পুরাণভিত্তিক ধর্মীয় ধারাবাহিক ‘আমিই সে’ / পঞ্চদশ পর্ব

‘আমিই সে’
(একটি পুরাণভিত্তিক ধর্মীয় ধারাবাহিক রচনা)
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
পঞ্চদশ পর্ব
মার্কন্ডেয়র সামনে জগৎ-পতি জনার্দন শ্রীহরি মধুসূদন দিগন্তব্যাপ্তপ্রান্তরে দিগন্ত বিস্তৃত আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত করে সহাস্যে দণ্ডায়মান।
জগৎ পিতার কি অনন্ত রূপ!!!
আয়তাকার চোখ পদ্মপাতার মত ক্ষমা-সুন্দর, মাথার মুকুট অনন্ত আকাশ স্পর্শ করেছে; মুখে স্মিত হাসি , চারটি হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম।
স্বর্ণালঙ্কার-ভূষণে সুসজ্জিত, ক্ষমা-সুন্দর চক্ষুদ্বয়।
সেই দুটি চোখের পানে চেয়ে মার্কন্ডেয় করজোড়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণর স্তব করতে শুরু করলেন।
"তুমি জগতপতি, বালকের রূপ ধারণ করে বিশ্বকে মোহিত কর; আমি তোমার শরণাগত, দুঃখিত, আমায় তুমি রক্ষা কর। আমি সম্বর্তক নামক বহ্নিজ্বালায় তাপিত হয়েছি, আমায় তুমি রক্ষা কর। প্রবল বায়ু-বেগে আমি বিহ্বল, ক্ষুধার্ত ও শ্রান্ত। এই বিশ্ব-চরাচরে তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই নিজের পরিত্রাতা রূপে দেখতে পাচ্ছি না। এই আশ্রয়-বিহীন সংসারে তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও।
তুমি দেবশ্রেষ্ঠ, সব দেবতাদের প্রিয়, ত্রিলোকেশ্বর ও জগৎ সৃষ্টির কারণ। তুমি সর্বকৃৎ, মধুসূদন, কমলাকান্ত; জল-ই তোমার আবাস-স্থল, আবার তুমিই পৃথিবী, জল,আগুন, বাতাস, আকাশ, মন,অহঙ্কার, বুদ্ধি, প্রকৃতি ও সত্ত্ব প্রভৃতি গুণ। তুমিই এক এবং অভিন্ন জগদ্ব্যাপী পুরুষ ------ পুরুষোত্তম তুমি; সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সব জীব, উদ্ভিদ, জড় পদার্থ এবং অন্যান্য সব কিছুর অধীশ্বর । ব্রহ্ম থেকে তৃণ---- সবকিছুতেই তুমি স্বয়ং ব্যাপ্ত। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত --- প্রভৃতি সমস্ত কালই তুমি।
আমি নিজে তোমার উদরমধ্যে প্রবেশ করে এই বিশ্ব-চরাচরের সবকিছু দর্শন করে প্রকৃত অর্থে বুঝতে পেরেছি: সত্যই তুমি স্বয়ং জগৎ প্রসব করেছ। তুমি নর, নারী---- আবার অর্ধনারীশ্বরের রূপটিও তোমার-ই।
জগৎ সৃষ্টি-কালে তুমিই নিজেকে দুই ভাগে বিভক্ত কর : নর ও নারী রূপে । এবং ঐ মধুর দ্বৈত -সত্ত্বা-গুণে সৃষ্টি কর সমগ্র জগৎ-সংসার।
তোমার স্বরূপের এক অংশও তোমার সৃষ্ট দেবতারাও জানে না, সেখানে আমার মত অল্প বুদ্ধির লোক তা কি করে জানবে?
তুমি শুদ্ধ -স্বভাব, নিত্য, প্রকৃতির অতীত, অব্যক্ত, শাশ্বত, অনন্ত, সর্বব্যাপী, মহেশ্বর, পরম শান্ত, আকাশ, অজ, অব্যয়, বিভু, নির্গুণ ও নিরঞ্জন পুরুষ । ----- কে তোমার স্তব করতে পারে? নিতান্তই ক্ষুদ্র বুদ্ধি আমি; যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে তোমার করুণার দৃষ্টিতে সে সব ক্ষমা করে দিও ।
এইভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পণ করলেন মহামহিম জগদীশ্বরের কাছে। ঠিক ওই কথাই পরবর্তীতে অর্জুন শ্রীমদ্ভাগবতগীতায় একাদশ অধ্যায়ে শ্রীহরি মধুসূদনকে বলেছিলেন,
'হে হৃষিকেশ, তোমার মাহাত্ম্য কীর্তনে সমগ্র জগৎ হৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়, রাক্ষসগন ভয়ে এদিক-ওদিকে পালায়, আর সিদ্ধগণ সবাই একত্রে সমবেত হয়ে সকলেই তোমাকে প্রাণপাত ( নমস্কার) করে।'
অর্থাৎ, "স্থানে হৃষিকেশ তব প্রকীর্ত্ত্যা
জগৎ প্রহৃষ্যত্যনুরজ্যতে চ ।
রক্ষাংসি ভীতানি দিশো দ্রবন্তি
সর্ব্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসংঘাঃ ।।"
এবং হয়তো তারই উত্তর দিতে গিয়ে শ্রীমদ্ভাগবতগীতায় নবম অধ্যায়ে চতুর্দশ শ্লোকে বলেছেন :-
" সততং কীর্ত্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।। "
অর্থাৎ, 'তার মধ্যে কেউ কেউ স্ত্রোত্র-মন্ত্রাদির দ্বারা আমার নাম কীর্তন করে অতি যত্ন সহকারে দৃঢ়ভাবে ব্রতী হয়ে, আমাকে নমস্কার করে, এবং কেউ কেউ আবার সর্বদা সমাহিত চিত্তে আমার সেবা করে। '
তাই, অক্লেশে বলা যায়, "নীল পর্বত যদি কালি হয়, সাগর যদি মসিপাত্র (কলমের কালি রাখবার পাত্র) হয়, পারিজাত বৃক্ষের শ্রেষ্ঠ শাখা যদি হয় লেখনী, পৃথিবী যদি হয় লিখবার পাতা ( বা কাগজ) , দেবী সরস্বতী যদি হন লেখিকা, এবং চিরকাল যদি তিনি লিখে চলেন, তাহলেও তোমার গুণরাশির সীমা অতিক্রম করা যাবে না।"
(চলবে)



