আদিম মানুষ মনে করত নারীর মধ্যে এক রহস্যময় শক্তি বা ক্ষমতা আছে, নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব - ১৯

আদিম মানুষ মনে করত নারীর মধ্যে এক রহস্যময় শক্তি বা ক্ষমতা আছে, নারী পাচার যুগে যুগে: পর্ব - ১৯
সুখেন্দু হীরা
মানুষ সর্বপ্রথম প্রকৃতির পূজা করত। এই প্রকৃতিপূজার কারণ প্রাকৃতিক শক্তির পরাক্রম দেখে ভীত হওয়া। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, বজ্রপাত অগ্নিদাহ, এইসব প্রাকৃতিক শক্তির কাছে মানুষ কত ক্ষুদ্র, কত অসহায়। তাই বলা যায় মানুষ প্রকৃতিপূজার মধ্যে দিয়ে মানুষ শক্তিপূজাই করেছে।
আদিম মানুষ মনে করত নারীর মধ্যে এক রহস্যময় শক্তি বা ক্ষমতা আছে। কারণ সে জীব সৃষ্টি করতে পারে অর্থাৎ জন্ম দেয়। এই কারণে সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ মাতৃদেবতা বা নারীদেবতার পূজা করত। বৃহত্তর ভারতে আর্যেতর লোকেরা নানা দেবীর পূজা করত। আর্যরা ভারতে এসে এইসব দেবীদের আপন করে নিল। তাদের রচিত বৈদিক সাহিত্য, বেদ পরবর্তী পুরাণ, ও অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যে এইসব দেবীদের তাঁদের আরাধ্যা মহাদেবীর অংশ রূপে প্রচার করল।
এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, স্কন্দ পুরাণে মহাদেবী বলেছেন - সমস্ত দেবী আমার রূপ বলে জানবে এর কোন অন্যথা নেই। নারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে - সেই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা সর্বশক্তি স্বরূপা, পরমাত্মা কৃষ্ণের তিনি পরমা বুদ্ধি স্বরূপিনী, স্বর্গে দেবরাজের নিকেতনে তিনি সম্পদরূপা, তিনি স্বর্গলক্ষ্মী রূপিণী। মর্তে রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী, প্রতিগৃহে গৃহলক্ষী, আর সর্বত্র গ্রামে গ্রামে পৃথক পৃথক গ্রাম দেবতা।
আর্যদের আগে বৃহত্তর ভারতবর্ষে ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। আর্যরা ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তাই বেশিরভাগ প্রকৃতিদেবতা হয়ে গেলেন পুরুষ। শুধু তাই নয় নারীদেবতা বা শক্তি দেবতাকে কোনও না কোনও পুরুষ দেবতার স্ত্রী বানিয়ে দেওয়া হল। পুরাণে বলা হল দেবতাদের নিজ নিজ শক্তি আছে। এঁরা নিজেদের দেবগনের অংশভূতা। প্রয়োজন মতো এঁরা দেব তেজ থেকে উদ্ভব হয়ে নিজে নিজ দেবগনকে সাহায্য করেন। অথচ ঋকবেদে দেবী সূক্তে বলা আছে - আমি কারণরূপে বিশ্বভূষণের উৎপত্তি স্থল এবং আমি স্বয়ং বিশ্বভূবনরূপে বর্তমান, বায়ুর মতো সহজে আমি বিশ্বের মধ্যে বিচরণ করি, ব্রহ্মচৈতন্য রূপে আমি আকাশকে ছাড়িয়ে রয়েছি, এই পৃথিবীকেও ছাড়িয়ে রয়েছি।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাস্ত্র রচনার মধ্যে দিয়ে দেবী মহিমাকে খর্ব করা হয়েছে। ঋকবেদের পরবর্তী যুগ থেকেই ক্রমশ এই পরিবর্তন চোখে পড়ে। ঋকবেদে পিতৃদেবতা রূপে রুদ্রের কথা বলা আছে, আর অদিতির মধ্যে জগজ্জ্ননীর দর্শন পাওয়া গেছে। রুদ্র বেদের যুগেই শিব নামে পরিচিত হতে শুরু করেন।
বেদে অনেক নারী দেবতার উল্লেখ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অদিতি। ঋকবেদে বলা আছে অদিতি দ্যৌ (আকাশ) অদিতি অন্তরীক্ষ (সমুদ্র), অদিতি মাতা, পিতা, পুত্র, সমস্ত দেবতা অদিতি, পঞ্চজন অদিতি, যা জাত তা অদিতি, যা জন্মাবে তা ও অদিতি। সেই অদিতি পুরাণে এসে হয়ে গেলেন দক্ষের কন্যা, শিবের পত্নী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বৃহত্তর ভারতে যে শক্তিপীঠ গুলি আছে, সেগুলো আসলে প্রত্যেকটি লৌকিক দেবী বা জনপ্রিয় গ্রামদেবী। এগুলোকে সব মহাদেবীর অংশ বলে প্রথমে আর্যায়ণ করা হল; শুধু তাই নয় প্রত্যেকটি স্থানে একজন করে ভৈরব ঢুকিয়ে দেওয়া হল। যেমন কামাখ্যায় ভৈরবের নাম 'উমানন্দ', বারাণসীতে 'কাল', বর্ধমানের যুগাদ্যায় 'ক্ষীরখণ্ডক'। সতীপীঠ বা শক্তিপীঠগুলোর অধিকার পুরুষতান্ত্রিক আর্যসমাজ নারী দেবতাদের পুরোপুরি ছেড়ে দিল না।
ধর্মীয় সাহিত্য যত অগ্রগতি হয়েছে, ক্রমশঃ তত নারী দেবতাদের মহিমাকে পুরুষ দেবতাদের অভিপ্রায় বলে চালানো হয়েছে, স্ত্রী দেবতাদের প্রত্যেককে স্বামী নির্ধারণ করে পুরুষের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, নারীদের জগতকে ক্রমশঃ সংকুচিত করেছে সমাজ। শুধু হিন্দু ধর্মশাস্ত্র নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র গুলোতেও এই পরিবর্তন পরিষ্কার বোঝা যায়।
জৈন ধর্মের প্রচারকরা প্রত্যেকে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন। তাঁদের দেবত্ব আরোপ করার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তীকালে তাদের অধীনে নারী দেবতাদেরও দেয়া হয়েছে। জৈন সাহিত্যে চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের প্রত্যেকের একজন করে শাসন দেবী আছেন। শ্বেতাম্বর ধর্মমতে এরা হলেন -১. চক্রেশ্বরী, ২. অজিতবলা, ৩. দুুরিতারি, ৪. কালিকা, ৫. মহাকালী, ৬. শ্যামা, ৭. শান্তা, ৮.জ্বালা, ৯. সুতারকা, ১০. অশোকা, ১১. শ্রীবৎসা, ১২. চণ্ডা, ১৩. বিজয়া, ১৪. অঙ্কুশা, ১৫. পন্নগা, ১৬. নির্বানী, ১৭. বলা, ১৮. ধরিনী, ১৯. ধারনপ্রিয়া, ২০. নরদত্তা, ২১. গান্ধারী, ২২. অম্বিকা, ২৩. পদ্মাবতী, ২৪. সিদ্ধি-দায়িকা।
দেখা যাচ্ছে সনাতন হিন্দু ধর্মের অতি পরিচিত দেবীর নাম এই তালিকায় আছে। জনপ্রিয় লৌকিক বা হিন্দু দেবীদের জৈন আচার্যরা উপেক্ষা করতে পারেনি।
গৌতম বুদ্ধ পূজা অর্চনার বিরূদ্ধতা করলেও পরবর্তীকালে বৌদ্ধ শ্রমণরা, দেবদেবী পূজাকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারেননি। মহাযান বৌদ্ধরা নিজেদের মতকে জনপ্রিয় করার জন্য লোকায়ত দেবদেবীদের স্বীকার করে নেন। তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতে স্ত্রীদেবতা তিন প্রকারের। দেবী, শক্তি ও ডাকিনী।
দেবীদের এককভাবে দেখা যায়। যেমন 'তারা'। শক্তিদের সাধারণত যে দেবের শক্তি, তাকে সেই দেবের সঙ্গে যুগবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। যেমন শ্যামাতারা ইনি অবলোকিতেশ্বরের শক্তি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারী শক্তি বা মাতৃ শক্তিকে দেবত্ব আরোপ করেও তাকে পুরুষদের অধীনে নিয়ে এসেছে। এভাবে নারী জাতির মনোবল কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যত মানসিক শক্তি হ্রাস পাবে, তত লড়াই করার মানসিকতা কমবে, মানুষ দুর্বল হবে। আর দুর্বল নারীতো পাচারের আদর্শ পণ্য।
তথ্য ঋণ:
১) শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড): উপেন্দ্রকুমার দাস (রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, গোলপার্ক)
২) পৌরাণিক অভিধান: সুধীরচন্দ্র সরকার (এম. সি. সরকার এন্ড সন্স প্রাঃ লিঃ)


