নস্টালজিক কলকাতার ট্রাম, দেড়শো বছরে পদার্পন

নস্টালজিক কলকাতার ট্রাম, দেড়শো বছরে পদার্পন
আনফোল্ড বাংলা প্রতিবেদনঃ কলকাতার ইতিহাসে ট্রাম ঐতিহ্য বহন করে আসছে। তিলোত্তমার অন্যতম প্রাচীন গণপরিবহণের মাধ্যম হল ট্রাম। এ শহরে সমান তালে গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো যাচ্ছে, আবার ট্রামও ছুটছে! এমন আরেকটা মেট্রো শহর কোথায়? আর তাই ট্রাম মানেই প্রেম আর নস্টালজিয়া।
স্বাধীনতার পরেও অনেকদিন ট্রাম কোম্পানি ব্রিটিশের মালিকানাধীন ছিল। ব্রিটিশ ট্রাম কোম্পানি ১৯৫৩ সালের ২৫ জুন ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাড়া এক পয়সা বৃদ্ধি করে, সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। যার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে বামেরা। সেই আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সরকার কড়া হাতে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। জ্যোতি বাবুরা সে সময় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। এর অনেক পরে ট্রাম রাষ্ট্রয়ত্ত হয়েছিল।
তবে ট্রাম চলাচলের গোড়ার কথা জানতে ইতিহাসের অলিন্দে যেতে হবে, কারণ কলকাতা শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ট্রাম। সেকালের তিলোত্তমা কিন্তু আজকের মতো ছিল না। ধীরে ধীরে কলকাতা কলেবরে বাড়ছিল। মানুষজন বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল যানবাহনের চাহিদা। উনবিংশ শতকের শেষভাগ। শিয়ালদহ থেকে তৎকালীন সার্কুলার রোড ধরে বউবাজার, ডালহৌসি হয়ে একেবারে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতার কাজ শেষ হল। প্রথমে খরচ ধরা হয়েছিল লাখখানেক টাকা। কিন্তু কাজে নেমে তা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন পুরকর্তা জাস্টিস অব পিস। প্রথম ট্রাম রুটের যাত্রাপথ ছিল ৩.৯ কিলোমিটার। অস্ট্রেলিয়া থেকে সব তেজি ঘোড়া নিয়ে আসা হল। ঠিক হল, মূলত পণ্য পরিবহণের জন্য চলবে ট্রাম। কিন্তু ততদিনে ট্রামকে ঘিরে আম বাঙালির মধ্যে উদ্দীপনা চরমে। ট্রাম চালানোর দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এর চারদিন পরে কলকাতার রাজপথে গড়াল ট্রামের চাকা।
তারিখটা ২৪ ফেব্রুয়ারি। সকাল ৯টা নাগাদ শিয়ালদহে এসে পৌঁছল ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ের ট্রেন। কাতারে কাতারে লোক নেমে দৌড়ল ট্রাম ধরতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন দুটো এক বগির ট্রাম। একটা সেকেন্ড ক্লাস, অন্যটা ফার্স্ট ক্লাস। প্রতিটি বগিতে ৪৫টি আসন। সাধারণ মানুষ হইহই করে উঠে পড়ল দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তিল ধারণের জায়গা নেই। আর প্রথম শ্রেণিতে মেরেকেটে জনা পাঁচেক সাহেব। সেই ফার্স্ট ক্লাস ট্রাম অনায়াসেই যাত্রা শুরু করল। কিন্তু, সুখ বেশি দিন সইল না। কলকাতার গরম অস্ট্রেলিয়ার তেজি ঘোড়াও সহ্য করতে পারল না। অবলা প্রাণীর মৃত্যুতে ক্ষতির বহর এতটাই বেড়ে যায় যে জাস্টিস অব পিসরা হাত তুলে নিতে বাধ্য হয়। ওই বছরের ২০ নভেম্বরই থমকে গেল সেই ট্রাম। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালের ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ট্রামওয়ে কোম্পানি স্থাপিত হওয়ার পর তারা পুনরায় কলকাতার বুকে ট্রাম নিয়ে আসে। বছর সাতেক পর ফের শহরে ফিরে আসে ঐতিহ্যবাহী যান।
স্টিম ইঞ্জিনে চালিত কলের ট্রামও চলেছে কলকাতায়। কিন্তু ধোঁয়া আর খরচের বহরে গোড়াতেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। কলকাতায় বিদ্যুৎ সংযোগ চলে এসেছে তখন। ১৮৯৮ সালে ট্রাম কোম্পানি জানিয়ে দেয়, বিদ্যুতে না চললে, ট্রাম চালানো সম্ভব নয়। ন্যারো গেজের ট্রাম লাইনও বদলে ফেলা হয় চার ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ট্র্যাকে। ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ তিলোত্তমার মাটিতে চলল গোটা এশিয়ায় প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম। ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর। ময়দানের পাশ দিয়ে। মাস তিনেকের মধ্যে ধীরে ধীরে কালীঘাট পর্যন্ত এই পরিষেবা বাড়ানো হয়। ব্রিটিশ ট্রামওয়েজ কোম্পানির হাতে তখনও ৭০টি ট্রাম, ৭০০ ঘোড়া মজুত ছিল। তার দিন শেষ হলে, বৈদ্যুতিক ট্রামের জন্য নতুন বগি আনা হয়। ঘোড়ার আস্তাবলের বদলে নতুন ট্রামের জন্য তৈরি হল ডিপো। শ্যামবাজার, কালীঘাট, খিদিরপুর, শিয়ালদহ প্রভৃতি জায়গায় গড়ে উঠল ডিপো।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয় মুসলিম লিগ। সেই সময়ে দাঙ্গা আক্রান্ত শহরবাসীর কাছে সম্প্রীতির বার্তা দিতে ধর্মঘটে শরিক হয়েছিলেন ট্রাম শ্রমিকেরা। তবে ট্রামের সঙ্গে কবির মৃত্যুও জড়িয়ে রয়েছে। বনলতা সেন নয়, জীবনানন্দকে চিরশান্তি দিয়েছিল এক ট্রাম। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন কবি জীবনানন্দ দাশ।
তবে সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের মতোই এ শহর থেকে উধাও হয়েছে অনেক ট্রাম। এখন প্রায় সাতটি রুটে মোট ৩৫টির মতো ট্রাম চলে। কলকাতা খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। ইতিহাস বিলাসীরা চিন্তিত, ইতিহাসপ্রেমীরাও শঙ্কিত। শহরের ঐতিহ্যবাহী ট্রামকে বাঁচাতে অনেকেই লড়ছেন। ট্রাম সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে একাধিকবার রাস্তায় নেমেছেন তারা।


