সকালের ভাবনা- স্বল্প দিনের সহকর্মী স্মৃতিতে অমলিন, লুনা শামসুদ্দোহা স্মরণে

সকালের ভাবনা- স্বল্প দিনের সহকর্মী স্মৃতিতে অমলিন, লুনা শামসুদ্দোহা স্মরণে
শেখর দত্ত
সকালে বিছানা ছেড়ে উঠেই কি মনে করে আজ মোবাইলটা হতে নিয়ে ফেসবুক খুললাম। বিয়াইন লক্ষ্মী হালদার আমেরিকার আরকানসাস থেকে ছেলে- বৌমা- নাতনির ছবি পাঠিয়েছে। প্রচণ্ড বরফ পড়ছে সেখানে। ওরা ঘরের বাইরে বরফের মধ্যে বরফ দিয়ে ‘স্নো ম্যান’ ( বরফের মানুষ) বানিয়ে সুন্দর করে কাপড় দিয়ে সাজিয়েছে। ধারণা করি ওই উদ্যোগ বৌমার। ওই শিল্পকর্মের পাশে দঁড়িয়ে ওরা ছবি তুলেছে। অতনুর কোলে অদ্বিতীয়া, পাশে নন্দিতা। ছবিটার দিকে তাকিয়েই আছি। প্রবাসী নাতনি- বৌমা- ছেলের ছবি বলে কথা!
কিন্তু মনটা যে কি! ভাবাবেগ কখন যে কোন্ দিকে ধায়! হঠাৎই গতকালের শোকের রেশ ধরে বার বার মনের কোণে লুনা আপার হাসিমাখা সুন্দর- সুশ্রী- মার্জিত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
গতকাল দুপুরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফেসবুক খুলতেই দেখি লুনা আপার ছবি। ব্যাপার কি! আবার কোন্ এচিভম্যান্টের জন্য কোন্ পুরষ্কার পেলেন? সাইড টেবিলে রাখা চশমাটা চোখে দিয়ে লেখাগুলো পড়তেই প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, ‘লুনা আপা নেই।’ পাশে থেকে আভা বলল, ‘কি বল!’ লুনা আপাকে সেও চিনতো। অগ্রণী ব্যাংকে ২০০৯ সালে পরিচালক হিসাবে যোগ দেওয়ার পর লুনা শামসুদ্দোহার সাথে আমার পরিচয়। ব্যাংকের কয়েকটা অনুষ্ঠানে আভাসহ যাওয়ার কারণে ওর সাথেও লুনা আপার নৈকট্য সৃষ্টি হয়।
যতদিন দু‘জন ওই ব্যাংকের পরিচালক ছিলাম, বোর্ড সভার আগে-পরে সময়-সুযোগ পেলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ বৌদি কেমন আছেন? খুব ভালো তিনি। আপনি সৌভাগ্যবান।’ আমি কখনও বা হেঁয়ালি করে বলতাম, ‘আমার প্রশংসা আপনি করেন না! কেবল বৌদি!’ তিনি হাসতেন। একদিন তিনিও হেঁয়ালির বশে বললেন, ‘ তা করবো কেন? আওয়ামী লীগ করলেও আপনি বড় কমিউনিস্ট! ভয় পাই।’ কিন্তু আমি জানতাম, তিনি আমাকে পছন্দ করেন।
অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে সরে আসার পর আমরা দুজনেই আমাদের অপর সহকর্মী রনজিৎ চক্রবর্তীর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। লুনা আপা আর আভা একত্রে খেতে বসেছিলেন। সেই টেবিলে সকলের কাছে তিনি নাকি কেবল আমার প্রশাংসাই করেছেন। বাসায় এসে আভা তো আবেগে আপ্লুত। বললো, ‘ সবাই প্রশংসা করতে পারে না। যারা স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও অকাতরে প্রশংসা করতে পারেন, তারা বড় মনের অধিকারি হন। লুনা আপা বড় মনের অধিকারি।’ সত্যিই তাই। তিনি উদার মনের মানুষ ছিলেন।
আর আমি ! কিভাবে প্রয়াত লুনা আপার প্রশংসা করবো! তিনি তো অনেক গুণে গুণান্বিতা। নিজের কর্মজগতে ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। এমন উদ্যোগী গুণী ও আধুনিক চিন্তাধারার মহিলা কর্মক্ষেত্রে বিরল। তিনি আমার চাইতে বয়সে অনেক ছোট। যতদূর জানি , ঢাকায় জন্ম নেওয়া অবস্থাপন্ন ঘরের কন্যা লুনা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী হয়েও কর্মজীবন শুরু করেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও তিনি ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন। অবাক হয়ে আমি তাকে বলতাম, ‘আপনি কম্পিউটার সফ্টওয়ার জগতে এলেন কিভাবে?’ রহস্যময়ভাবে হাসতেন।
আজ সকালে যখন প্রয়াত লুনা আপাকে নিয়ে ভাবছিলাম, তখন ওই হাসিটার কথাই কেবল মনে পড়ছিল। জীবন আসলেই রহস্যময়। কখন কোনো গতিস্রোত কোনো দিকে জীবনকে টেনে নিয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। নতুবা আমার মতো এক রাজনৈতিক ব্যক্তি হঠাৎ করে ব্যাংকের পরিচালক হলাম কিভাবে? নিজের তো কোনো ব্যাংক একাউন্টই ছিল না। যদি না হতাম তবে লুনা আপার সাথে সাক্ষাৎই হতো না। জানতামই না কথা ও কাজের সমন্বয় ঘটানোর ক্ষেত্রে পারদর্শিনী লুনা শামসুদ্দোহাকে।
অগ্রণী ব্যাংকে থাকা অবস্থায় আমি আর উনি একটা কমিটিতে কাজ করেছি। ব্যাংকটি তখন অ্যানালগ থেকে ডিজিট্যাল পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কাজ করছে। এক পদ্ধতি থেকে অন্য এক নতুন ও উন্নত পদ্ধতিতে যাওয়া মানেই সমস্যা-সংকট। তদুপরি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষতা, অবহেলা ইত্যাদি তো থাকেই। ব্যাংক তখন ছিল এনিয়ে সমস্যার মধ্যে। কাজ এক পর্যায়ে থমকে গিয়েছিল। সেজন্যই উনার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ডিজিট্যাল বিষয়ে একেবারেই বকলম আমি। যতটুকু মনে পড়ে, লুনা আপার প্রস্তাবেই আমি ওই কমিটির সদস্য হয়েছিলাম।
তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন, ‘ চুক্তিটা ( যে কোম্পানি ডিজিট্যাল করবে তার সাথে ব্যাংকের) ভাল করে পড়বেন আর কোথায় ওই কোম্পনির ত্রুটি আর কোথায় ব্যাংকের ত্রুটি , তা ভালো করে দেখবেন। ওটা আপনি ভালো পারবেন। সত্যিই আমরা কমিটির সদস্যরা অনেক খেঁটেছিলাম। উনার পল্টন অফিসে বন্ধের দিনও আমরা বসেছি। জটও ভেঙেছিল। প্রসঙ্গত বলি, এই জট ভাঙতে আমার রাজনৈতিক জীবনের সহযোদ্ধা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, ডাটা সফটের কর্ণধার মাহবুব জামানকে পর্যন্ত ব্যাংকের এমডির সঙ্গে মিটিং করতে নিয়ে গিয়েছিলাম। এতে লুনা আপা খুব খুশি হয়েছিলেন। কাজ করতে যিনি ভালোবাসেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যিনি পারদর্শী; সেই লুনা আপার সাথে ব্যাংকে থাকার স্মৃতি আসলেই বিস্মৃত হবার মতো নয়।
লুনা আপা পরে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তিনিই প্রথম মহিলা চেয়ারম্যান। পুরানা পল্টনে মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের একটি ফ্লোরে ভাড়াটে হিসাবে রয়েছে জনতা ব্যাংক। কোনো কারণ ছাড়াই সার্ভিস চার্জ আটকে ছিল। আমি আপাকে ফোন দিলাম। ধরলেন না। একটু পরেই টেলিফোন। সমস্যা শুনেই বললেন, ‘দাদা আমি নেপালে। আমার অফিসের প্রজেক্টের কাজে এসেছি। ’ তারিখ ও সময় দিয়ে বললেন, ‘ চলে আসুন ব্যাংকে। অনেকদিন পর দেখা ও কথা হবে।’
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে যাবার পর সবটা শুনে সাথে সাথে কাজটা করে দিয়েছিলেন। আর স্বভাবজাত কারণেই কেন হয় নাই, কার জন্য হয় নাই ; তা আমার সামনেই অনুসন্ধান করে বের করেছিলেন। আর এমনটাও নির্দেশ দিয়েছিলেন, অকারণে কাউকে যেন হয়রানির মধ্যে না ফেলা হয়। এই দিক থেকে মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট তার কাছে ঋণী। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু জানার, সবকিছু বুঝার এবং সে অনুয়ায়ী কাজ করার অপূর্ব দক্ষতা ছিল তার। দ্বায়িত্ববোধ ছিল প্রখর। মর্যাদাবোধ অটুট রাখতেন, কিন্তু কোনো অহংবোধ ছিল না। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক।
লুনা আপার স্বামী শামসুদ্দোহা সাহেবের সাথে অগ্রণী ব্যাংকের দু’একটা অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা ও পরিচয় হয়েছিল। সব মনেও করতে পারছি না। লুনা আপার প্রয়াণের পর তিনি এখন কেমন থাকতে পারেন, তা ভেবে মনটা বিষন্নতায় ভরে আছে। গতকাল লুনা আপার মৃত্যু সংবাদ জানার পর আমাদের তখনকার সহকর্মী ব্যবসায়ী নেতা নাগিবুল ইসলাম দীপুর সাথে কথা হলো। অনেক সময় ধরে দুজনেই আবেগে আপ্লুত হয়ে লুনা আপার স্মৃতিচারণ করলাম।
মাঝে মাঝেই ভাবি, কখনওবা কোনো সময় কাজের ক্ষেত্র যখন এক হয়, তখন যে পরস্পরের যে নৈকট্য সৃষ্টি হয়, কাজের ক্ষেত্র থেকে বের হবার পর তা বজায় থাকে না কেন? আসলে আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড -কথাটা সবৈব সত্য। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যারা দূরে চলে গেলেও ভুলা যায় না। মনে গেঁথে থাকে। লুনা আপা ছিলেন তেমনই একজন সফল মানুষ। তাঁকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যতটুকু মনে হয় , যাদের সঙ্গে তিনি একবার কাজ করেছেন, তারাও লুনা আপাকে ভুলতে পাবরেন না।
এসব ভাবতে ভাবতে সকালটা কেটে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির ছাদে পায়রাগুলো দল বেধে খুঁটে খুটে সব খাচ্ছে। সকালের রূপালি রোদে চারদিক ঝলমল করছে। দিনের চঞ্চলতা তখনও শুরু হয়নি। চারদিক নিস্তব্ধ। কোলোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লুনা আপা নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে অকালেই চলে গেলেন। মনে হলো, জীবনের মূল্য কখনও আয়ুর দীর্ঘতা দিয়ে মাপা যায় না । জীবনের মূল্য কাজের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি হয়। প্রয়াত লুনা আপা কর্ম দিয়ে মূল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রয়াত লুনা শামসুদ্দিনের স্মৃতির প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
লেখক বাংলাদেশের একজন প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

