‘সূর্যডিম আম’ কেমন জানেন, কী বা গুণ রয়েছে তার? লিখছেন উপ উদ্যানপালন অধিকর্তা ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া

‘সূর্যডিম আম’ কেমন জানেন, কী বা গুণ রয়েছে তার? লিখছেন উপ উদ্যানপালন অধিকর্তা ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
ড. সমরেন্দ্র নাথ খাঁড়া
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আম হলো জাপানের মিয়াজাকি আম। যাকে সূর্যডিম আমও বলে। সৌন্দর্য, দাম, ওজন, সুবাস ও স্বাদের দিক থেকে পৃথিবীর শীর্ষ আমের তালিকায় অন্যতম। জাপানের মিয়াজাকি শহরে এই আমের চাষ হয়। এটি সে দেশের বহুল জনপ্রিয় একটি আম। বলা হয়ে থাকে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ নাগাদ প্রথম মিয়াজাকি আমের চাষ শুরু হয়।
নামকরণ:
দক্ষিন জাপানের কিয়োশু অঞ্চলের মিয়াজাকি নামক স্থানে এটির জন্ম। তাই নাম মিয়াজাকি। এটিকে জাপানি ভাষায় বলা হয়, 'তাইয়ো নো তামাগো' ( Taiyo no tamago )। এর ইংরেজি অর্থ দাড়ায় egg of the sun. একারণে বাংলায় আমটির নামকরণ করা হয়েছে সূর্য ডিম। এই আম অনেকটাই ডিমের মতো এবং জলন্ত সুর্যের মতো গাঢ় লাল রং। 'এগ অব দ্য সান' বা সূর্যডিম। আর আমের রঙটাও যেহেতু লাল,তাই এর নাম 'রেড ম্যাঙ্গো' বা লাল আম নামকরণ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারে এটি 'রেড ম্যাঙ্গো' বা লাল আম বা সূর্যডিম নামেও পরিচিত। তবে বাংলায় এই আমটি পরিচিতি পেয়েছে "সূর্যডিম" নামে। Egg of sun mango, Miyajaki mango, Red mango, Sun egg mango, মিয়াজাকি আম, রেড আম, লাল আম, সূর্যডিম আম।
খাদ্যগুণ:
সূর্যডিম আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, বেটা-ক্যারোটিন ও ফলিক অ্যাসিড। তাই এটি চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
বৈশিষ্ট:
এই আমের গড়ন সাধারণ আমের চাইতে বড় ও লম্বা, স্বাদে মিষ্টি এবং আমের বাইরের আবরণ দেখতে গাঢ় লাল অথবা লাল-বেগুনির মিশ্র রং। পুরো আমের গায়ের রং অনেকটা রুবি পাথরের মতো লাল হয়।আমটির স্বাদ অন্য আমের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি।আমটি খেতে খুবই মিষ্টি। আমের বাইরের রং জলন্ত আগুনের মতো গাঢ় লাল, ভেতরের অংশ আঁশবিহীন মাখনের মতো নরম ও কমলা রংয়ের হয়।এক একটি আমের ওজন ৩৫০ থেকে ৪৫০ গ্রামের মতো। একটি আমের দাম প্রায় ৭০ ডলার বা ৬ হাজার টাকা।মিয়াজাকি আম চাষের জন্য দীর্ঘ সময় সূর্যালোকের উপস্থিতি,উষ্ণ আবহাওয়া এবং কম অথচ পর্যাপ্ত বৃষ্টি প্রয়োজন হয়। আম চাষীরা শুরুতেই প্রতিটি আমকে ছোট একটি জালি ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেয়।এর ফলে আমের প্রতিটি কোণায় কোণায় সূর্যের আলো এসে পড়ে। গাছ থেকে আম পড়ার সময় গায়ে যাতে কোনো আঁচড় না লাগে, এই জালি ব্যাগ ব্যবহারের আরো একটি কারণ।সাধারণত আম পাকতে শুরু করলে গাছ থেকে আম পাড়া হয়।কিন্তু এই আমগুলো পেকে পড়ে গেলে আমের সম্পূর্ণ পক্কতা হয়েছে নিশ্চিত হওয়া যায়। এই আমগুলো খেতে খুব সুস্বাদু।
চাষ পদ্ধতি:
উঁচু,মাঝারি উঁচু জমি,যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির জল জমে না এমন জমি এই জাতের চাষ করার আদর্শ।তবে দো-আঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো।লাল মাটি ও পাহাড়েও চাষ করা যায়।বেলে,বেলে দোআঁশ ও উপকূলের লোনা মাটি ছাড়া যেকোনো মাটিতে এই জাতের আম চাষ করা যায়।
কলমের গাছ অতি ঘন পদ্ধতিতে (তিন মিটার x তিন মিটার বা ১০ ফুট x ১০ ফুট) দূরত্ব কম দিয়ে লাগানো যায়।পরে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সেসব গাছ থেকে ফল নেবার পর দুটি গাছের মাঝখান থেকে একটা গাছ কেটে ফেলা যায়।এতে প্রথম তিন থেকে চার বছরে একই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় দ্বিগুণ লাভ হতে পারে।কাটার পর বাকি গাছগুলো স্থায়ীভাবে রেখে ভালো করে যত্নআত্তি করলে সে গাছগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত এ জাতের চারা বা কলম লাগানোর জন্য চার থেকে ছয় মিটার দূরত্ব দেওয়া হয়। এই দূরত্বের হিসাবে বিঘা প্রতি ২৫ থেকে ৩৮টি চারা লাগানো যায়। অতি ঘন পদ্ধতিতে দিয়ে গাছ লাগানো যেতে পারে।প্রথমেই ছয় মিটার দূরে দূরে চারা বা কলম লাগিয়ে মাঝখানের জায়গা ফাঁকা না রেখে গাছ যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাকসবজি, শুঁটি জাতীয় গাছ, যেমন - মটরশুঁটি, ছোলা, মুসুর, ফ্রেঞ্চবিন, মুগ ও মাষকলাই; তিল, আদা প্রভৃতি লাগানো যায়। চারা লাগানোর সাত থেকে দশ দিন আগে গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটিতে গর্তপ্রতি ১০ থেকে ১৫ কেজি গোবরসার, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৫০ গ্রাম এস এস পি, ১০০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ,১০ গ্রাম বোরণ মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। বৃষ্টি শুরু হলে কলমের চারা আগে থেকে সার ভর্তি গর্তে বসাতে হয়। বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পলিব্যাগ বা টবের কলম খুব শীত ছাড়া বছরের যেকোনো সময় লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। গর্তের ঠিক মাঝখানে চারাটি সোজা করে লাগিয়ে চারার গোড়ায় জল দিতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে পরিমাণমতো ইউরিয়া, এসএসপি, এমওপি, জিঙ্ক ও জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে।আমের গুটি ফাটা রোধ করতে বোরন সার দিতে হবে। এ জাতের আমগাছের সুন্দর গড়ন, বাড়বাড়তি, রোগ-পোকার আক্রমণ কমানো ও ভালো ফলনের জন্য ছাঁটাই খুব দরকার। বিশেষ করে চারা রোপণের পর প্রথম কয়েক বছর ছাঁটাই এর কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি মজবুত হয় এবং গাছের মাথা বেশি ঝাঁকড়া হওয়ায় বেশি ফুল-ফল ধরে। গাছে ফল ধরা শুরু হলে নিচে ঝুলে পড়া ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে।গাছের ডালপালা খুব ঘন হলে কিছু ডাল ছেঁটে পাতলা করে দিতে হবে। গাছকে ছেঁটে তিন থেকে পাঁচ মিটার উচ্চতার মধ্যে রাখলে স্প্রে করা,অন্যান্য পরিচর্চা করা ও ফল তুলতে সুবিধে হয়।এ জাতের গাছে নিয়মিতভাবে প্রতি বছরই ফল ধরে।
কখন পাকে:
সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই আম পাওয়া যায়।তবে মে-জুনে সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। প্রতি বছর এপ্রিলে মিয়াজাকির পাইকারি বাজারে মিয়াজাকি বা সূর্য ডিম আমের নিলাম হয়।স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা আমের রং, আকার, আকৃতি, স্বাদ, মিষ্টতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সেরা সূর্যডিম আম নির্বাচন করে।আমেরিকার ডোল ব্র্যান্ডের আমের সাথে এই আমের তুলনা করা যেতে পারে।কিন্তু মিয়াজাকি আম দামের দিক থেকে বেশ অনেকটাই এগিয়ে।
জাপানী গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে এই আম প্রতি কেজি ২ লাখ ৭০ হাজার রূপিতে বিক্রি হয়েছে। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ৭০০ গ্রাম ওজনের দুইটি আমের একটি প্যাকেট ৩ হাজার ৭০০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম।সাধারণত কেজিতে আম কেনা হলেও এই সূর্যের ডিম আম বিক্রি হয় জোড়ায় জোড়ায়।
মিয়াজাকি আম বর্তমানে আমাদের দেশে ও পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। ছাদবাগান বা বাড়ির উঠনেও লাগানো যায়।বর্তমানে সৌখিন বাগানীদের মিয়াজাকি বা সূর্যডিম পছন্দের শীর্ষে রয়েছে। ছাদের ড্রামে সূর্যডিম আম গাছ বসিয়ে এই আমের যেমন স্বাদ নেওয়া যাবে, সাথে সাথে বাগানের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করা যায়।
এতো বেশী দাম কেনো? অনেকের ধারণা, হয়তো বিরল প্রজাতির আম তাই এর এতো দাম। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।এই আম চাষ করতে যে পরিশ্রম করতে হয় এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে পরিমাণ পরিচর্চা ও যত্ন করতে হয়, তার জন্য দামটা বেশী।
উপহার হিসেবে এই আমের বিশেষ কদর রয়েছে। জাপানে দামী এবং উচ্চ মানের ফল উপহার হিসেবে প্রদান করাটাকে সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, অতিথিদের উপহার হিসাবে, সামাজিক প্রথা, ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান, বিশেষ উপলক্ষ্য বা সফর শেষে ফিরে আসার পর এই আম প্রদান করা হয়। উপহার পাওয়া এই আমগুলোকে অনেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন, গর্ব ও আনন্দ উপভোগ করে।
লেখক: উপ-উদ্যানপালন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
.........................


