানা পরিকল্পনা করতেন। সোসাইটির তরুণ সদস্যদের রবীন্দ্রনাথ দেশসেবা সম্বন্ধে উপদেশ দিতেন, বক্তৃতা দিতেন। একবার বক্তৃতার শেষে সবাই অনুরোধ করলো রবীন্দ্রনাথ-কে, একটি গান গাইতে হবে। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে কিছুতেই রাজি হননি, পরে যুবকদের সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াতে না পেরে পকেট থেকে একটি ছোট্ট খাতা বের করে নুতন রচিত একটি গান করলেন। বিখ্যাত গানঃ
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়—
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়—
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে ॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে—
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে ॥
১৯০৪সালে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বদেশী সমাজ’ নামে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তখনকার শিক্ষিত সমাজ ও রাজনৈতিক মহলে বিশেষ চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা সঞ্চার হয়েছিল। এই বক্তৃতা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয় এবং হাজার হাজার কপি বিতরণ করা হয়। এই ‘স্বদেশী সমাজেই’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতি গঠনের নিজস্ব পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। দেশ ও জাতিকে সংঘবদ্ধ করে কি ভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসনতন্ত্র ভিতর থেকে গড়ে তোলাযায়, এটাই ছিল তাঁর পরিকল্পনার মূল ভিত্তি। বাইরে বিদেশি গভর্মেন্ট থাকুক, তার সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। দেশবাসীর নিজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন তারা স্বতন্ত্রভাবে নিজেরাই মেটাবার চেষ্টা করবে। নিজেদের শিল্প-বাণিজ্য নিজেরাই গড়ে তুলবে। সালিশি প্রথার দ্বারা বিবাদ-বিসম্বাদ মিটাবার ব্যবস্থা করবে। শান্তি রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনের ব্যবস্থাও এর মধ্যে ছিল, স্বদেশী বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়েছিল। অর্থাৎ বৃহত্তর ও বিদেশী গভর্মেন্টের ভিতরে আর একটি স্বতন্ত্র স্বসম্পূর্ণ "স্বদেশী সমাজ" গড়ে তুলতে হবে, এটাই ছিল মূল কল্পনা।
১৯০৪ সালের আর একটি স্মরণীয় ঘটনাঃ কলকাতায় ‘শিবাজী উৎসব’। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতি নব জাতীয়তাবাদীদের উদ্যোগে এই ‘শিবাজী উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। মহারাষ্ট্র নেতা লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক এই উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য পুনা থেকে কলকাতায় আসেন। এই ‘শিবাজী উৎসব’ এর একটা প্রধান অঙ্গ ছিল শক্তিরূপিণী ভবানীর পূজা।
এই উৎসব উপলক্ষে কলকাতার টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত কবিতা “শিবাজী উৎসব” পাঠ করেন।
১৯০০-১৯০৫— এই পাঁচ বছর বাংলার জাতীয় জীবনে মহাসন্ধিক্ষণ। এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এক শতক পথ অতিক্রম করেছিল। রবীন্দ্রনাথ, এই ‘স্বদেশী যুগের ঊষায়’জাতির ভাব ও চিন্তা পরিচালনার কাজে প্রধান অংশগ্রহণ করে তাকে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলন বাংলার তথা ভারতের ইতিহাসে অপূর্ব ঘটনা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কলমের খোঁচায় বাংলাদেশ কে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। ফলে তার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং সমগ্র ভারতবর্ষে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
উনিশ শতকে বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত হয়ে আসছিল। একটি ছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা। রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে কংগ্রেসের জন্ম পর্যন্ত এই ধারা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। কংগ্রেস এর উত্তরাধিকারী হয়েছিল। বাংলাদেশের নেতারাই কংগ্রেসের জন্ম থেকে তাতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, বৈকুণ্ঠনাথ সেন, অম্বিকাচরণ মজুমদার, যাত্রামোহন সেন, আনন্দচন্দ্র রায়, কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ প্রভৃতি কংগ্রেসের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। যখন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হল তখন বাংলার এইসব কংগ্রেস নেতারাই সবার আগে আন্দোলনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলার সর্বত্র সভা-সমিতি বক্তৃতা করে জাতিকে সজাগ করে তুললেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল করবার জন্য তাঁরা ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের কাছে তীব্র প্রতিবাদ পত্র পাঠাতে লাগলেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে আর এক দল নেতার আবির্ভাব হয়েছিল। এরা নিয়মতান্ত্রিকতা বা ভিক্ষা-নীতির বিরোধী—আত্মশক্তির সাধক এবং বঙ্কিম-বিবেকানন্দ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যিক ও মনীষীদের ভাবধারার উত্তরাধিকারী। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ধারার একজন অগ্রগামী পথিক। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতিও ছিলেন তাঁর সহযাত্রী। যখন স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হলো তখন এই আত্মশক্তির সাধকেরা সেই আন্দোলনের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। এই নবীন দল বললেন, ওসব আবেদনে কিছু কাজ হবে না, আমাদের জাতীয় শক্তির সাধনা করতে হবে ও তার পরিচয় দিতে হবে, তবেই ইংরেজ কেবল বঙ্গভঙ্গ বাতিল করতে বাধ্য হবে। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে অর্থনৈতিক সংগ্রাম দলের নেতাদের পরিকল্পনা। একদিকে আমাদের স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধার ও প্রচার, অন্যদিকে বিদেশি শিল্প বর্জন বা বয়কট—অর্থনৈতিক সংগ্রামের এই দুইটি উপায় তারা নির্দেশ করলেন। সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বর্জন এবং জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও এই নুতন রাজনৈতিক সংগ্রামের আরেকটি অস্ত্র বলে গণ্য হলো।
নুতন দলের শক্তিশালী নেতা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এই সময় ‘সন্ধ্যা’ নামক বিখ্যাত দৈনিক পত্র প্রকাশ করে এই সমস্ত কথা জোরের সঙ্গে প্রচার করতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে আরও অনেক শক্তিমান ব্যক্তি এসে যোগ দিলেন,—শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা প্রভৃতি। বিপিনচন্দ্র পাল ‘নিউ ইন্ডিয়া’পত্রে জ্বালাময়ীভাষায় নূতন দলের মত প্রচার করতে লাগলেন।
এই সময়ের স্মরণীয় ঘটনা বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের যোগদান। এই অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ যেন যাদুমন্ত্র বলে বাংলার রাজনৈতিক-ক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টিকরলেন। ব্রহ্মবান্ধব ও বিপিনচন্দ্রের নেতৃত্বে যে নুতন শক্তি দেশের মধ্যে জেগে উঠেছিল, শ্রী অরবিন্দ অত্যন্ত সহজভাবেই তার নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। নূতন দল প্রতিষ্ঠিত হল—নব জাতীয়তা আন্দোলনের সৃষ্টি হল। শ্রী অরবিন্দের সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক পত্র ‘বন্দেমাতরম নবীন দলের মুখপত্ররূপে এই নব জাতীয়তা আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করতে লাগল। সে আন্দোলন আর বাংলাদেশের সীমাবদ্ধ থাকলো না-- দেখতে দেখতে তা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ল। মহারাষ্ট্রের লোকমান্য তিলক, পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রায়, মধ্যপ্রদেশের ডাঃ মুঞ্জে নব জাতীয়তা আন্দোলনে যোগদিলেন। বিপিনচন্দ্র দাবি করেছিলেন ‘Full Autonomy’বা ‘পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য’। শ্রী অরবিন্দ আরো স্পষ্ট ভাবে জাতির পক্ষ থেকে দাবি করলেন--Independence বা স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা যে ভিক্ষার পথে লাভ হবে না, তার জন্য আত্মশক্তির সাধনা করতে হবে, এটাও তিনি নির্ভীকভাবে জাতির কাছে প্রচার করলেন। এই সম্পর্কে বন্দেমাতরম-এর ‘Crime of Nationalism’প্রবন্ধ বাংলার জাতীয়আন্দোলনের ইতিহাসেঅমর হয়ে রয়েছে।
স্বদেশী আন্দোলনের শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথ তার তরঙ্গের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ১৯০৫ সালের ২৫শে আগস্ট বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ সেখানে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’পাঠ করেন। ভিড় এত বেশি হয়েছিল যে, বহু লোক টাউনহল প্রবেশ করতে পারেনি। সেই কারণে এক সপ্তাহ পরে আর এক স্থানে সভা করে পুনরায় ওই প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। এরপর প্রায় প্রতিদিনই নানা স্থানে জনসভা হতে লাগলো এবং রবীন্দ্রনাথ বহু সভাতেই যোগদান করে প্রবন্ধ পাঠ বক্তৃতা দিতে লাগলেন। নিত্য নতুন জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ এই সময়েরচনা করতে লাগলেন প্রত্যেক সভাতেই ওই সমস্ত সংগীত গাওয়া হতে লাগল। গোটা দেশ এইভাবে স্বদেশী আন্দোলনে মাতোয়ারা হয়ে উঠল।
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে বলে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে। আর ওইদিনই চিরস্মরণীয় রাখি বন্ধনের উৎসব ধার্য হয়। রবীন্দ্রনাথ,মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সহযোগিতায় এই উৎসবের পরিকল্পনা করেন। সমগ্র বাঙালি জাতি অতি সহজেই এই উৎসব গ্রহণ করেছিল এবং বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এবং তারও পরের কয়েক বছর পর্যন্ত ১৬ই অক্টোবর (৩০ শে আশ্বিন) তারিখে এই উৎসব পুর্নোদ্দমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিশেষ করে এই উৎসবের জন্যই রবীন্দ্রনাথ নিম্নলিখিত এই রচনা করিয়া গিয়াছেনঃ
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ--
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা--
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন--
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥
১৬ই অক্টোবর সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ নিজে গঙ্গার ঘাটে স্নান করে রাখি বন্ধন উৎসব করেছিলেন।
১৬ অক্টোবর (১৯০৫) রাখি বন্ধন উৎসবের পর ফেডারেশন হল গ্রাউন্ডে’বিরাট জনসভা ডাকা হল। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আনন্দমোহন বসু ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন। আনন্দমোহন বসু তখন খুব অসুস্থ। এতৎসত্ত্বেও সেই জাতীয় সংকটের দিনে তিনি দেশমাতৃকার ডাকে রোগশয্যা থেকে উঠে আসলেন।আনন্দমোহন বাঙ্গালী জাতির পক্ষ থেকে ঘোষণা করলেন যে, তাঁরা বঙ্গভঙ্গ ভাগ কখনোই মেনে নেবেন না এবং যতদিন ব্রিটিশ গভর্মেন্টের ঐ আদেশ বাতিল না হয়, ততদিন জাতির সমস্ত শক্তি দিয়ে আন্দোলন চালাবেন। ঐক্যবদ্ধ অখন্ড বাংলার প্রতীকরূপে ফেডারেশন হল বা “মিলন মন্দিরে”র ভিত্তিও ঐদিনআনন্দমোহন স্থাপন করলেন। আনন্দমোহন নিজে তাঁর লিখিত বক্তৃতা পড়ে শোনাতে পারলেন না, দেশপূজ্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পক্ষ থেকে ওই বক্তৃতা রবীন্দ্রনাথ সেই বিরাট সভায় যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি আনন্দমোহন বসুর বক্তৃতা বাঙলায় অনুবাদ করে শোনান। এরপর বাংলা ও ইংরেজিতে জাতীয় সংকল্প বাক্য বা প্রতিজ্ঞা পত্র পাঠ করা হয়। বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত বাঙালি নিরস্ত হবে না এবং তারা কেবল স্বদেশী বই ব্যবহার করবে, কোন বিদেশী দ্রব্য ক্রয় করবে না, এটাই ছিল সংকল্পেরসারকথা। বাংলার সর্বত্র হাজার হাজার সভায় দিনের পর দিন সেই জাতীয় সংকল্প বাক্য পাঠ হয়েছিল। সাধারণত ওইসব সভায় সভাপতি সংকল্প বাক্য বা প্রতিজ্ঞা পত্র পাঠ করতেন, সঙ্গে সঙ্গেসভাস্থ সকলে একই সুরে তা আবৃত্তি করতেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে বহু সভায় জনসাধারণকে জাতীয় সংকল্প বাক্য পাঠকরিয়েছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান নানা দিক দিয়ে অসামান্য। সভা-সমিতিতে বক্তৃতা সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প প্রভৃতির দ্বারা দেশবাসীর মনে যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা তিনি সঞ্চার করেছিলেন তা আমাদের জাতীয় জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাছাড়া আরও দু’দিক দিয়ে স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর দানের প্রাচুর্য বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে। প্রথমত, জাতীয় সংগীত রচনা,দ্বিতীয়ত, জাতীয় শিক্ষা প্রচার। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথকে ‘গানের রাজা’আখ্যা দিয়েছেন। বাস্তবিক সংগীত রচনা রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলাদেশ কেন, সমগ্র পৃথিবীতে অদ্বিতীয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। এত বেশিসংখ্যক এবং এত বিচিত্র ভাব পূর্ণ গান পৃথিবীর অন্য কোন দেশের কোন কবি রচনা করেনি। রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্গীতগুলির মধ্যে আবার জাতীয় সংগীত বাস্বদেশপ্রেমেরগানের সংখ্যা প্রচুর। স্বদেশী যুগে কয়েকশো জাতীয় সংগীত বাংলাদেশের কবিগণ রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে একা রবীন্দ্রনাথের গান সবচেয়ে বেশি। দেশমাতৃকাকে তিনি যে গভীরভাবে ভালোবেসে ছিলেন, জাতীয় আন্দোলনে যেভাবে নিজের মনপ্রাণ কে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন—
সেই প্রেম, সেই আত্মোৎসর্গই সহস্র ধারায় তার গানের মুখে উৎসারিত হয়েছিল। এই সমস্ত গান একদিকে যেমন গভীর দেশপ্রেম, অন্যদিকে তেমনি অপূর্ব উদ্দীপনায় পূর্ণ। স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার সর্বত্র হাজার হাজারজনসভায় হাটে-মাঠে-ঘাটে রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত গান গাওয়া হতো। দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশী ভাবের সঞ্চারে তা যে কতদূর সাহায্য করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাঁর সমগ্র স্বদেশী সঙ্গীতের পরিচয় দেওয়া অসম্ভব, সামান্য কিছু পরিচয় দিতে চেষ্টা করব।
দেশের প্রতি অণু-পরমাণু, তার আকাশ-জল-বাতাস, শ্যামল বনানী, আম্রবনঘেরানদীকূল, নিভৃত পল্লী—সকলের সঙ্গে বাঙালীর অন্তরের যে নিগূঢ় যোগ, যে সমতার বন্ধন—কবি তাঁর অমর সংগীত ‘সোনার বাংলা’য় সেই ভাব অপূর্ব ভাষায় ব্যক্ত করেছেন—
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায়ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায়বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলেকূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলেভাসি॥
অথবা—
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে ॥
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানীর মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে ॥
অন্য এক শ্রেণীর গানে কবি জাতিকে স্বাধীনতার তপস্যায় সর্বস্ব ত্যাগ করতে আহ্বান করেছেন, অত্যাচারীর রক্তচক্ষু, নির্যাতন, নিপীড়ন উপেক্ষা করে নির্ভীক উন্নত শিরে লক্ষ্যপথেএগোবার জন্য প্রেরণা দিয়েছেন।
(১)
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়--
তবে পরান খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে ॥
(২)
তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না ॥
(৩)
এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে,
‘জয় মা’ব’লে ভাসা তরী ॥
(৫)
আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না ॥
তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে--
তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না ॥
(৬)
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা!
আমি তোমার চরণ--
মা গো, আমি তোমার চরণ করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা ॥
(১)
দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী
আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি।
দিন আগত ওই, ভারত তবু কই?
সে কি রহিল লুপ্ত আজি সব-জন পশ্চাতে?
লউক বিশ্বকর্মভার মিলি সবার সাথে।
প্রেরণ কর’ ভৈরব তব দুর্জয় আহ্বান হে, জাগ্রত ভগবান হে ॥
স্বদেশী আন্দোলনের সময় এর সাথে যে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’ হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বিজাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহরূপেই এই ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন’দেখা দিয়েছিল। যে শিক্ষা প্রণালী সঙ্গে আমাদের মাতৃভূমির যোগ নেই, আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে যা বিচ্ছিন্ন, সর্বোপরি যা সম্পূর্ণরূপে সরকারি নীতির নিয়ন্ত্রণাধীন, সে শিক্ষা কখনোই জাতির মনুষ্যত্বকে উন্মোচন করতে পারে না। অতএব পুরোপুরি আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আমাদের জাতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে শিক্ষানীতি চালু করতে হবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এটাই ছিল সংক্ষেপে ‘জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে’র মূল কথা। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মনস্বী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, আশুতোষ চৌধুরী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শ্রী অরবিন্দ ঘোষ এই আন্দোলনের মূলে ছিলেন। রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক এবং মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তারকনাথ পালিত এই আন্দোলনের জন্য প্রচুর অর্থ দান করেন এবং তাদেরই অর্থ সাহায্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রথমে যখন অপেক্ষাকৃত সামান্য পুঁজি নিয়ে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত এবং জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, তখন কয়েকজন ত্যাগী, নিঃস্বার্থ ব্রতী কর্মীই তাকে ধাত্রীর ন্যায় পালন করেছিলেন। এদের মধ্যে আচার্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার, অরবিন্দপ্রকাশ ঘোষ, শ্রীযুত প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায় (বর্তমানে সন্ন্যাসী), ডাঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, কুমুদনাথ লাহিড়ী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শ্রী অরবিন্দও কিছুকাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই এই জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথম যখন জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ গঠিত হয়, তখন তিনি বিশেষ উৎসাহসহকারে তাতে যোগ দিতেন। এমনকি জাতীয় বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকা নির্বাচন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রচনা প্রভৃতি কাজেও তিনি অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক, কিছুদিন পরে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হ্রাস পায়। সম্ভবত জাতীয় শিক্ষার সম্বন্ধে তাঁর নিজের আদর্শ ও পরিকল্পনা তাতে সম্পূর্ণ সার্থক হয়েওঠেনি। তিনি এর আগেব্রহ্মবান্ধবউপাধ্যায়েরসহযোগিতায়বোলপুর শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাকেই নিজের আদর্শ অনুসারে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে গড়েতুলবারকাজেআত্মনিয়োগ করেন।
কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সম-মতাবলম্বীদের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও প্রাচীন ও নবীন দলের মধ্যে ভেদ ক্রমশ বাড়তে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত কোনও কোনও দিক দিয়ে তা মর্মান্তিক হয়ে উঠল। “নরমপন্থী” (মডারেট) ও “চরমপন্থী” (একস্ট্রিমিস্ট) বলে দু’দলের নামকরণও হয়ে গেল। কংগ্রেস কমিটির সভায়, নানাস্থানে জনসভায়, নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের কলহ ও বাগবিতণ্ডা চলল। চরমপন্থীরা দলে ভারী, দেশের যুবক সম্প্রদায় তাদের সমর্থক, সুতরাং নরমপন্থীরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারলো না। শুধু বাঙলায় নয়, ভারতের সব প্রদেশেই বিশেষত মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও মধ্যপ্রদেশে নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে উঠল। অবশেষে ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে এই দ্বন্দ্ব প্রবলভাবে দেখা দিল। প্রবীণ নরমপন্থীরা ডাঃ রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি মনোনীত করেছিলেন, কিন্তু নবীন চরমপন্থী দল তা মেনে নিলেন না, তারা সেই স্থানে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলকের নাম প্রস্তাব করলেন। ফলে সুরাট কংগ্রেসে “দক্ষযজ্ঞ” হল, কংগ্রেসের অধিবেশন পণ্ড হয়ে গেল। প্রবীণ নরমপন্থীরা এলাহাবাদে ফিরে গিয়ে বৈঠক করলেন এবং নবীন দলকে কংগ্রেস থেকে বাহির করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তার ফল ভাল হল না,—কয়েক বছরের মধ্যে নবীন দলই বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেসে প্রাধান্য স্থাপন করলেন এবং প্রবীণ দলই কংগ্রেস থেকে সরে গিয়ে “লিবারেল ফেডারেশন” গঠন করতে বাধ্য হলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই এইসব দ্বন্দ্ব-কোলাহল থেকে দূরে থাকতেন। সুরাট কংগ্রেসের পর তিনি ধীরে ধীরে প্রকাশ্য রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে আরও দূরে সরে গেলেন। কিন্তু নবীন দলের প্রতি তার আন্তরিক প্রীতি কমেনি। নবীন দলের নেতা শ্রীঅরবিন্দ একদিকে তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। শ্রী অরবিন্দকে তিনি কেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, “অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার”কবিতায়তার অক্ষয় নিদর্শন তিনি রেখেগেছেন।
১৯০৮ সালে পাবনায়বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সের যেঅধিবেশন হয়, রবীন্দ্রনাথ তাতে সভাপতি নির্বাচিত হন। নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের মধ্যে একটা মিলন সাধনেরজন্যই রবীন্দ্রনাথকে এই অধিবেশনের সভাপতি করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও ওইভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এটাবলতে গেলে, তার প্রকাশ্য রাজনীতিতে যোগদানের শেষ দৃষ্টান্ত। এর পর তিনি প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে সরেআসেন।
১৯০৮সালের পর রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলন থেকেঅন্তরালে সরে গেলেন এবং গঠনমূলক কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন। তার আগে ১৯০৭ সালেই “ব্যাধি ও প্রতিকার” প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন-“দেশের যে সকলযুবক উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছেন, তাদের প্রতি একটি মাত্র পরামর্শ এই আছে,—সমস্ত উত্তেজনাকে নিজের অস্থিমজ্জার মধ্যে নিস্তব্ধভাবে আবদ্ধ করিয়া ফেল, স্থির হও, কোনো কথাবলিও না, অহরহ অত্যুক্তি প্রয়োগের দ্বারা নিজের চরিত্রকেদুর্বল করিও না। আর কিছু না পার খবরের কাগজের সঙ্গেনিজের সমস্ত সম্পর্ক ঘুচাইয়া যে কোনো একটি পল্লীরমাঝখানে বসিয়া, যাহাকে কেহ কোনোদিন ডাকিয়া কথা কহে নিতাহাকে জ্ঞান দাও, আনন্দ দাও, আলো দাও, তাহার সেবা কর,তাহাকে জানিতে দাও, মানুষ বলিয়া তাহার মাহাত্ম্য আছে—সেজগৎ সংসারের অবজ্ঞার অধিকারী নহে। অজ্ঞান তাহাকেনিজের ছায়ার কাছেও স্তব্ধ করিয়া রাখিয়াছে; সেই সকলভয়ের বন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহার বক্ষপট প্রশস্ত করিয়া দাও, তাহাকে অন্যায় হইতে, অনশন হইতে, অন্ধ সংস্কার হইতে রক্ষাকরো”।
রবীন্দ্রনাথ পাবনা সম্মিলনীতে গঠনমূলক কাজের ধারা নির্দেশ করলেন ঠিকই, কিন্তু নিজে কয়েক বছর পর্যন্ত সে দিকে তেমন মনোনিবেশ করেন নি। কাব্য ও সাহিত্যসৃষ্টির আনন্দের মধ্যেই তিনি ডুবে গেলেন, ইউরোপে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য সমাজের সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করলেন এবং “নোবেল পুরস্কার” লাভ করলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে কিছুদিন পরে তিনি তাঁর গঠনমূলক স্বদেশ সেবার আদর্শ কাজে পরিণত করতে প্রবৃত্ত হলেন। ১৯১৪ সালে এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি “শ্রীনিকেতন” স্থাপন করলেন। “শান্তিনিকেতন” আগেই স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়েতার আদর্শ কাজে পরিণত করার পথে নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে লাগল। বোধহয় এই কারণে ১৯১৫ সালে ‘বঙ্গীয় হিত সাধনমণ্ডলী’ (Bengal Social Service League) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সভাপতি রূপে তাতে যোগ দিলেন এবং নিজের আদর্শ ও কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা করে কয়েকটি বক্তৃতা দিলেন। ‘বঙ্গীয় হিত সাধনমণ্ডলী’র কার্য পদ্ধতি তিনি নিজে নির্ধারিত করে দেন। তাতে ছিল—
(১) নিরক্ষরদিগকে অন্তত যৎসামান্য লেখাপড়া ও অঙ্ক শেখানো।
(২) ছোট ছোট ক্লাস ও পুস্তিকা প্রচার দ্বারা স্বাস্থ্যরক্ষা,সেবা শুশ্রুষাদি সম্বন্ধে শিক্ষাদান।
(৩) ম্যালরিয়া, যক্ষ্মা, নানা বিধ অজীর্ণ ও উদরাময় রোগ প্রভৃতির প্রতিষেধের জন্য সমবেত চেষ্টা।
(৪) শিশুমৃত্যু নিবারণের উপায় নির্ধারণ ও অবলম্বন।
(৫) গ্রামে উৎকৃষ্ট পানীয় জলের ব্যবস্থা।
(৬) গ্রামে গ্রামে যৌথঋণদান সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও দরিদ্র লোকদিগকে উহার উপকারিতা প্রদর্শন।
(৭) দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মড়ক প্রভৃতির সময়েদুঃস্থদিগকে বিবিধ প্রকারে সাহায্য।
এইভাবে কবির সকল উদ্যম আয়োজন ব্যর্থ হল, কিন্তুএতে তিনি নিরাশ ও ভগ্নোৎসাহ হলেন না। শান্তিনিকেতন বিশেষ করে শ্রীনিকেতনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পল্লীসংগঠন নীরব কর্মসাধনার আদর্শ বাস্তবে পরিণত করতে দ্বিগুণ উৎসাহে উদ্যত হলেন। বলতে গেলে, ১৯১৬ সাল থেকে আরম্ভ করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতননিয়েই ছিলেন। গ্রামের স্বাস্থ্য সংস্কার, পল্লী শিল্পের পুনরুদ্ধারও প্রসার, লোকশিক্ষা বিস্তার, সমবায় সমিতি গঠন—এই সবইছিল শ্রীনিকেতনের লক্ষ্য।
১৯০৮ সালের পর থেকে রবীন্দ্রনাথ কোনও প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেন নি। একথা আগেই বলেছি। কিন্তু সেভাবে যোগ না দিলেও তিনি একেবারে তার সংস্পর্শ এড়াতে পারেন নি। দেশের ও জাতির স্বার্থরক্ষার জন্য যখনইতাঁর সাহায্যের দরকার পড়েছে, তখনই তিনি সেডাকেসাড়া দিতে কার্পণ্য করেন নি, কয়েকটি প্রধান প্রধান দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯১৬ সালে কলিকাতায় কংগ্রেসের যে অধিবেশন ডাকা হয়, তাতে চরমপন্থী ও নরমপন্থী দলের মধ্যে আবার বিবাদ বেধে উঠে। চরমপন্থী বানবীন জাতীয়তাবাদী দল প্রস্তাব করেন যে, মিসেস অ্যানি বেশান্তকে ঐ অধিবেশনের সভানেত্রী করা হোক। মিসেস বেশান্ত তারই কিছু আগে “হোমরুল আন্দোলনে”র জন্য বিনাবিচারে অন্তরীণ হয়েছিলেন। নরমপন্থী মডারেট দলের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি মিসেস বেশান্তের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন। এই সময়ে চরমপন্থী বা নবীনজাতীয়তাবাদী দলের মুখপাত্র স্বরূপ ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল ঘোষ, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, মৌলবী ফজলুল হক, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথও এঁদের সঙ্গে মিসেস বেশান্তকেই সভানেত্রী রূপে বরণ করবার প্রস্তাব দেন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ নিয়ে ঐরূপ মতবিরোধ হয়েছিল। সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ মডারেটগণ বহরমপুরের প্রখ্যাতনামা বৈকুণ্ঠনাথ সেনকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি পদে নির্বাচিত করতে চান। কিন্তু নবীন জাতীয়তাবাদী দল এতে সম্মত হলেন না। তারা রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করলেন। রবীন্দ্রনাথও তাতে সম্মত হলেন। এভাবে দুই দলে মতভেদ হয়ে উঠল, তখন সৌভাগ্যক্রমে একটা আপোষের ব্যবস্থা হল। মডারেট দল মিসেস অ্যানি বেশান্তকে সভানেত্রী রূপে স্বীকার করে নিলেন। রবীন্দ্রনাথও শেষ মুহূর্তে বৈকুণ্ঠনাথ সেনের অনুকূলে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ ত্যাগ করলেন। কলিকাতার কংগ্রেসের অধিবেশন সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হল। রবীন্দ্রনাথ এই অধিবেশনে যোগদেন এবং “জাতীয় প্রার্থনা” পাঠ করেন।
১৯১৯ সালে রাউলাট আইনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে তুমুল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ নববৎসরের দিন—অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি বর্ষিত হয়। বহুলোক হতাহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রথমত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে পারেনি। জননায়কগণও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথমে এই নৃশংস ব্যাপারের প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি বড়লাটকে একখানি পত্র লিখে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ও পাঞ্জাবের সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন এবং গভর্ণমেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতার অভ্যন্তরীণ কদর্যমূর্তির স্বরূপ প্রকাশকরে রবীন্দ্রনাথ বলেনঃ “এই বিদেশীয় সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কি অপহরণ করেছে তা জানি। সে তার পরিবর্তে দণ্ড হাতে স্থাপন করেছে যাকে নাম দিয়েছে Law and Order—বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিষ, যাদারোয়ানি মাত্র। পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিযানের প্রতি শ্রদ্ধারক্ষা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারেতার কৃপণতা এই ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করেদিয়েছে।”
...উপসংহারে গভীর ক্ষোভ ও বেদনার সঙ্গে কবি বললেনঃ
“ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে, না কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। একাধিক শতকের শাসন ধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিসহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে! জীবনের প্রথম আরম্ভে, সমগ্র মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে যে আসবে, মানুষের চরমআশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তৃপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে, বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি”।
এই কথা আজ ব’লে যাব প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে—নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে—
“অধর্মেণৈধতেতাবৎ ততোভদ্ৰাণিপশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্জয়তিসমূলস্তুবিনশ্যতি।”
কবি তাঁর এই শেষবাণীতে যে মর্মান্তিক সত্য ব্যক্ত করেছেন, নির্মম নিয়তির মত তাই যে বর্তমান মানবসভ্যতার পরিণাম নির্দেশ করছে সে বিষয়ে কে সন্দেহ করবে!
.....।
লেখক: রাষ্ট্রপতি-পুরস্কার ও শিক্ষারত্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক ও রবীন্দ্র গবেষক


