'প্রভাবতী সম্ভাষণ' বিদ্যাসাগরের আঁধার ঘরের গোপন জাগপ্রদীপ

'প্রভাবতী সম্ভাষণ' বিদ্যাসাগরের আঁধার ঘরের গোপন জাগপ্রদীপ
26 Sep 2023, 11:00 AM

'প্রভাবতী সম্ভাষণ' বিদ্যাসাগরের আঁধার ঘরের গোপন জাগপ্রদীপ

 

সত্যব্ৰত দোলই

 

লেখক লেখেন অপরে পড়বে বলে। শিল্পী গান করেন অপরে শুনবে বলে। নিজের অনুভূত ভাব বা আবেগ অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলার। ভাষায়, সুরে, ইজেলে প্রকাশের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অপরের কাছে নিজেকে মেলে ধরা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। সাহিত্যে এমন রচনাও আছে যা লেখক লিখেছেন সম্পূর্ণ নিজের জন্যে, যা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত রচনা, পাঠকের জন্য নয়। তেমনই একটি একান্ত ব্যক্তিগত রচনা হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে বিদ্যাসাগর নিবন্ধটি লিখেছিলেন। কিন্তু কোথাও কখনও এই নিবন্ধ ছাপেন নি। কারণ এই নিবন্ধ তিনি পাঠকদের জন্য লেখেননি। লিখেছিলেন একান্তভাবে নিজের জন্যে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর নাতি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি 'সাহিত্য' পত্রিকায় (১২৯৯ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) বিদ্যাসাগরের এই অপ্রকাশিত রচনাটি প্রকাশ করেন।

'প্রভাবতী সম্ভাষণ' রচনার মূলে আছে একটা করুণ মধুর ইতিহাস। বিদ্যাসাগর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে থেকেছেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি বাদুড়বাগানে নিজের দু'তলা বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করেন। ইতিপূর্বে অন্তত ন'জায়গায় ন'টি বাড়িতে বসবাস করেছেন। বউবাজারে হৃদয়রাম ব্যানার্জীর বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন। সেখানেই হৃদয়রাম ব্যানার্জীর নাতি রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। রাজকৃষ্ণবাবুর পরিবারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে তিনি ঐ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাট চুকিয়েছেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিয়েছেন। সে সময় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে গিয়ে তাঁর চরম অভিজ্ঞতা হল। সরকার জানিয়ে দিল বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের খরচ তারা দেবে না। অন্যদিকে কেউ বিধবা বিবাহ করলে বিবাহের খরচ বিদ্যাসাগর নিজে দেবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন। অনেক সদাশয় ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে তারা বিদ্যাসাগরের পাশে থাকবেন। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, আর্থিক সাহায্য তো দূরের কথা, তারা কেউ ভুলেও খোঁজ পর্যন্ত নিলেন না। বিদ্যাসাগরের নিজের পরিবারের ভিতরেও সে সময় নানা সংকট ঘনিয়ে উঠেছিল। পরিবারের সকলের প্রতি তাঁর কর্তব্য যথারীতি পালন করলেও মনে মনে ক্রমশ তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে এক চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, "তুমি এখানকার বৃত্তান্ত কিছুই জাননা... আমার আত্মীয়রা আমার পক্ষে বড় নির্দয়, সামান্য অপরাধ ধরিয়া অথবা অপরাধ কল্পনা করিয়া আমাকে নরকে নিক্ষিপ্ত করিয়া থাকেন।" বাইরে ভিতরে সে সময় বিদ্যাসাগর মানসিক ভাবে ক্ষত-বিক্ষত। তাঁর মন তখন খুঁজছে কোমল নিভৃত নীড়, যা হবে শান্তির, সৌন্দর্যের, মাধুর্যের। বিদ্যাসাগর সেটাই খুঁজে পেয়েছিলেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তব আতিথ্যে। আর বিদ্যাসাগরের ব্যাথাতুর জীবনে পরম আশ্রয় হয়ে উঠেছিল রাজকৃষ্ণবাবুর অনধিক তিন বছরের শিশুকন্যা প্রভাবতী।

প্রভাবতীর জন্ম ১৭৮২ শকাব্দের ২৩ মাঘ। বিদ্যাসাগর প্রভাবতীকে অপত্য স্নেহে ভালবাসতেন। আধো আধো গলায় কী চমৎকার কথা বলত প্রভাবতী। বিদ্যাসাগরকে ডাকত 'ভচ্চে' বলে। 'নে না' বলতে পারত না প্রভাবতী, বলত 'নী না'। 'গুলো' বলতে পারত না, বলত 'শোলো'। কতদিন তার সঙ্গে ঝগড়া করেছেন বিদ্যাসাগর। সেই মধুর ঝগড়া আহ্লাদ করে দেখবার মতো। প্রভাবতীর বড় ভয়। সাহস করে কখনো গাড়ি চড়তে পারেনি। প্রভাবতীকে কোলে করে বিদ্যাসাগর সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছেন, প্রভাবতী বিদ্যাসাগরের পুতনি ধরে সাবধান করে দিচ্ছে- নাফাসনি, পড়ে যাব । বিদ্যাসাগর ঠাট্টা করে বলছেন- না, আমি লাফাব। অমনি মায়ের দিকে মুখ ফেরাল প্রভাবতী। বলল- দেখদিখি মা, আমার কথা শোনে না। দাদারা মাঝে মাঝে প্রভাবতীকে ঠাট্টা করে বলত-ভচ্চে আর তোমায় ভালোবাসবেন না। সে-ঠাট্টা বুঝতে পারত না প্রভাবতী। তার ভয় হত। ভচ্চে যদি আর না ভালোবাসে! আশ্চর্য সুন্দর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে প্রভাবতী বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞেস করত ভাল বসবি, ভাল বসবি। বিদ্যাসাগর বলতেন- ভালোবাসব। একদিন বিদ্যাসাগর সেকথা বললেন না। সেদিন বাইরের বারান্দায় বসে আছেন বিদ্যাসাগর। বাড়ির ভেতরের নিচের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে প্রভাবতী বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। বিদ্যাসাগর সেদিন প্রভাবতীকে বারবার বলতে লাগলেন আর ভালোবাসব না। প্রভাবতীও বারবার বলল না, ভাল ববি। কিন্তু বিদ্যাসাগর সেদিন কিছুতেই 'ভালোবাসব' বললেন না। প্রভাবতী এতে দুঃখ পেল। ভচ্চে কিছুতেই আর ভালোবাসবে না ? সুন্দর মধুর গলায় প্রভাবতী বিদ্যাসাগরকে বলল- তুই ভাল ববিনি, আমি ভাল বসবো। 'খাব খাব' বলে বিদ্যাসাগর কতদিন ব্যস্ত করেছেন প্রভাবতীকে। বিদ্যাসাগর প্রভাবতীকে অপত্য স্নেহে চুম্বন দিতে চান। 'এই খা' বলে ডান গাল বাড়িয়ে দিয়েছে প্রভাবতী। 'খাব না' বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিদ্যাসাগর। এইভাবে প্রভাবতীর সঙ্গে কত না খুনসুটি করতেন বিদ্যাসাগর।

বছর তিনেকের ফুটফুটে ফুলের মতো শিশু প্রভাবতীর হঠাৎ অসুখ করল। তার দারুণ জলপিপাসা পায়। কিন্তু চিকিৎসকের নিষেধ বেশি জল খাওয়া যাবে না। ওষুধ খাওয়ার পর একটুখানি জল দেওয়া হত প্রভাবতীকে। কিন্তু সে আরও জল খেতে চায়। পিপাসার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠত প্রভাবতী। আকুল হয়ে করুণ চোখে বিদ্যাসাগরের কাছে ডাল চাইত। বিদ্যাসাগর জল দিতে পারতেন না। নানা কথায় তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। হায়। তখন যদি বিদ্যাসাগর ঘুণাক্ষরেও জানতেন যে প্রভাবতীর আয়ু শেষ হয়ে আসছে, তাহলে পিপাসার যন্ত্রণায় প্রভাবতীকে কিছুতেই অস্থির হতে দিতেন না। নিশ্চয়ই প্রাণ ভরে জল খেতে দিতেন।

১৭৮৫ শকাব্দের ৪ ফাল্গুন মাত্র ৩ বছর ১১ দিন বয়সে প্রভাবতী মারা গেল। প্রভাবতী নেই। প্রভাবতা নেই। বিদ্যাসাগর স্থির হয়ে বসতে পারেন না। খেতে পারেন না। ঘুমাতে পারেন না। মনে এতটুকু সুখ নেই। বিদ্যাসাগর খেতে বসেন। কতদিন গেছে চোখের জলে খাবার নষ্ট হয়ে গেছে। একা-একা যখন বিদ্যাসাগর বসে থাকেন, প্রভাবতীর কথা ভাবতে-ভাবতে চোখের জলে দশদিক ভেসে যায়। দিনের বেলা ঘুম এসেছে বিদ্যাসাগরের চোখে। স্বপ্নে দেখলেন প্রভাবতীকে। স্বপ্নের মধ্যে পরম স্নেহে কোলে নিলেন প্রভাবতীকে, স্বপ্নের মধ্যে প্রভাবতীকে স্নেহ-চুম্বন দিতে যাচ্ছেন- এমন সময় কে একজন এসে বিদ্যাসাগরের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। আহা, এমন স্বপ্ন ভেঙে গেল। বিদ্যাসাগরের এ-দুঃখ কাউকে বলে বোঝানোর নয়। প্রভাবতী মারা গেলেও বিদ্যাসাগরের মনের মধ্যে সে সারাক্ষণ বেঁচে ছিল। সংসার-জীবনে ক্ষত-বিক্ষত বিদ্যাসাগরের কাছে প্রভাবতী হয়ে উঠেছিল পরম আশ্রয়স্বরূপ।

প্রভাবতীর মৃত্যুর ১ মাস ২৭ দিনের মাথায় ১৭৮৬ শকাব্দের ১ বৈশাখ বিদ্যাসাগর একটি একান্ত ব্যক্তিগত রচনা লিখলেন- 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। বিদ্যাসাগর হারাতে চাননি প্রভাবতীকে। প্রভাবতীর সাথে তাঁর স্নেহশীতল মাধুর্য নিষিক্ত সম্পর্কের স্মৃতি বিদ্যাসাগর জাগপ্রদীপের মতো জ্বেলে রাখতে চেয়েছিলেন। 'প্রভাবতী সম্ভাষণ বিদ্যাসাগরের আঁধার ঘরের সেই গোপন জাগপ্রদীপ। 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' সম্পর্কে 'সাধনা'-য় (১২৯৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা) রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ “স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় রচিত এই প্রবন্ধটি পাঠ করিলে হৃদয় করুণারসে আর্দ্র না হইয়া থাকিতে পারে না।’’

বিদ্যাসাগর 'প্রভাবতী সম্ভাষণ শুরু করেছেন প্রায় বিলাপের ভাষায়- "বংসে প্রভাবতী! তুমি দয়া, মমতা ও বিবেচনায় বিসর্জন দিয়া, এ জন্মের মত, সহসা সকলের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইয়াছ। কিন্তু আমি অনন্যচিত্ত হইয়া, অবিচলিত স্নেহভরে তোমার চিন্তায় নিরন্তর এরূপ নিবিষ্ট থাকি যে, তুমি এক মুহূর্তের নিমিত্ত, আমার দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতে পার নাই।..." এরপর প্রভাবতীর শিশুসুলভ স্নেহরসার্স আচরণের নারকম মুহূর্ত ভঙ্গির স্মৃতিচিত্র এঁকেছেন বিদ্যাসাগর যেন' দিয়ে

 

“ যেন, তুমি বসিয়া আছ, আমায় অন্যমনে চলিয়া যাইতে দেখিয়া, 'নীনা' বলিয়া, করপ্রসারণপূর্বক, কোলে লইতে বলিতেছ।”

 

“ যেন, তুমি উপরের জানালা হইতে দেখিতে পাইয়া, আয় না বলিয়া, সলীল করসঞ্চালন সহকারে, আমায় আহ্বান করিতেছ।"

 

“যেন, 'এই আমি এসেছি বলিয়া প্রফুল্লনে, আমার ক্রোড়ে উপবেশন করিতেছ।”

 

যেন তুমি, আমার ক্রোড়ে বসিয়া... আমার জানুতে মন্ত্রক বিন্যস্ত করিয়া শয়ন করিতে "যেন, আমি আহারান্ত্রে আসন হইতে উদিত হইবা মা, তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতেছ,

 

যেন.... আমি মুখে সুপারী নিবা মাত্র, তুমি সুধুনি দে' বলিয়া, আঙ্গুলি দ্বারা, আমার মুখ হইতে সুপারী বহিষ্কৃত করিয়া লইতেছ। "

“ যেন তুমি বাহিরে আসিবার নিমিত্ত, আমার ক্রোড়ে আরোহন করিয়াছ এবং সিঁড়ি হইতে নামিবার পূর্বক্ষণে আমার চিবুকধারণ পূর্বক, আকুলচিত্তে বলিতেছ, 'নাফাসনি, পড়ে যাব। ”

 

“ যেন.... পাছে আমি আর না ভালবাসি, এই আশঙ্কায় আকুল চিত্ত হইয়া, 'ভাল ববি, ভাল ববি' এই কথা... বারংবার বলিতেছ।”

 

“ যেন, আমি খাব খাব বলিয়া, তোমার মুখ চুম্বনের নিমিত্ত, আগ্রহ প্রদর্শন করিতেছি। তুমি 'এই খা' বলিয়া ডাইনের গোল ফিরাইয়া দিতেছ। "

 

ব্যাথাতুর হৃদয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “বৎসে। তোমার কিছুমাত্র দয়া ও মমতা নাই। যখন তুমি, এত সত্বর চলিয়া যাইবে বলিয়া, স্থির করিয়া রাখিয়াছিলে, তখন তোমার সংসারে না আসাই সর্বাংশে উচিত ছিল। তুমি, স্বল্প সময়ের জন্য আসিয়া, সকলকে কেবল মর্মান্তিক বেদনা দিয়া গিয়াছ। আমি যে, তোমার অদর্শনে, কত যাতনা ভোগ করিতেছি, তাহা তুমি একবারও ভাবিতেছ না ।.......

নিষ্ঠুর বাস্তবতা যাকে স্পর্শ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তাকে পাওয়ার একটাই গলিপথ হচ্ছে স্বপ্ন। বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “দৈবযোগে, একদিন, দিবাভাগে, আমার নিদ্রাবেশ ঘটিয়াছিল। কেবল সেইদিন, সেই সময়ে

 

ক্ষণকালের জন্য, তোমায় পাইয়াছিলাম দর্শনমাত্র, আহ্লাদে অধৈর্য হইয়া, 'অভূতপূর্ব আগ্রহ সহকারে ক্রোড়ে লইয়া, প্রগাঢ় স্নেহভরে বাহু দ্বারা পীড়নপূর্বক, সজল নয়নে তোমার মুখচুম্বনে প্রবৃত্ত হইতেছি, এমন সময়ে এক ব্যক্তি, আহ্বান করিয়া, আমার নিদ্রাভঙ্গ করিলেন। এই আকস্মিক নিদ্রাভঙ্গ দ্বারা সেদিন, যে বিষম ক্ষোভ ও ভয়ানক মনস্তাপ পাইয়াছি, তাহা ব্যক্ত করিবার নহে। "

 

'প্রভাবতী সম্ভাষণ' রচনার সময়কালে বিদ্যাসাগর নানারকম সমস্যায় জর্জারিত ও পীড়িত ছিলেন। প্রভাবতীর স্নেহসিক্ত সঙ্গ তাঁর একান্ত আশ্রয় হয়ে উঠেছিল কেন, তা তিনি প্রবন্ধের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে লিখেছেন- "বংসে। কিছুদিন হইল, আমি, নানা কারণে, অতিশয় শোচনীয় অবস্থায় অবস্থাপিত হইয়াছি। সংসার নিতান্ত বিরল ও বিষময় হইয়া উঠিয়াছে। কেবল একপদার্থ ভিন্ন, আর কোনও বিষয়েই, কোনও অংশে, কিঞ্চিত্মাত্র সুখবোধ বা প্রীতিলাভ হইত না। তুমি আমার সেই একপদার্থ ছিলে। ইদানিং একমাত্র তোমায় অবলম্বন করিয়া, এই বিষময় সংসার অমৃতময় বোধ করিতেছিলাম। যখন, চিত্ত বিষম অসুখে ও উৎকট বিরাগে পরিপূর্ণ হইয়া, সংসার নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণাভবন বলিয়া প্রতীয়মান হইত, সে সময়ে, তোমার কোলে লইলে ও তোমার মুখচুম্বন করিলে, আমার সর্বশরীর, তৎক্ষণাৎ, যেন অমৃতরসে অভিষিক্ত হইত।.....তুমি অন্ধতমসাচ্ছন্ন গৃহে প্রদীপ্ত প্রদীপের, এবং চিরওয় মরুভূমিতে প্রভূত প্রস্রবণের, কার্য করিতেছিলে।... ইদানীং তুমিই আমার জীবনযাত্রার একমাত্র অবলম্বন হইয়া ছিলে।...

উনিশ শতকে বাঙালি জীবনে নারীর জীবননাট্য আবর্তিত হত প্রধানত সংসারকে কেন্দ্র করে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর খুব কম সময় কাটত বাপের বাড়িতে। তারপর শ্বশুর বাড়ি, স্বামী, শাশুড়ি, সন্তান লালন-পালন, অসুস্থতা, আকস্মিক বিপদ, উৎকণ্ঠা এইসব নিয়ে তৈরি হত একটি অনিবার্য ঘরোয়া জীবন চর্যা। এর বাইরে আর কিছুই ছিল না বাঙালি নারীর জীবনে। আশ্চর্য এই যে বাপের বাড়ির ছোট জীবনপর্বটি ছিল তার ট্রেলার মাত্র। পরবর্তীতে তাকে যে ভবিতব্যের মধ্যে যেতে হবে তার মানসিক মহড়া শিশুকালেই শুরু হত। অতি শৈশবেই নারীর মনোজগতের খাঁজে খাঁজে কীভাবে ঢুকে যায় আগামী সংসার নাট্য তার একটি প্রামাণ্য খণ্ডচিত্র বিদ্যাসাগর তুলে ধরেছেন 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'-এ। বঙ্গ-সংসারে তিন বছরের একটি শিশুকন্যাও যে মাইক্রো-গৃহিণী হয়ে যায়, তা তার আধো আধো জীবনাচরণে পরিস্কার । মা, ঠাকুমা, পিসি, মাসি, প্রতিবেশিনীদের সাংসারিক আচরণ শিশুকন্যা ব্লটিং পেপারের মতো চুষে নিতে পারে। ভবিষ্যতে তাকে যা করতে হবে, শৈশবের ক্রীড়াজীবনে সেগুলির নিখুঁত মহড়া দেয় প্রভাবতী। প্রভাবতীর তিন বছরের ছোট্ট জীবন থেকে অন্তত ছ'টি ক্রীড়া নাট্যের ছবি তুলে ধরেছেন বিদ্যাসাগর—“কখনও কখনও সে তনয় লালন পালনে ব্যাপৃত।” “কখনও কখনও স্বামীর পীড়া সংবাদে সে বিষণ্ণ।” “কখনও কখনও ‘স্বামী আসিয়াছেন' বলে লজ্জাশীলা।” “কখনও কখনও ‘শ্বশুরালয় হইতে অশুভ সংবাদ আসিয়াছে' বলে ম্লান বদন।” “কখনও কখনও পুত্রটি ‘আর একটু হইলেই পুকুরে ডুবিয়া পড়িত' বলে শোকাভিভূত।” “কখনও কখনও ‘শাশুড়ির পীড়া সংবাদ আসিয়াছে বলিয়া শ্বশুরালয়ে যাইবার জন্য সজ্জারত।” সবই কাল্পনিক। কীভাবে চলত প্রভাবতীর মহড়া, সে কাহিনীও শুনিয়েছেন বিদ্যাসাগর তাঁর রচনায়- “কখনও কখনও, তোমার পুজ্যপাদ পিতামহীদেবী তোমার কল্পিত স্বামীর উল্লেখ পূর্বক, পরিহাস করিয়া জিজ্ঞাসিতেন, 'কেমন প্রভা, সে এসেছিল ?' তুমি অমনি শিরশ্চালন পূর্বক, 'কাল এসেছিল' বলিয়া উত্তর দিতে।”

 

বিদ্যাসাগরের শিক্ষাসংস্কার ও সমাজ সংস্কারের সিংহভাগ নারীকেন্দ্রিক। মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়, তাদের বাল্যবিবাহ বিরুদ্ধ প্রস্তাব, বিধবাবিবাহ আন্দোলন, বহু বিবাহ রদ করার প্রচেষ্টা—তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ড যাকে বাঁচানোর জন্য তার নামই 'প্রভাবতী'। প্রভাবতী তাঁর অন্ধতমসাচ্ছন্ন গৃহে প্রদীপ্ত প্রদীপ, 'চিরশুষ্ক মরুভূমিতে প্রভূত প্রস্রবণ'। সেই প্রভাবতীই যদি রইল না, তবে আর কি থাকল 'নৃশংস সংসারে' ?

বিদ্যাসাগর 'বাল্যবিবাহের দোষ' লিখেছিলেন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে। বিধবা বিবাহ নিয়ে লিখেছিলেন ১৮৫a খ্রিস্টাব্দে, বহুবিবাহ রদ করার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবং এই বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব তখনও প্রকাশিত হয়নি। বিধবাবিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের তখন জেরবার অবস্থা। ঐ সময়ই প্রভাবতীর মৃত্যু হয় এবং বিদ্যাসাগর লেখেন 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' (১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল)। বিদ্যাসাগর প্রভাবতীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মধ্যে 'অবোধ মনকে কথঞ্চিৎ প্রবোধ দিয়েছেন এই ভেবে যে, “এই নৃশংস সংসারে দীর্ঘকাল অবস্থিতি করিলে, উত্তরকালে তোমার ভাগ্যে কি ঘটিত, তাহার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই।... যদি, পরম যত্নে ও পরম আদরে পরিবর্ধিত করিয়া, পরিশেষে, তুমি অবস্থার বৈগুণ্য নিবন্ধন দুঃসহ ক্লেশ পরম্পরায় কালযাপন করিতেছ, ইহা দেখিতে হইত, তাহা হইলে আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। বোধ হয়, তোমার অতর্কিত অন্তর্ধান নিবন্ধন যাতনা অপেক্ষা, সে যাতনা বহু সহস্রগুণে গরীয়সী হইত।"

 

বঙ্গজীবনে নারীর দুরবস্থার চিত্র বিদ্যাসাগরের মতো ইতিপূর্বে আর কেউ ফুটিয়ে তুলেননি। বিদ্যাসাগরের সেই মহাকাব্যিক নারী দর্শনের কৃষ্ণকুটিল ট্র্যাজিক পটভূমিকায় 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' দু'হাত আড়াল করে বুকের কাছে রাখা একটি সন্ধ্যা প্রদীপের মতো। প্রভাবতী তাঁকে ফাঁকি দিতে পারে, কিন্তু তিনি প্রভাবতীকে কি করে ভুলে থাকতে পারবেন? তাই লিখেছেন, “আমি তোমায়, কস্মিন কালেও বিস্তৃত হইতে পারিব না। তোমার অদ্ভুত মনোহর মূর্তি, চিরদিনের নিমিত্ত, আমার চিত্রপটে চিত্রিত থাকিবেক । ”

 

শৈশবের শিশিরবিন্দুর মতো উজ্জ্বল নির্মল পবিত্রতা দিয়ে গড়া, 'লাবণ্যপুর্ণ কোমল কলেবর,' 'শরীর অমৃতরসে অভিষিক্ত', 'অদ্ভুত মোহিনীশক্তি সম্পন্ন, বিরস ও বিষময় সংসারে সুখবোধ ও প্রীতিলাভের আকর যার পরিস্পর্শে সংসার অমৃতময় বোধ হয় প্রভাবতী সেই নারীসত্তার প্রতিমূর্তি বা আইডল।

বিদ্যাসাগর কঠোর কঠিন গদ্যকার। তাঁর জীবন বীরের, পৌরুষের, সংগ্রামের। কিন্তু তার হৃদয়ে কোমল অনুভবের আর্দ্রতা ছিল বলেই তিনি প্রভাবতীর স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য মানসিক সংগ্রাম করেছেন। নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তিনি প্রভাবতীকে অর্জন করেছেন। তাকে নির্মাণ করেছেন। প্রভাবতী বিদ্যাসাগরের চোখে দেখা, হাতে ছোঁয়া নারীর নির্মল বুনিয়াদি সত্তা। প্রভাবতীর থাকা, তার চলে যাওয়া, তার অনুন্মোচিত জীবন, তার ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, তার মাধুর্য, তার যন্ত্রণা—সবকিছু দিয়ে বিদ্যাসাগর তাকে রচনা করেছেন নিজের মতো করে। বিরস ও বিষময় সংসারে প্রভাবতীকে বিদ্যাসাগর শুধু অমৃত রসে অভিষিক্ত করে রচনা করেননি, বিদায়কালে অসুস্থতা নিবন্ধন 'অধিক জল দেওয়া চিকিৎসকের মতানুযায়ী নয়' বলে ইচ্ছাপূরণ জল পানের পরিবর্তে শুধু প্রবন্ধনা বাক্যে সান্ত্বনা দিতে হত। বিদ্যাসাগর আক্ষেপ করেছেন- “বৎসে। তুমি উৎকট পিপাসায় অতিশয় আকুল হইয়া, জলপ্রার্থনা কালে, আমার দিকে, বারংবার যে কাতর দৃষ্টিপাত করিয়াছিলে, তাহা আমার হৃদয়ে বিষম শল্যের ন্যায়, চিরদিনের নিমিত্ত নিহিত রহিয়াছে। যদি তোমার সকলকাও বিস্তৃত হই, ঐ মর্মভেদী কাতর দৃষ্টিপাত এক মুহূর্তের নিমিত্ত, আমার স্মৃতিপথ হইতে অপসারিত হইবেক না।"

তাই বিস্মৃতির হাত থেকে প্রভাবতীকে রক্ষা করার জন্য, তার স্মৃতিকে চির জাগরূক রাখার জন্য 'বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী' বিদ্যাসাগর লিখে ফেললেন 'প্রভাবতী সম্ভাষণ'। বিদ্যাসাগরের ভাষায়- "কালক্রমে পাছে তোমায় বিস্মৃত হই, এই আশঙ্কায় তোমার যারপরনাই চিত্তহারিণী ও চমৎকারিণী লীলা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করিলাম। সতত পাঠ করিয়া, তোমায় সর্বক্ষণ স্মৃতিপথে জাগরূক রাখিব, তাহা হইলে, আর তোমায় বিস্মৃত হইবার অণুমাত্র আশঙ্কা রহিল না। বৎসে! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না, একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই-যদি তুমি পুনরায় নরলোকে আবির্ভূত হও, দোহাই ধর্মের এইটি করিও, যাহারা তোমার স্নেহপাশে বদ্ধ হইবেন, যেন তাঁহাদিগকে আমাদের মত, অবিরত, দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইয়া, যাবজ্জীবন যাতনাভোগ করিতে না হয়। ”

 

'প্রভাবতী সম্ভাষণ' রচনার পরে বিদ্যাসাগর ২৭ বছর জীবিত ছিলেন। ২৭ বছর ধরে এই লেখা একান্তে বসে পড়তেন তিনি। পড়ার সময় তাঁর চোখ থেকে নেমে আসত জলের ধারা। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন, “প্রভাবতীর স্মৃতি চির জাগরূক রাখিবার জন্য, তিনি (বিদ্যাসাগর) এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। মৃত্যুর তিন চারি মাস পুর্বেও আমি তাঁহাকে একান্তে 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' পড়িতে দেখিয়াছি। প্রভাবতীর স্মৃতি তিনি চিরদিন হৃদয়ে জাগাইয়া রাখিয়াছিলেন।” সুরেশচন্দ্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বিদ্যাসাগর শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহময় ছিলেন। একথা মেনে নিয়েও অনেক সমালোচক বলেন, 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' শুধুমাত্র শিশুস্নেহের নমুনা নয়, এই নিবন্ধের আরও গভীরতর তাৎপর্য আছে। অশ্রুসাগর বিদ্যাসাগরের হৃদয়কক্ষের একটি অব্যর্থ চাবিকাঠি এই নিবন্ধ। সুগৃহিণী যেমন তাঁর ভাঁড়ার ঘরের চাবিকাঠি আঁচল থেকে খোলেনা, বিদ্যাসাগর তেমনি তাঁর হৃদয়কক্ষের এই চাবিকাঠিটি লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অশ্রুই ছিল বিদ্যাসাগরের শক্তির উৎস। অশ্রুই তাঁর সংগ্রামের প্রেরণা, অশ্রুই তাঁর জিয়নকাঠি।

লেখক: অধ্যক্ষ, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, মেদিনীপুর।

Mailing List