প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
আদিম রাক্ষস
দু’লক্ষ বছর প্রায় এক-ই ভাবে বসে থাকা ঘুমন্ত সে আগ্নেয়গিরিতে
কটু গন্ধ গন্ধকের, সাদা ছাই, তরল ধাতুর ধারা এখন কঠিন
গড়ানোর জমা দাগ আপাদ-মস্তক দেখে অনুভূত হ’তে থাকে
কোনোদিন এই খানে কী ভীষণ রক্ত ঝরে ছিল! হয়তো বা
অর্ধদগ্ধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ে খেলা করেছিল এক আদিম রাক্ষস!
একটা অদৃশ্য চোখ টুকে রাখছে ছবি তার, তারপর ছুটে যাচ্ছে আরো...
দৌড়তে দৌড়তে থাকে কঠিন আগ্নেয় শিলা, ছোট নুড়ি, তার উপরে সদ্য ওঠা ঘাস
কলম ছলকে খোঁজে ছোট ছোট ঝোরা গুলো, ফড়িং গুলোর ওড়াউড়ি ।
কাগজে চলকে যায় বিখ্যাত লোকের বাণী, রাংতা মোড়কে থাকা মন
কাচের জারের মধ্যে ফরমালিনে ডুবে থাকা হৃৎপিণ্ড নিয়ে খেলা করে !
.....................
মাটি
খুব বড় হয়ে যাচ্ছে ছায়ার নিচে থাকা সমস্ত ছায়ারা
বেঁটেদের বেঁটে বলা সৌজন্যবিরোধী, তবু মাঝে মাঝে
স্পষ্ট করে না বললে পপআপে খুলে যায় পুরোটা ঝিনুক
তখন আর চিহ্নগুলো পথিকআলোয় দৃষ্টিগোচরে থাকে না
এরকম হয় জেনে অণু-পরমাণুদের সেই মৌলিক গঠন
একেক রকম থেকে একসুরে বেজে ওঠে পিঁপড়েবৃত্তিতে
লাভের গুড়ের ভাগ কারা খেয়ে যাবে রোজ একথা ভাবার
জন্য তৈরি চেয়ার হাত বোলায় দাঁড়িতে: হাঃ মাটি তো আমার !
..........................
মড়া চামড়ার বোল
ঢাক বাজছে দমাদম ব্রহ্মানন্দপুরে আর কান ঢাকছে কুশীলব
মহানন্দপুর
যদিও দু’ জায়গার দূরত্ব ব্যাপক; তবু এই কান ঢাকাঢাকি
চলে আসছে যুগযুগ, পরাক্রমে রোজ তাই চামড়ায় প্রহার
মরা চামড়ার পিঠে কাঠির ছোবল খাওয়া কাঁপন হাওয়ায়
মাধুরী শব্দের বোলে ভেসে যায় খেত
খেটোধুতি জ্বলে ওঠে পাথুরে মাটিতে
অক্ষরের ধান ফোটে কলিতে কলিতে
আহ্লাদ গড়িয়ে যায় কুসীদজীবীর
বেঁচে থাকা চামড়াটিতে তার-ই অধিকার
............
নিয়তি
‘নিজেকে প্রমাণ কর’, ‘নিজেকে প্রমাণ কর’, করতে করতে এই ৬৭ বছর
তবু করে যেতে যেতে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, অপমানগুলো বুঝি বিঁধেছে গলায়!
যেন সে কাঁটার মতো প্রথম নধর ভোরে কড়ি ও শুদ্ধের সাথে মধ্যমের গা’য়
তুমি কি আনলে তার কোমলঋষভ- গন্ধে কনফার্মড টিকিটটিকে সাজিয়ে বাসর !
উদ্গ্রীব সূর্য ও যেন অপেক্ষায় থেকে থেকে হারিয়ে ফেলেছে তার ধৈর্যের পাথর
শীতের অতিথি আজ ভুল ক’রে এসে গেছে, সহাস্যে দাঁড়িয়ে তারা সেই দরজায়
যে দরজাটিতে তারা এসে ছিল বহু আগে, বন্ধ হ’য়েছিল এক ঝড়ের ধাক্কায় !
দরজা খোলেনি কিন্তু চোরা পথ খুলে গিয়ে খেয়ে ফেলছে এ- ব্রহ্মাণ্ডও! টানে ভয়ংকর ...
উড়ে যাচ্ছে সেই সব নাম জানা, না জানা সে দীর্ঘকায় রাক্ষুসে পাখির দল
খেয়ে ফেলছে সব কিছু , খাদ্য-অখাদ্য সব, এমন কী নিজেরও প্রজাতি
সময়ের সব কোণ গুটি গুটি পায়ে এসে একসাথে ক’রেছে দঙ্গল
ভীষণ জটিল এই জটের মধ্যে গিয়ে কল্পনাও হারিয়েছে গতি
আজ যে নীলের মতো কাল সে গেরুয়া যেন সাহারাতে ফুলের জঙ্গল
হেরে যাওয়া রোজ রোজ বিদ্ধ অপমান আজ আভরণ করেছে নিয়তি!
...................
অনুপস্থিত থাকা সেই আলোগুলো
এমন আকাশ নিয়ে কী করব তবে
যে চেনেনা আমায়!
দাঁড়াতে দেয় না পাশে, হাতে হাত তো দুকোটি মাইল...
একটু দাঁড়াতে হবে তবু, একটু সময় নিয়ে ঘুরে যেতে হবে এই
মাঠ ও মন্দির, গির্জা মসজিদ, কৌম মাটিতে থেকে মূল সাধনার
মঞ্চে দাঁড়িয়েও যেন অনুপস্থিত!
তাইতো অমিল হল সব রূপ রং।
যেমন এখন ওরা! বাচিক শিল্পীরা!
সে কী জানে উচ্চারণে তুলে নিতে সকালের
ঝিকমিক ঝিকমিক রোদ্দুরসমূহ ?
বুকে যে দাঁড়ের গন্ধ? যে গন্ধ নদীতে মেশে?
সে গন্ধই মাতিয়ে পাহাড়;
আজ বুঝি পেতে চায়
মাংসল শরীর এক, বদলে শিলার!
গভীর পরিখা দেওয়া সেই সব দুর্গ ঘেরা বল্লমপ্রহরী
হাওয়ার উজানে গিয়ে ফড়িং ’এর মতো ভাসে ,
হাত ধরে নিয়ে যায় যে ভূগোল-ইতিহাসে,
এখনো যা অদেখা সবার ;
শুধু তার রিন রিন মৃদুল স্বনন
অতি মন্দ্র সপ্তকের
ক্ষীণ আর্তনাদ হয়ে
ভেসে থাকে দশক দশক ...
আর তার পর থেকে এরকম হৈ চৈ, এভাবে যে রোদ্দুর ভ্যাঙানো
যায়, দেখে শিখে ফেলে সব বালক এবং বালিকা এই মফস্বলেও;
যারা আজ সূর্য হ’তে প্রতিস্পর্ধী নিজেদের,
অবজ্ঞায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছাই হয়ে যায় ...
যন্ত্রণার মৃত্যু হয়, গল্প নেই ! গল্প কই !
কবিতায় গল্প খোঁজে নিষ্ঠুর পাঠক !
এই তো সে শ্যামলতা ডাল ধরে দোল খাচ্ছে
প্রেমিকের সাদাকালো হাতে
আবহে রবীন্দ্রনাথ মল্লিক মশাই কণ্ঠে মানিয়ে চলেছে বহুদিন
আর কি ওসব চলে ! দিন খাঁজ, খোলা ভাঁজ, এক টুকরো সিন দিন
‘আমাকে আমার মতো’ মিহি স্বরে ভুলভাল বেসুরো বাঁচতে দিন,
বাঁচতে দিন।
লড়াই দিন লড়াই দিন দেশপ্রেমে মাতিয়ে দিন ধর্ম দিয়ে উড়ান দিন
ভূমধ্য সাগরে। বুকে যে ধানের গন্ধ, যে গন্ধ মিশেছে দাঁড়ে,
রেখে আসি তাকে নিয়ে আরব সাগরে।
মাননীয় মোদী জি কি শুনতে পাচ্ছেন,
শুনতে পাচ্ছেন এই কান্না আমাদের?
একটু দাঁড়াতে হবে ফসলের পোড়া মাঠে,খোড়ো চালে,বাবুই দড়িতে
একটু সময় নিয়ে ঘুরে যেতে হবে ওই
আকসাই চীনের হিমে
ঠায় বসে থাকা
সেই জওয়ানের পাশে
নবজাত শিশুটির মুখটি না দেখেও যে
হাড় হিম ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!
প্লাস্টিক কার্ড হাতে আপনার হাসি মুখ দেখছে শিশুটি
মাকে যেতে হচ্ছে যার আড়াল বিহীন আজও
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে !
গল্প পেলেন ভাই? সেন্টু কিছু? শ্লোগান কিছুটা?
তবে তো কবিতা হল, কী আহ্লাদ কী আহ্লাদ
মই গাছে বেঁধেছে এবার
তবুও বেজার মুখ ! ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ কীভাবে যে হবে ভাই
‘প্রতিকবিতা’ কি দিয়ে তবে
মসজিদ গির্জার পাশে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি
একসাথে যে এসে মেলাবে
তা শুধু ফুলেরা পারে, সেজন্য এ অক্ষর পুষ্পিতা
মঞ্চে নেই, তবু তার আলো লেগে আছে মাঠে, ঘরে!
..........................
লেখক পরিচিতি: জন্ম- ডিসেম্বর ১৯৫৩। কলকাতার দর্জিপাড়া ম্যাটারনিটি হোম। বেড়ে ওঠা –নিমতা। লেখালেখির শুরু ১৯৭২। কবি, অনুবাদক, নাট্যকার, ভালবাসা–রাগ সঙ্গীত চর্চা, অভিনয়, ভ্রমণ, পড়াশুনা। প্রকাশিত বই এর সংখ্যা-৮। সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন –ক্লেদজ কুসুম।


