নতুন বন সংরক্ষণ আইনে আদিবাসীদের কতটা অধিকার খর্ব হতে পারে? আলোচনা করছেন পরিবেশবিদ প্রভাতকুমার শীট

নতুন বন সংরক্ষণ আইনে আদিবাসীদের কতটা অধিকার খর্ব হতে পারে? আলোচনা করছেন পরিবেশবিদ প্রভাতকুমার শীট
প্রভাতকুমার শীট
শাল জঙ্গলঘেরা স্যাতঁস্যাতে উঠোনে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একরত্তি একটি মেয়ে। গায়ে ছেঁড়া জামা। খেতে না পাওয়া জীর্ণ চেহারা। নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সর্দি। গলা দিয়ে খড় খড় আওয়াজ। একচালা টিনের ঘরের বারান্দায় বসে রান্নায় জোগাড়ে ব্যস্ত লক্ষ্মী মুর্মু। ঘরের পেছনে লাগানো কুমড়োর ফুল, শাকের পাতা আর শালজঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কুরকুরে ছাতু উনুনের পাশে রাখা। ঝাঁটি জ্বালানি আর কাঠ দিয়ে উনুন ধরানোর চেষ্টা করছে। মেয়ে ঠান্ডা লেগেছে প্রশ্নই শুনে উনুন থেকে হাঁড়ি নামিয়ে উঠে দাঁড়ান বছর তেইশের লক্ষ্মী। বাড়ির উঠোনের কোণে তুলসী পাতা ছিঁড়ে মেয়ের মুখে পুরে দেন।
ছবিটি শালবনি ব্লকের বালিভাসা গ্রামের একটি আদিবাসী পরিবারের। ভাদুতলা-লালগড় রাজ্য সড়কের বাঘমারি থেকে জঙ্গলের ভিতরে এঁকেবেঁকে লাল মাটির রাস্তা। সেই পথ দিয়ে কিছুটা এগোলেই চোখে পড়বে ভাঙাচোরা মাটির দেওয়ালে টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে বাস মুর্মু পরিবারের। বাড়িতে শৌচালয় নেই। ইদানিং হাতির জেরে কারেন্ট হয়েছে। স্বামী মঙ্গল মুর্মু জঙ্গলে গরু চরাতে গিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে একবার চাষ, তা দিয়ে কোনমতে সারাবছর সংসারের খরাকি চলে। এবছর পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে বীজতলা নষ্ট হওয়ার মুখে। শুধু লক্ষ্মী নয়, জঙ্গলমহলের বাইশ শতাংশ বনবাসী আদিবাসী পরিবারের অর্থনৈতিক চিত্রটা মোটামুটি একই রকম। বনের প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বসবাস করে ওরা। উন্নয়নকামী মানুষ, উন্নয়নের তাগিদে সময়ের সাথে সাথেই নতুন আইন প্রণয়ন করে।
সাম্প্রতিক বের হয়েছে সরকারি নির্দেশিকা। পরির্বতন হচ্ছে বনভূমি অধিকার আইন, পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা করতে হবে এই প্রজন্মকে। সেই নিয়মের জাঁতাকলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা সংশয় দেখা দিচ্ছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সত্তরতম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়েছে ২০৩০ এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট। ভারতও সুস্থিতি উন্নয়নের পথে হাঁটছে। সরকার মনে করে ২০৩০ সালের মধ্যে সমস্ত দারিদ্র্যকে মুছে ফেলতে। ধনী-দরিদ্র, সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে। পরিবেশের সুস্থিতি বজায় রাখতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে অবিচল। সরকার ভাবে জঙ্গলে যারা বসবাস করে তাঁরাই জঙ্গল কেটে জ্বালানি ও বেনিয়ম ভাবে বন উজাড় করছে। জঙ্গলের কাঠ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। তাছাড়াও কাঠের উনুনে প্রচুর পরিমাণে কার্বন উৎপন্ন হয়। যা নারী ও শিশু এবং পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে। সেই কারণেই গাছ লাগানোর পাশাপাশি ২৪ কোটি দরিদ্র ভারতীয়দের বিনামূল্যে উজ্বালা গ্যাস দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সঠিক ভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। উজ্বালা যোজনা গ্যাসের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তির্যক প্রশ্নের সামনে মুখে কুলুপ এঁটেছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গলমহলের ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ২৪৫ টি গ্রামে ৩৫১০ টি বনবাসী পরিবারের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী ৮৩ শতাংশ বনবাসিরা উজ্বালা গ্যাস ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয়। তাঁদের ভরসা জঙ্গলে শুকনো জ্বালানি কাঠ। অনেকে দুই একবার ব্যবহার করে বাড়ির কোণে গ্যাস সিলিন্ডার অযত্নে ফেলে রেখেছে। কেউ আবার বিক্রি করেছে অভাবের তাড়নায়। চারটি কারণে তাঁরা গ্যাস ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেছে।
এক মূলত গ্যাসের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। দুই সংসারে স্বল্প আয়, দারিদ্র্যতা। তিন পরিষেবা ও পরিকাঠামোর অভাব, ফড়েদের কাছে গ্যাসের বই থাকায় ইচ্ছে থাকলেও গ্যাস ভর্তি করতে পারছে না অনেকে। চার জঙ্গলে পর্যাপ্ত জ্বালানি থাকায় চিরাচরিত প্রথায় উনুনে রান্না করতে অভ্যস্ত, স্বচ্ছন্দ বোধ করে। যে সমস্ত মহিলারা কোনদিন স্কুলের দুয়ারে পৌঁছায়নি তাঁদের বেশির ভাগ গ্যাস জ্বালানির ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেছে। আবার পারিবারিক অর্থনৈতিক অনটন গ্যাস ব্যবহার দূরে সরিয়েছে। বনবাসীদের গ্যাস ব্যবহার করা যেন বিলাসিতা।
মহাশ্বেতা দেবীর কথাসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আদিবাসী মানুষ, সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো। আশির দশকে একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় "অরণ্যের অধিকার"। সেই অধিকারের প্রশ্ন। তারপর তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে নানা ভাবে এবং নানা প্রেক্ষিতে উপেক্ষিত, নিপীড়িত বনবাসী মানুষের কথা। জমিদার, মহাজন, নীলকুঠির সাহেব এবং কোম্পানি সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয় প্রতিধ্বনি। বনবাসীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ, তল্লাশি, বনের অধিকার কমানো প্রভৃতি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৭ এর ভারতের অরন্য আইন সংশোধিত হয়। নতুন করে ভারতে অরন্যের অধিকার আইন ২০০৬ সালে চালু হয়। প্রসঙ্গতঃ সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আড়াবাড়ি জঙ্গলে গঠিত হয় যৌথ বন পরিচালন কমিটি। এই ব্যবস্থায় বনবাসীদের উন্নয়নের পাশাপাশি বনসুরক্ষা, বন্যপ্রানী সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় অধিবাসীদের। তা বাস্তবায়িত হয়, তার পর ধাপে ধাপে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
অরন্য অধিকার আইন (২০০৬), অনুসারে বনে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বনবাসীদের বন সম্পদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। এই সম্প্রদায়গুলি জীবিকা, বাসস্থান এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজনের বনের কাঠ ও বনজ সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে। অরণ্যবাসীদের অধিকার আইন আরও পোক্ত করতে ২০০৯ সালে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় অরন্যের জমি অন্য কোন কাজে ব্যবহার করার ছাড়পত্র কোনও কর্তৃপক্ষ দিতে পারবো না। স্থানীয় অরণ্যবাসীর বা গ্রাম কমিটির অনুমোদন ছাড়া বন কাটা যাবে না। বনভূমির ব্যবহারিক চরিত্র পরির্বতন করা যাবে না।
এই বছর জুন মাসে অরণ্যের অধিকার (২০০৬) আইনকে লঘু করেতে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন দফতর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাতে বনবাসীদের অনুমোদন ছাড়াও জঙ্গল কাটার ছাড়পত্রের উল্লেখ আছে। পুঁজিপতিদের ভূমি ব্যবহারের পরির্বতন করে আবাসন তৈরির সুযোগ রয়েছে। ফলে বেসরকারি সংস্থা গুলি যথেচ্ছ ভাবে বনভূমির কাঠামো ও চরিত্র পরিবর্তন আনতে উৎসাহী হবে। শিল্পপতিরা বন কেটে কলকারখানা গড়ে তুলবে। সেই আশঙ্কা করছে অরন্যবাসী জনজাতি। এরা জঙ্গলের শুকনো কাঠ, ফলমূল, ছাতু, বনজ উপজাত সম্পদ ইত্যাদির সাহায্যে জীবনযাপন করে। কিন্তু সরকার দাবি করছে সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিল্পের বিকাশ ও রাস্তাঘাট প্রসারের ইত্যাদির তাদিতে এই আইন পরির্বতন দরকার । অরন্যবাসীরা সরকার নির্ধারিত চল্লিশ শতাংশ বনের শেয়ার ও বনজ সম্পদের নূন্যতম দাম পাচ্ছে না। শালপাতা পরিবেশ বান্ধব হওয়া সত্ত্বেও বাজারে চাহিদা নেই, অথচ প্লাস্টিকের থালাবাটি রমরমিয়ে চলছে। সরকার এ বিষয়ে উদাসিনী।
বন শুধু সংসারের জ্বালানি নয়, লক্ষ লক্ষ বনবাসীর জীবন জীবিকা ও জীবজন্তুদের বাসস্থান।। অরণ্যের অধিকার আইন পরির্বতন হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অরন্যবাসী জনজাতির স্বার্থ ও জীবন যাপনের অধিকার। বনভূমির সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। পরিবেশের অংশ হিসেবে বনবাসী ও সরকারের যৌথ কর্মসূচি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় বনভূমির সুরক্ষা, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ দরকার তবেই স্থিতিশীল উন্নয়ন সম্ভব।
লেখক: অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়, মেদিনীপুর


