অব্যক্তকে ব্যক্ত করে সাহিত্যে নোবেল জয়

অব্যক্তকে ব্যক্ত করে সাহিত্যে নোবেল জয়
31 Oct 2023, 01:12 PM

অব্যক্তকে ব্যক্ত করে সাহিত্যে নোবেল জয়

ড. গৌতম সরকার

    

যে কথা বলতে নেই, যে কথা সর্বসমক্ষে উচ্চারণ করা উচিত নয়, যাদের কথা বললে তথাকথিত সুধীজন প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে সাময়িক অব্যাহতি খোঁজেন; সেইসব পিছিয়ে পড়া, ব্রাত্য মানুষদের মুখের কথা, মনের ব্যথা, চিন্তা-চেতনা, যন্ত্রণা, জেহাদ দীর্ঘদিন ধরে নিজের সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন ধারায় ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরেছেন নরওয়ের নাট্যকার, গদ্য রচয়িতা, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, কবি জন ফস। তাঁর সেই একক এবং ঐকান্তিক সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি ও সম্মান হল ২০২৩ সালের সাহিত্যে নোবেল জয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমির তরফে বলা হয়েছে, 'যাঁদের কথা বলা যায় না, বলা হয় না, বা বলতে নেই, সেইসব মানুষের কঠিন-কঠোর জীবন সংগ্রামের কথা দ্ব্যর্থ্যহীন ভাষায় জন ফস তাঁর সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। যে লেখার ছত্রে ছত্রে শ্রম, রক্ত, ঘাম, কষ্টের সাথে মিলেমিশে আছে হাস্যরস।' জন ফস নরওয়ের কম ব্যবহৃত ভাষা নিনর্স্কে সাহিত্য সাধনা করেছেন। নাট্যকার হিসেবে পৃথিবী বিখ্যাত হলেও উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে ফসের সাহিত্য অবদান এককথায় আকাশছোঁয়া। যেসব নাট্যকারদের নাটক এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয়, ফস হলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর লেখার একটা নিজস্ব শৈলী আছে যেটি একদম তার নিজস্ব। সাহিত্য জগতে এই শৈলী 'ফস মিনিম্যালিজম' নামে পরিচিত।

      নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে একটি ছোট শহরে ১৯৫৯ সালে জন ফস জন্মগ্রহন করেন। বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক হন। তারপর থেকেই তিনি পূর্ণ সময় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রেড ব্ল্যাক’। প্রথম নাটক প্রকাশিত এবং মঞ্চস্থ হয় ১৯৮৫ সালে। তাঁর লেখা ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এই ব্রহ্মান্ডের সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়ার আগে ২০১৫ সালে নর্ডিক কাউন্সিলস লিটারেচার পুরস্কার পান। এছাড়া ২০২২ সালে তাঁর উপন্যাস 'আ নিউ নেম' আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজের বাছাই লিস্টে স্থান পেয়েছিল, এছাড়া ২০২৩ সালে ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেলেও তাঁর নাম বাছাই করা হয়েছিল।

       জন ফসের সমস্ত সাহিত্যের মধ্যে একটা অতি স্বাভাবিকতা আছে। সমস্ত পর্যায়ের পাঠকরাই তাঁর লেখার সাথে আত্মস্থ হতে পারেন। ভাষ্যের প্রয়োজনে ভাষার সাথে তিনি যেরকমভাবে কম্প্রোমাইস করেছেন, সেটি তাঁর সাহিত্যের উৎকর্ষতাকে কয়েক মাত্রা এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনেকে তাঁকে স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে তুলনা করেন। দুই মহান সাহিত্যিকের লেখার ধরন অনেকটা একই রকম, তার চেয়েও বড় কথা জন ফস বেকেটের মতোই এমন অনেক কথাই তাঁর নাটক ও উপন্যাসে বলেছেন যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই বলতে নেই। অর্থাৎ যে কথাগুলি বলার মত সাহস অনেক সাহিত্য সেবকদেরই থাকে না, দ্বিধাহীন, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেই না বলা কথাগুলোকে ফস স্বর দিয়েছেন, না বলা বহু স্বরকে সুর দিয়েছেন। এই সাহস ও সংস্কার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পুরস্কার পেলেন নোবেল প্রাইজের মধ্যে দিয়ে।

     সাহিত্য জগতে ফসের পরিচয় শুরু হয় তাঁর নাটকের মধ্যে দিয়ে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে তিনি বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী নাটক রচনা করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - দ্য নেম (১৯৯৫); নাইট সংস (১৯৯৮); ড্রিম অফ অটাম (১৯৯৯); এক্সপ্লোরেশনস (২০০২) ইত্যাদি। মানুষের আবেগের উচ্ছ্বলতা, আশাভঙ্গের হতাশা, দূর্বলের শোষণ, সবলের অত্যাচার, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় অবক্ষয়, বিশ্বাসহীনতা, প্রেম, প্রতিশোধ, প্রতিজ্ঞা সবকিছুই উদ্ভাবনী উপায়ে একটার পর সাজিয়ে সাহিত্যের সুতোয় মালা গেঁথেছেন জন ফস। তাঁর লেখা প্রথম মঞ্চস্থ নাটকটি হল 'অ্যান্ড উই উইল নেভার বি পার্টেড'। তারপর মঞ্চস্থ হয় আরেক বিখ্যাত নাটক, 'সামবডি ইস গোয়িং টু কাম (১৯৯৬)'। তাঁর নাটক নিয়ে বিদ্ব্যজনেদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। কট্টর সমালোচকেরা তাঁর নাটককে 'একবগ্গা', ইংরেজি পরিভাষায়  ‘নাইভ' আখ্যা দিয়েছেন। ফসের নাটকে ভাষার ব্যবহার খুব সীমিত এবং একই সঙ্গে প্রলম্বিত। সমগ্র নাটক জুড়ে ডায়ালগের মাঝে চাতুর্য্যের সঙ্গে দীর্ঘ বিরতি এবং নৈঃশব্দতা ব্যবহার করে তিনি চরিত্রগুলির 'না বলা' বা 'না বলতে পারা' কথাগুলিকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র ও একক।

     জন ফসেকে সাহিত্য জগতে সুপরিচিতি দিয়েছে তাঁর সৃষ্ট 'ম্যাগনাম ওপাস' যেটিকে অনেকে সেপ্টোলজি বলে উল্লেখ করেন। এটি প্রকৃতপক্ষে তাঁর লিখিত তিনটি গদ্য সাহিত্যের সাতটি ভাগ বা অংশ। উপন্যাস তিনটি হল, দ্য আদার নেম (২০১৯); আই ইস অ্যানাদার (২০২০) এবং আ নিউ নেম (২০২১)। সিরিজটি একটি বিগতপত্নীক বয়স্ক চিত্রশিল্পীর নিজের অল্টার-ইগোর সাথে মুখোমুখি বোঝাপড়ার সত্যি গল্প। দীর্ঘদিন একলা যাপনের মধ্যে দিয়ে ধর্ম, আত্মসঙ্কট, শিল্প, কলা, পরিবার সবকিছুর মধ্যে এক অতিমাত্রিক সঙ্কট মোকাবিলার দৈনন্দিন দ্বন্দ্ব নিয়ে এক সুবিশাল গবেষনাধর্মী সাহিত্য সিরিজ। উপন্যাস শুরু হয়েছে এইভাবে - '....এবং নিজেকে দেখতে পেলাম একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছি; ছবিটিতে দুটো রেখা পরস্পরকে ঠিক মধ্যভাগে ছ্বেদ করেছে, একটা গোলাপি রেখা আর অন্যটা বাদামী। ছবিটির পরিসর উচ্চতার তুলনায় প্রস্থে অনেক বেশি .... দেখলাম আমি অত্যন্ত ধীরগতিতে সেই চিত্রপটের উপর আঁচড় কেটে যাচ্ছি .... যেখানে সময়ের হিসেব অনন্ত....' বাক্যগুলি কোনও যতিমালার নিয়ম না মেনে ইনফিনিটির দিকে এগিয়ে চলেছে। উপন্যাস জুড়ে অ্যাসলের জীবনযন্ত্রণার কথা বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে, এবং সমস্তটাই ঘটে যায় আরেকটা অ্যাসলের পরিপ্রেক্ষিতে। লেখক উল্টোদিকের অ্যাসলেকেও চিত্রশিল্পী হিসেবে উপস্থিত করেছেন, কিন্তু সে একজন অ্যালকোহলিক। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে একটা প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, 'হাউ উই বিকাম দ্য পিপল উই বিকাম বাই স্টেজিং টু ভার্সনস অফ দ্য সেম পার্সন এগেইনস্ট ওয়ান অ্যানাদার।'

   জন ফস বারবার তাঁর মূলের কাছে ফিরে গেছেন। তিনি যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন সেটি নরওয়ের খুব কম সংখ্যক মানুষের ভাষা। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র, পরিবেশ, প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক সব কিছু চেনা জগৎ থেকে উঠে আসছে। তাঁর লেখায় আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট এবং অস্ট্রিয়ান কবি জর্জ ট্র্যাকল-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

       ৬৪ বছরের জন ফসকে নিয়ে গত বেশ কয়েকবছর ধরে সাহিত্য জগতে আলোচনা চলছিল। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, ফস কবে নোবেল পাবেন। ২০২৩ সালে সেই আলোচনা আর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটল।

                                      ......xxx......

 

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক

তথ্যঋণ: সংবাদপত্র ও ইন্টারনেট

Mailing List