আতঙ্কের আফগানিস্তানে এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!

আতঙ্কের আফগানিস্তানে এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!
24 Aug 2021, 05:22 PM

আতঙ্কের আফগানিস্তানে এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!

 

ড. গৌতম সরকার

 

আশঙ্কাটা ছিলই, কিন্তু গোটা ব্যাপারটা এইরকম নক্ষত্রগতিতে ঘটে যাবে কেউ কল্পনা করেনি। ৯ মার্চ থেকে আমেরিকা এবং ন্যাটোবাহিনী সৈন্য সরানো প্রক্রিয়া শুরু করতেই তালিবানেরা আস্তে আস্তে আগ্রাসী কাজকর্মের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। একটার পর একটা জেলার দখল নেওয়া, সেখানে স্বায়ত্বশাসন প্রবর্তন, মহিলাদের ব্যাপারে রক্ষণশীল মনোভাব প্রদর্শন, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, যতই লাফঝাঁপ দিক না কেন, এই মুহূর্তে দেশের সার্বিক ক্ষমতা দখল করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, আফগান সরকার তখনও দাবি করে আসছে, তালিবানদের প্রত্যাঘাত হানতে তাদের সেনারা প্রস্তুত। কিন্তু কে জানত কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এরকম তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে?

 

 

নিমেষ ফেলতেই গোটা দেশটা চলে গেল তালিবানদের দখলে। দেশের বড় বড় শহর গজনী, হেরাট, কান্দাহারের পর পনেরোই আগস্টের সকালে রাজধানী শহর কাবুলও অধিকার করে নিল তালিবান সেনা৷ পনেরো তারিখের সকালটা আফগানবাসীদের শুরু হল এক বুক উৎকণ্ঠা নিয়ে। ঘুম ভেঙে উঠেই জানতে পারলো কাবুল থেকে মাত্র এগারো কিলোমিটার দক্ষিণের শহর শরনা দখল করে নিয়েছে তালিবান গোষ্ঠী৷ তারপর থেকেই রাজধানী দখলের মুহূর্তটার জন্যে উৎকন্ঠিত অপেক্ষা শুরু হয়েছিল। সেই প্রতীক্ষাকে দীর্ঘায়িত করতে না দিয়ে কাবুলের সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ 'আৰ্জ'-এরও দখল নিয়ে নিল তালিবান যোদ্ধারা। এরপরই তালিবান নেতৃত্বের দাবি অনুযায়ী আশরফ গনি মার্কিন কূটনীতিবিদ এবং ন্যাটো প্রতিনিধিদের সাথে জরুরিকালীন বৈঠকে বসেন। সেই আলোচনা সভায় মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের নেতৃত্বে যোগ দেন একটি তালিবান প্রতিনিধি দল। বৈঠকেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর বৈঠক শেষেই প্রেসিডেন্ট দেশ ছাড়েন। শোনা যাচ্ছে তিনি ওমান হয়ে আমেরিকায় পোঁছছেন, সঙ্গে নিয়ে গেছেন বিলাসবহুল গাড়ি আর কপ্টার ভর্তি টাকা৷ আফগানিস্তানের শান্তি পরিষদের প্রধান এবং শীর্ষ রাজনীতিক আবদুল্লা আবদুল্লা বলেছেন, "দেশকে এই পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে চলে যাওয়া কাপুরুষতার পরিচয়।" অথচ দুদিন আগেই কান্নাভেজা গলায় প্রেসিডেন্ট দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন, "দেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে আমার কাজ দেশবাসীকে রক্ষা করা। দেশ এই মুহূর্তে গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। আমি রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ খুঁজছি, আন্তর্জাতিক মহলের সাথেও যোগাযোগ রাখছি।" প্রেসিডেন্টের এই পলায়নী মনোবৃত্তির সমালোচনা করে আবদুল্লা আবদুল্লা বলেছেন, "সৃষ্টিকর্তার কাছে গনি দায়বদ্ধ থাকবেন এবং দেশবাসী তাঁর বিচার করবেন।"

 

আফগানিস্তানের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি এবং ব্যাপক অরাজকতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমালোচনার মুখে পড়েছে আমেরিকা। মূল চুক্তি অনুযায়ী ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় থাকা সত্ত্বেও এমাসের মধ্যেই তড়িঘড়ি সৈন্য সরানোর প্রক্রিয়া তালিবানি বাড়বাড়ন্তের মূল কারণ৷ তালিবান সেনা যেভাবে জারাঞ্জ, সেবারঘান, কুন্দুজ, সার-ই-পল, তালুকান, আইবক প্রভৃতি প্রদেশগুলি অধিকার করতে করতে রাজধানী কাবুলের দিকে এগোচ্ছিল সেটা দেখে আমেরিকা প্রমাদ গনছিল। তখন থেকেই সেনা এবং দূতাবাসে কর্মরত আমেরিকানদের ফিরিয়ে নিতে অতি তৎপর হয়ে উঠেছিল। শুধু বাইরের দেশের কাছ থেকেই নয়, আমেরিকার নিজের ঘর থেকেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, যাঁর আমলে ২০০১ সালে আফগানিস্তানের মাটিতে পা রাখে মার্কিনী সেনা, জানিয়েছেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিনী সেনা প্রত্যাহার সিদ্ধান্ত এক 'ঐতিহাসিক ভুল'। আমেরিকা এখন তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই খুশি। তার বেশি আন্তর্জাতিক দায় মেটানোর ইচ্ছে এই মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসনের নেই৷ উপমহাদেশের অশান্তি এবং সন্ত্রাস যতক্ষণ না মহাদেশীয় গা চুঁইয়ে তাদের জন্মভূমিতে গিয়ে পড়ছে, ততক্ষণ তাদের নীতি হল, হাত গুটিয়ে বসে থাকা আর দূর থেকে মজা দেখা। ভারত পড়েছে বিপদে। আমেরিকার সাথে সাথে তালিবান প্রশ্নে রাশিয়ার সঙ্গেও মতানৈক্য তৈরি হচ্ছে। তালিবানরা আশ্বাস দিয়ে চলেছে, সন্ত্রাস আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। সেই আশ্বাসবাক্যে হাত ধুয়ে হোয়াইট হাউস থেকে মস্কো সবাই তালিবানদের না ঘাঁটানোই মনস্থ করেছে।

 

 

ভারত, জার্মানি, তাজিকিস্তান সহ আরও কিছু দেশ নিয়ে গঠিত 'কাতার জোটের' পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সামরিক শক্তি খাটিয়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলে জোট তাদের সমর্থন জানাবে না। যদিও সেই হুমকির আর কোনো মূল্য নেই। উল্টে আফগানিস্তান দখল করে তালিবানরা পাল্টা হুমকি দিতে শুরু করেছে। বিগত কয়েক মাস ধরে তালিবান নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভারত একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের তল্লাশ চালাচ্ছিল, কিন্তু সেই চেষ্টা যে মোটেই ফলপ্রসূ হয়নি সেটা দেশ দখলের প্রথম দিনই তারা বুঝিয়ে দিল। প্রত্যক্ষ হুমকির সুরে তালিবান স্পষ্ট ঘোষণা করল, "ভারত আফগানিস্তানে সেনা পাঠালে বিপদ আছে।" সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তালিবান মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেন, "যদি ভারতীয় সেনা আফগান সেনাকে সাহায্য করার জন্য আসে, তাহলে সেটা তাদের জন্য ভালো হবে না। আফগানিস্তানে অন্য দেশের সেনাদের সাথে কী হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। তারা এলে আগে থেকে জেনেই আসবে।"

  গত দুইদশক ধরে তালিবানদের সব রকমের সহায়তা যুগিয়ে গেছে বিশ্ব রাজনীতির দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ- রাশিয়া এবং চিন। তার সঙ্গে তালিবান সন্ত্রাসকে মদত দিয়ে নতুন উদ্যমে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে সাউথ ব্লক চিন্তিত হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারতের আশঙ্কা পাকিস্তান যদি তালিবানদের সাথে মিলেমিশে কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারতের উপর দ্বিগুণ চাপ তৈরি করে তাহলে সেটা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। সেই কারণেই সাংহাই কো-অপারেশনের বৈঠকে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর আগাগোড়া শান্তি আলোচনার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি প্রস্তাব দেন, আফগানিস্তানে এমন রাজনৈতিক আবহ তৈরি করতে হবে যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোকে সন্ত্রাস বা হিংসার ভয়ে প্রতিমুহূর্তে সিঁটিয়ে না থাকতে হয়। তার জন্য শান্তিপূর্ণ আলোচনা খুব জরুরি। মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানের মানুষেরাও স্বাধীন, নিরাপদ, গণতান্ত্রিক জীবন চায়।

 

তালিবান যত রাজধানীর দিকে এগিয়ে এসেছে, দলে দলে মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে বিমানবন্দরে ছুটেছে৷ ষোলোই আগস্টের খবর, বিমানবন্দরে সিকিওরিটি ব্যবস্হা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে৷ কাবুল বিমানবন্দরে গোলাগুলি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। বিমানের চাকায় বসে উড়তে গিয়ে হাত ফসকে ছাদে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে৷ তালিবানি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে দেশে শান্তিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের এক মুখপাত্র মোহাম্মেদ নায়েম জানিয়েছেন, "আমরা বিশ্বের সব দেশকে আহবান জানাচ্ছি, যেকোনো বিষয়ে আমাদের সঙ্গে বসুন। আমরা নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার ও আফগান নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা রক্ষায় সচেতন থাকবো।" মহিলাদের ব্যাপারে রক্ষণশীল মনোভাব ঝেড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি আরেক মুখপাত্র সুহেল শাহিনের কণ্ঠেও শোনা গেছে।

  

 

তবে তালিবানদের দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটি নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। ওয়াশিংটন ডিসি-র 'উইলসন ইন্টারন্যাশনাল'-এর এশিয়া কর্মসূচির উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ২০২১ সালে তালিবান তাদের জনসংযোগ কৌশল বদলে ফেলেছে। তাঁদের মুখপাত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে জানাচ্ছেন, তাঁরা সার্বজনিক স্বীকৃতি চান। কিন্তু কুগেলম্যানের মতে বিশ্বের সমস্ত দেশকে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এটা ভোলা সমীচীন হবেনা যে আমরা এমন একটা গোষ্ঠীর কথা শুনছি যাদের হাতে নৃশংসতার রক্তের দাগ এখনও মুছে যায়নি। কুগেলম্যানের মতে, আফগানিস্তানের এই পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষ কিরকম থাকে তার উপরই নির্ভর করবে আগামী দিনের সম্পর্কের রসায়ন। দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে যে খবরগুলো আসছে সেগুলো মোটেই অভিপ্রেত নয়। তালিবান দখলীকৃত কান্দাহার থেকে খবর এসেছে সেখানে ব্যাংকে কর্মরত মহিলা কর্মীদের বলা হয়েছে, এখন থেকে তাদের জায়গায় কাজ করবে তাদের পুরুষ আত্মীয়বর্গ। অন্য প্রদেশে মেয়েদের বাইরে বেরোনোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং তাদের বোরখা পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। শুধু মহিলারা কেন, সেভাবে হুকুম জারি না হলেও কাবুল শহরে পুরুষেরাও জিন্স-টি শার্ট ছেড়ে প্রথাগত চুড়িদার পাঞ্জাবি পরে অফিস-বাজারে যাতায়াত করছে।

  

বিশ্বের সমস্ত দেশই এই রাজনৈতিক হিংসার পরিবেশ থেকে তাঁদের লোকজনকে বের করে আনতে চাইছে। রবিবার সকালে যখন তালিবানদের কাবুল দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা তখনই আমেরিকান দূতাবাসে খবর এল, ধ্বংস করে ফেলতে হবে সমস্ত স্পর্শকাতর সব নথি। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কম্পিউটার থেকে নথি মুছে ফেলে ভেঙে ফেলা হল যন্ত্রগুলো। তারপর দূতাবাসের ছাদে অপেক্ষারত হেলিকপ্টারে চড়ে নিরাপদ যাত্রায় সামিল হলেন কর্মীরা। এ যেন ১৯৭৫ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের 'রিপিট টেলিকাস্ট'। সেদিনও এইভাবে ভিয়েতনামের সাইগন ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল মার্কিন দূতাবাস কর্মীরা। যদিও এরপরও আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দাবি করছেন, "এটা ১৯৭৫-এর সাইগন নয়। ৯/১১-এর পর একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।"

 

 

ভারত সরকারও ওই দেশ থেকে ভারতীয়দের ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৫ই আগস্ট ভারতীয় বিমানবাহিনীর সি-১৭ সামরিক বিমানে কাবুল থেকে ১২৯ জন ভারতীয় দিল্লি পৌঁছেছেন। একই সঙ্গে আফগানিস্তানের দূতাবাস থেকে ভারতীয় কূটনীতিকদের ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা হচ্ছে। যদিও দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি।

 

তালিবানদের এই প্রত্যাবর্তন যতই প্রত্যাশিত হোক, বিশ্বের কোনো দেশই এই রাজনৈতিক উথ্থানে স্বস্তিতে নেই। তালিবান শাসনে যদি তথাকথিত সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবাদীদের প্রত্যাবর্তন ঘটে তাহলে বিশ্ব রাজনীতি আবার তোলপাড় হবে, বিশ্ব শান্তি পুনরায় বিঘ্নিত হবে। তালিবান নেতৃত্বের মৌখিক আশ্বাসে চিঁড়ে ভিজবেনা। সকলেই ঘরপোড়া গরু, তাই সিঁদুরে মেঘ থেকে ডরাচ্ছে। আগামী দিনে আফগানিস্তানের সামরিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার দিকনির্ণয় করবে।

 

লেখক: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক

 

Mailing List